বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলনের কারণে ৪০ দিন নগর ভবনের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কর্মকর্তাদের অনেকে তখন এক দিনও অফিসে আসেননি। অথচ তাঁদের জন্য বরাদ্দ করা গাড়ির বিপরীতে প্রতিদিন ১৪–১৫ লিটার তেল খরচ দেখিয়েছেন।
দক্ষিণ সিটিরই অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, অফিস বন্ধ থাকার পরও এই তেল গেল কোথায়?
ঢাকা দক্ষিণ সিটির হিসাব অনুযায়ী, সংস্থাটিতে প্রতি মাসে জ্বালানি খাতে খরচ হয় প্রায় ৫ কোটি টাকা। এপ্রিল, মে ও জুন মাসের খরচ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মে ও জুন মাসে নগর ভবন ৪০ দিন বন্ধ থাকলেও খরচ হয়েছে স্বাভাবিক সময়ের সমান তেল। অথচ এই সময়ে কার্যত কোনো অফিস কার্যক্রম ছিল না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, কেউ যদি অফিস না করেও তেল ইস্যু করে থাকেন, তাহলে সেটা নিতান্তই অন্যায়। এ ধরনের বিষয় থাকলে তিনি খতিয়ে দেখবেন।
গাড়ি চলে না, তেল যায় কোথায়
ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র হিসেবে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে বিএনপির নেতা-কর্মী ও সিটি করপোরেশনের কিছু কর্মচারীর আন্দোলনের কারণে চলতি বছরের ১৪ মে থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত ৪০ দিন নগর ভবনের সেবা কার্যক্রম বন্ধ ছিল।
এই সময়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খায়রুল বাকেরের ব্যবহৃত গাড়িটি একটি স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকেল (এসইউভি), যেটি প্রতিদিন ১৫ লিটার জ্বালানি খরচ করেছে বলে নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। হিসাব করে দেখা গেছে, নগর ভবন বন্ধ থাকা অবস্থায় তিনি ৪০ দিনে ৬০০ লিটার জ্বালানি ব্যবহার করেছেন, যার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৬১ হাজার ২০০ টাকা।
এই গাড়ির চালক কামরুল হাসান বলেন, ‘আন্দোলনের সময় প্রতিদিন বের হইনি, প্রয়োজন হলে স্যারকে নিয়ে বের হয়েছি।’ অথচ করপোরেশনের পরিবহন বিভাগ জানিয়েছে, গাড়িটি প্রতি লিটার জ্বালানিতে গড়ে ৮ কিলোমিটার চলে। সে হিসাবে ১৫ লিটার তেল দিয়ে ১২০ কিলোমিটার প্রতিদিন চলেছে বলেই হিসাব দেখানো হয়েছে। প্রশ্ন হলো নগর ভবন বন্ধ থাকলে এই দৈনিক ১২০ কিলোমিটার যাত্রা কোথায় হয়েছে?
সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের তিনজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, খায়রুল বাকের আন্দোলনের পুরো সময় নগর ভবনে আসেননি। এমনকি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে নগর ভবনে আসছেন অনিয়মিত।
প্রশ্ন আরও জোরালো হয় যখন দেখা যায়, প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান একই সময় প্রতিদিন ১৪ লিটার করে মোট ৫৬০ লিটার তেল নিয়েছেন। এতে করপোরেশনের খরচ হয়েছে ৫৭ হাজার ১২০ টাকা। তিনি দাবি করেন, নগর ভবন বন্ধ থাকলেও তিনি ঢাকা ওয়াসা ভবন, সচিবালয় ও কর্মচারী হাসপাতালে অফিস করেছেন। তাই তেল নিয়েছেন।
কিন্তু করপোরেশনের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, আন্দোলনের সময় করপোরেশনের বাইরে নিয়মিত অফিস চালানোর মতো কোনো অবকাঠামোই ছিল না। কিছু জরুরি সভা সচিবালয় ও ওয়াসা ভবনে হয়েছে মাত্র।
অফিস বন্ধ, খরচ একই
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্ভরযোগ্য সূত্র অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি প্রতি মাসে জ্বালানি বাবদ খরচ করে প্রায় ৫ কোটি টাকা। অথচ এপ্রিল, মে ও জুন মাসের খরচের নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আন্দোলনের সময়ের ৪০ দিন অফিস কার্যত বন্ধ থাকলেও জ্বালানি খরচ ছিল আগের মাসগুলোর সমান।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির যান্ত্রিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বতর্মানে সংস্থাটিতে কর্মকর্তারা ৯১টি গাড়ি ব্যবহার করছেন। মোটরসাইকেল ব্যবহার করছেন ১০১টি। এ ছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত যানবাহনসহ বাকি কাজে ব্যবহৃত মোট গাড়ি ৪১৮টি। সংস্থাটিতে বর্তমানে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বর্জ্য-উচ্ছেদ অভিযানে ব্যবহারের গাড়ি মোট ৬১০টি। তথ্য বলছে, প্রতি মাসে জ্বালানি বাবদ সংস্থাটির খরচ হয় প্রায় ৫ কোটি টাকা। এসব যানবাহনের পেছনে শুধু জ্বালানি বাবদই বছরে ৬০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হচ্ছে।
জ্বালানি ইস্যুকারীর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, যিনি তেল ইস্যু করেন, তাঁর বিরুদ্ধেও অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
যেমন ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রশাসক মাসে কত লিটার তেল ব্যবহার করবেন, তা ঠিক করে সংস্থাটির পরিবহন শাখা। জুন মাসের জ্বালানির হিসাবে দেখা গেছে, প্রশাসকের গাড়িতে ৮৫৫ লিটার তেল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ সিটির বর্তমান প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া একই সঙ্গে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উন্নয়ন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনটি পৃথক জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণে তিনটি গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ পান তিনি।
সিটি করপোরেশন প্রশাসকের জন্য বরাদ্দ করা গাড়িতে প্রতি মাসে সাড়ে ৮০০ লিটারের বেশি তেল বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে-বিষয়টি জানানো হলে শাহজাহান মিয়া বলেন, তিনি সার্বক্ষণিক সিটি করপোরেশনের গাড়ি ব্যবহার করেন না। পরে ওই গাড়ির চালক শাহ আলম বলেন, তিনি অফিসের কাজে গাড়ি চালাতে গিয়েই এত তেল খরচ করেছেন। গাড়ির তেল বিক্রি করে পরিবহন শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভাগাভাগির বিষয়ে তিনি অস্বীকার করেন।
কাগজে–কলমে করপোরেশনের কর্মকর্তাদের গাড়ির তেল ইস্যুকারী কর্মকর্তা সংস্থাটি কেন্দ্রীয় পরিবহন পুলের পরিবহন ব্যবস্থাপক মো. আরিফ চৌধুরী। এভাবে তেল ইস্যু করার ব্যাপারে তিনি বলেন, আন্দোলনের কারণে তিনি ব্যস্ত ছিলেন। তাই আরেকজন তত্ত্বাবধায়ক তেল ইস্যু করেছেন। তবে চূড়ান্ত বিলে তিনি সই করেছেন। সব কর্মকর্তার তেল ঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে কি না, এটা তাঁর একার পক্ষে যাচাই করা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘জনগণের অর্থের যোগসাজশমূলক, অবৈধ, অনৈতিক ও প্রতারণামূলক আত্মসাতের এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
সূত্র : প্রথম আলো
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত