রবিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বেহাল উত্তরের নদ-নদী

প্রবীণরা শোনালেন এ নিয়ে করুণ কাহিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী ও রংপুর

বেহাল উত্তরের নদ-নদী

নদী উজান-ভাটির টানে একেক সময় একেক রূপ নেয়। তবে যে রূপেই থাকুক না কেন, নদী বাঁচলেই বাঁচে প্রাণ। সম্প্রতি উচ্চ আদালত তুরাগ নদকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেছেন। এতে দেশের সব নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় রক্ষার জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আইনগত অভিভাবক ঘোষণা করেন হাই কোর্ট। কিন্তু তারপরও ভালো নেই উত্তরের নদীগুলো। এক সময় উত্তরের ১৬ জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে ২৫০টি নদ-নদী ছিল। এখন তা নেমেছে পঞ্চাশের ঘরে। একদিকে দূষণ, অন্যদিকে দখল-বিপন্ন নদীগুলো। এরই মধ্যে আজ পালিত হবে বিশ্ব নদী দিবস। দখল-দূষণ, ভরাটের কারণে অস্তিত্ব হারিয়ে বিপন্ন নাটোরের নারদ, বারনই, নন্দকুঁজা, আত্রাই, গুমানী, বড়ালসহ ৩২টি নদ-নদী। এ জন্য এসব এলাকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে। পানির অভাবে মিলছে না মাছ। কৃষিকাজে বেড়েছে খরচ। হারিয়ে যেতে বসেছে জেলার বড়াল, মুছা, নারদ, নন্দকুঁজা, আত্রাইসহ ছোট বড় বেশির ভাগ নদ-নদী। রাজশাহীতে পদ্মা নদী দিন দিন দখল হয়ে যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ৫৯১ অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করলেও নানা কারণে তাদের উচ্ছেদ করতে পারছে না। তাছাড়া পাঁচটি স্লুইস গেটের মাধ্যমে শহরের তরল বর্জ্যও পদ্মায় পড়ে। এসব কারণে এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা এখন মরতে বসেছে। দখল-দূষণে বিবর্ণ পুরো তীর। যে যার মতো দখল করছে। ফেলা হচ্ছে বর্জ্য। অনেক স্থানে বাঁধের জায়গা দখল করে নির্মাণ হচ্ছে রাজনৈতিক দলের কার্যালয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদীর খালঘাট, গোয়ালবাড়ী থেকে মহানন্দা ব্রিজ পর্যন্ত নদীর পাড়ে বালু ভরাট করে প্লট বিক্রি করা হচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসের সামনেই শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত খালঘাট। আর তা পার হলেই গোয়ালবাড়ী খেয়াঘাটের দুই পাশে চলছে নদী দখলের মচ্ছব। মহানন্দা, পাগলা আর পুনর্ভবা নদীতে ১৪৭ অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করেছে স্থানীয় প্রশাসন। বেতবাড়িয়া মৌজায় দখল করা হয়েছে নদীর প্রায় অর্ধেক। এতে পরিবর্তন হয়েছে স্বাভাবিক গতিপথ। উত্তরের বৃহত্তর জেলা নওগাঁয় আছে আত্রাই, ছোট যমুনা, তুলসীগঙ্গা, শিব, পুনর্ভবা ও নাগর। জেলার অন্যতম নদী ছোট যমুনা ও তুলসীগঙ্গায় এক সময় সারা বছর পানি থাকত। আত্রাই ও পুনর্ভবা পানির অভাবে শুকিয়ে গেছে। বগুড়ার করতোয়া নদীর তীরঘেঁষে প্রাচীন পুন্ড্রনগরীর গোড়াপত্তন হলেও সে সভ্যতার সঙ্গে এখন করতোয়াও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিতে চলেছে। বগুড়া শহরের বুক চিরে প্রবাহিত করতোয়া দূষণ-দখল, ভরাট, প্রবাহ না থাকায় এখন মরা নদী। রংপুর নগরী দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদী ঘাঘট, শ্যামাসুন্দরী, ইছামতী, বুড়াইল, খোকসা ও আলাইকুমারীর প্রবাহ অবৈধ দখল-দূষণে স্বাভাবিক নেই। শ্যামাসুন্দরীকে কেউ কেউ খাল বললেও ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় রাজা জানকীবল্লভ সেন এটি পুনরায় খনন করিয়েছিলেন। দখল-দূষণে এসব নদ-নদী মরে যেতে বসেছে। এক সময় এসব নদ-নদী খরস্রোতা থাকলেও এখন অতীত। শ্যামাসুন্দরীর ১৭০ দখলদার চিহ্নিত হলেও উচ্ছেদ অভিযান থমকে আছে। লালমনিরহাটে দেশের অন্যতম বৃহৎ নদী তিস্তাকে উত্তরের জীবনরেখা বলা হয়। এ তিস্তায় এখন দখলের মহোৎসব চলছে।

প্রবীণরা শোনালেন গল্প : বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রংপুরের রিভারাইন পিপল ক্লাব বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে ‘নদীজনের কথা শুনি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সঞ্জয় চৌধুরীর লেখা, সুর করা ও গাওয়া নদীর গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। গতকাল সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চলে অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রিভারাইন পিপল ক্লাবের আহ্বায়ক ছাওমুন পাটোয়ারী সুপ্ত, সঞ্চালনা করেন সদস্যসচিব শিহাব প্রধান। অনুষ্ঠানে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে কয়েকটি নদীপাড়ের প্রবীণ ব্যক্তিরা কথা বলেন।

গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার মরুয়াদহ নদীপাড়ের নয়া মিয়া ওই নদীর ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরে বক্তব্য দেন। নীলফামারী জেলার দেওনাই নদীপাড়ের নুর ইসলাম নদী দখলের বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকা গ্রহণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। কুড়িগ্রাম জেলার চাকিরপশার নদী রক্ষায় ৫০ বছর ধরে লড়াইয়ে তিক্ততার কথা তুলে ধরেন নজির হোসেন। তয়জন নামের একজন জেলে সারাজীবন নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনি জানালেন এখন আর তিনি নদীতে নামতে পারেন না অবৈধ দখলদারদের হুমকিতে।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের উপদেষ্টা অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক, রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ, প্রকৌশলী ফজলুল হক, নীলফামারী জেলা রিভারাইন পিপলের সমন্বয়ক আবদুল ওয়াদুদ, দিনাজপুরের ভেলামতি নদী সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক জিনিফা ইফফাত, চাকিরপশার নদী সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক খন্দকার আরিফ প্রমুখ। অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ে শোনান রবিউল ইসলাম, মেজবাউর রহমান।

উল্লেখ্য, সেপ্টেম্বর মাসের চতুর্থ রবিবার বিশ্ব নদী দিবস পালন করা হয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য- সামষ্টিক জীবনের জন্য নদীপথ।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর