বুধবার, ১১ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

কথিত স্বামী আর ছেলেকে নিয়ে গড়া ‘মুক্তি অপরাধচক্র’

পুলিশের জালে ধরা পড়ল তারা তিনজন

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য ও সরকারি পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে ছিল গভীর সখ্য। এরই জেরে গড়ে ওঠে বিশাল নেটওয়ার্ক ‘মুক্তি অপরাধ চক্র’। ঘনিষ্ঠ হয়ে জিম্মি করতেন নিরীহ মানুষকে। মাদক ব্যবসা ছাড়াও চাঁদাবাজি ও ফিটিং মামলা ছিল এ চক্রের প্রধান কাজ। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। রাজশাহী জেলা পুলিশের জালেই আটকা পড়লেন চক্রের হোতা আমেনা খাতুন মুক্তি (৩৭), মুক্তির ছেলে শাহরিয়ার ওরফে জয় (২২) এবং কথিত স্বামী নুরুজ্জামান ওরফে কাজল (৩৫)।

গোদাগাড়ী পৌরসভার রেলবাজার এলাকা থেকে সোমবার রাতে তাদের গ্রেফতার করে জেলা পুলিশ। এ অভিযানে অংশ নেয় গোদাগাড়ী মডেল থানা পুলিশের একটি দল। অভিযুক্ত আমেনা খাতুন মুক্তি গোদাগাড়ীর মাদারপুর রেলবাজার খাদ্য গুদাম এলাকার মৃত মতিউর রহমান মতির স্ত্রী। গ্রেফতার নুরুজ্জামান কাজল উপজেলার মহিশালবাড়ী এলাকার মৃত নাসির উদ্দিনের ছেলে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, মুক্তি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সোর্স হিসেবে কাজ করতেন। এ পরিচয়ে মাদক ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন তিনি। একই কাজে যুক্ত ছিলেন কাজল। তারা দিনদুপুরে মানুষকে মাদক মামলায় ফাঁসাতেন। মাদক ব্যবসা ছাড়াও অনৈতিক কর্মকান্ডেও যুক্ত ছিলেন মুক্তি। আর তার ছেলে জয় এলাকায় গড়ে তুলেছেন বিশাল কিশোর গ্যাং। কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে মাদক বিক্রি ও ছিনতাইয়েও যুক্ত জয়।

আর এ কাজে তার প্রধান সহযোগী গোদাগাড়ী পৌর এলাকার বুজরুকপাড়ার মাদক ব্যবসায়ী সোহান। জয়ের সঙ্গে বোনের বিয়ে দিয়ে পারিবারিক সম্পর্ক গড়েন সোহান। সোহানের বাবা সাইদুর রহমানও মাদক ব্যবসায়ী। এলাকায় তার পরিচিতি ফেনসি সাইদুর নামে। তাদের বাবা-ছেলের নামেও আছে থানায় একাধিক মাদক মামলা।

পুলিশ জানিয়েছে, মুক্তির বাবার বাড়ি গোদাগাড়ীর সারংপুরে। পেশায় জেলে ছিলেন তার বাবা। ‘সুন্দরী’ মুক্তি যৌবনে যুক্ত হন মাদক সিন্ডিকেটে। শুরুতে এলাকার মাদক কারবারের গডফাদাররা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি কয়েক কর্মকর্তাকে বাগে আনতে মুক্তিকে ‘টোপ’ বানাতেন। একপর্যায়ে সেই কৌশল রপ্ত করে নিজেই বনে যান অপরাধ রাজ্যের নিয়ন্ত্রক। দিনে দিনে গড়ে তোলেন শতাধিক নারী নিয়ে আলাদা নেটওয়ার্ক। এ চক্রে যুক্ত নারীদের প্রত্যেকের বয়স ৩০ বছরের মধ্যে। সুন্দরী এসব নারী এসেছেন দরিদ্র পরিবার থেকে।

এদের মধ্যে যারা বিবাহিত তার অধিকাংশের স্বামী মাদকাসক্ত। সংসার চালানো এমনকি স্বামীদের মাদকের টাকা জোগাতে তারা এ পথে নামেন। মাদক ডিলারদের মনোরঞ্জন করে বাকিতে মাদক এনে খুচরা বিক্রি করেন এসব নারী। রেলবাজার খেয়াঘাট এলাকার আজিজুল ইসলামের মেয়ে নারী মাদক ব্যবসায়ী কারিমা খাতুন, মাদারপুর ডিমভাঙা এলাকার রিনা খাতুন, মহিশালবাড়ী ফকিরাপাড়া এলাকার মৃত ডলারের স্ত্রী ইয়াসমিন এবং ফাতেমা খাতুন ওরফে ফুরকনের আছে প্রায় একই ধরনের আলাদা মাদক নেটওয়ার্ক।

এদিকে আমেনা খাতুন মুক্তি গ্রেফতারের পর তার অপরাধ রাজ্যের নানান তথ্য বেরিয়ে আসছে। অনৈতিক সম্পর্কের ভিডিও ধারণ করে গোদাগাড়ী মডেল থানার এক কর্মকর্তাকে জিম্মি করার অভিযোগ আছে মুক্তির বিরুদ্ধে। মোটা টাকা দিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পান সেই পুলিশ কর্তা।

জানা গেছে, অবৈধ টাকার ছড়াছড়িতে বেপরোয়া জীবন যাপন করেন মুক্তি। বিয়ে করেছেন সাতের অধিক। সর্বশেষ নুরুজ্জামান কাজলকে বিয়ের খবর এলাকায় প্রচার হয়। এর আগে তিনি মাদারপুর রেলবাজার খাদ্য গুদাম এলাকার সৈয়দ আলীর ছেলে মতিউর রহমান মতিকে বিয়ে করেন। পাঁচ বছরের সংসারে তার দুই ছেলে আছে।

এলাকাবাসী জানিয়েছেন, মুক্তির স্বামী মতিও চোরাচালানে যুক্ত ছিলেন। এলাকায় নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে সালিশে মারধরের শিকার হন মতি। এরপর লোকলজ্জায় এলাকা ছেড়ে ঢাকায় যান। সেখান থেকে পাড়ি দেন বিদেশে। পাঁচ বছর প্রবাসজীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে যুক্ত হন মাদক সিন্ডিকেটে। তখনই ঘনিষ্ঠতা থেকে বিয়ে করেন মুক্তিকে। এর পর থেকে স্ত্রীকে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সোর্স পরিচয়ে চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা শুরু করেন মতি। মাদক ব্যবসায়ীদের নিজেদের দ্বন্দ্বে ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মতি খুন হন। এর পর থেকেই আগের পক্ষের ছেলেদের নিয়ে অনেকটা প্রকাশ্যে স্বামীর কর্মকান্ডে নামেন মুক্তি।

গোদাগাড়ী মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম বলেন, গ্রেফতার এ তিনজনের নামে আগে থানায় কোনো মামলা নেই। ৩০ জুলাই গোদাগাড়ী মডেল থানার একটি মাদকের মামলায় পলাতক আসামি মুক্তি ও তার ছেলে জয়। মামলা নম্বর ৪৭/জুলাই। এ ছাড়া ৩ জুন হওয়া মাদকের আরেকটি মামলায় আসামি ছিলেন কাজল। মামলা নম্বর ১০/জুন। জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইফতেখায়ের আলম জানান, বিপুল পরিমাণ মাদকসহ গ্রেফতারের পর তাদের সহযোগীরা পুলিশকে তথ্য দেন। এর পরই অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

সর্বশেষ খবর