শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
সংক্ষিপ্ত

ভাগ্য ফেরাতে গিয়ে ভারতের কারাগারে চার যুবক

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াইয়ে কিছুতেই পেরে উঠছিলেন না জাকারিয়া ওরফে রাজেশ (২৭)। রাজেশ রাজশাহীর গোদাগাড়ী পৌরসভার বারইপাড়া মহল্লার বাসিন্দা। বাবা রফিকুল ইসলাম পেশায় দর্জি। সংসার চালাতেই হিমশিম। বাবার কষ্ট ঘোচাতে মাত্র ১৪ বছর বয়সে নেমে পড়েন কাজে। রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে যা পেতেন তাতেই টেনেটুনে সংসার চলত। এক সময় কাজ করতে গিয়ে অসাবধানতায় বহুতল ভবন থেকে পড়ে যান। সেই যাত্রায় প্রাণে বাঁচলেও হারিয়ে ফেলেন স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা। এরপর থেকে পাচ্ছিলেন না কাজ। অভাবের সংসারে বসে থাকারও জো নেই। বড় ভাই বিয়ে করে আলাদা। বাবারও তেমন কাজ নেই। ছেলেকে তাই কথায় কথায় বকাঝকা করতেন রফিকুল ইসলাম। অভিমান বুকে চেপে কাউকে কিছু না জানিয়েই একদিন নিরুদ্দেশ হন জাকারিয়া। মা জোসনা বেগম ভেবেছিলেন, ছেলে হয়তো কাজের সন্ধানে ঢাকায় গেছে। ফিরবে হয়তো একদিন। কিন্তু পরে জানতে পারেন ভারতের কারাগারে বন্দি সে। সেই থেকে অসুস্থ ছেলেকে দেশে ফিরিয়ে আনতে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ছুটছেন জোসনা বেগম।  কিন্তু কোথাও আশার আলো নেই।  এখনো নির্ঘুম রাত কাটে ছেলের প্রতিক্ষায়। চাপা আর্তনাদ মিলিয়ে যায় গাঢ় অন্ধকারে। স্বজনরা জানান, ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর কাজের উদ্দেশ্যে ভারতের আসাম থেকে চেন্নাইয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। পথে করিমগঞ্জ জেলার বাজারিছড়া থানার চুরাইবারি ওয়াচপোস্ট পুলিশ তাকে আটকে দেয়। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে পরদিন তোলা হয় করিমগঞ্জ জেলা আদালতে। এ বছরের ২৫ এপ্রিল দেশটির আদালত তাকে চার মাসের কারাদন্ড দেন। গত ২৫ আগস্ট সাজার মেয়াদ শেষে তার দেশে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু নথিপত্র না থাকায় ১ সেপ্টেম্বর তার ঠিকানা হয়েছে আসামের শিলচর কারাগার।

শিলচর কারাগারে ঠাঁই হয়েছে জাকারিয়ার সহযাত্রী গোদাগাড়ী মহিশালবাড়ির আবদুল ওয়াহারের ছেলে সানাউল্লাহ (২৫), মহিশালবাড়ি মাদারপুরের ইউসুফ আলীর ছেলে কাউসার আলী (২৪) ও একই এলাকার সাইদুর রহমানের ছেলে আশাদুল হকেরও (৩৮)।

প্রত্যেকেই ভাগ্য ফেরানোর আশায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে ঢুকেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের সঙ্গী হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে নথিপত্র গেলে মুক্তি মিলতে পারে এই চার বাংলাদেশির।

পদ্মার তীর ঘেঁষে আশাদুল হকের বাড়ি। বাড়িতে ছিলেন তার স্ত্রী লাকি খাতুন। লাকি খাতুনের কোলে পাঁচ মাসের পুত্রসন্তান। এই সন্তান তখন পেটে। নিরুপায় হয়ে ঋণ শোধে অটোরিকশা বেচে দেন আশাদুল। বন্ধ হয়ে যায় আয়ের পথ। আরেক ছেলের বয়স সাত বছর। বৃদ্ধ মা-বাবা সঙ্গে। সংসারের চাকা সচল রাখতে সিদ্ধান্ত নেন কাজের সন্ধানে ভারতে পাড়ি দেওয়ার। চেন্নাইয়ে পৌঁছানোর আগেই ধরা পড়েন পুলিশের হাতে। দুই সন্তান নিয়ে নিদারুন কষ্টে দিন কাটছে লাকি বেগমের। স্বামীর ঘরে ফেরার অপেক্ষায় তিনি।

হয়তো জীবনের বাকি গল্পটা ভিন্ন হতে পারত পেশায় নির্মাণ শ্রমিক কাউসার আলীর। পাশের রেলবাজার এলাকার শাপলা খাতুন মিমকে বিয়ে করে সুখেই সংসার করছিলেন কাউসার আলী। ঘর আলো করে এসেছিল শিশু কন্যা লামিয়া খাতুন। পাঁচ বছরের সংসারে মেয়ের বয়স তিন। বাবা ইউসুফ আলী স্থানীয় খাদ্য গুদামের শ্রমিক। বাবা-ছেলে মিলে সংসারের চাকা সচল রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মাঝে-মধ্যেই ছেলেকে বকাঝকা করতেন ইউসুল আলী। সেটাই হলো কাল। কাউকে কিছু না জানিয়ে একদিন নিরুদ্দেশ হন কাউসার। যখন স্বজনরা খবর পান, তখন তিনি ভারতের কারাগারে। কারাগারের অন্ধকারেই এখন কাটছে দিন। কবে দেশে ফিরবেন ঠিক নেই। তাই নিজেকে আর সম্পর্কের জালে আটকে রাখতে চাননি বধূ শাপলা খাতুন। সপ্তাহ দুয়েক আগে স্বামীকে তালাক নোটিস পাঠিয়ে অন্যত্র বিয়ে করেন। দুবেলা দুমঠো ভাতের লড়াই চলছিল নির্মাণ শ্রমিক সানাউল্লাহর। তিনিও স্বপ্ন দেখেছিলেন ভালো থাকার। তাই তিনিও নিরুদ্দেশ হন। অন্যদের মতোই তারও একই পরিণতি।

এখন অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছে বাবা আবদুল ওয়াহাব ও মা রেহেনা বেগমের। সন্তানের অপেক্ষায় চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। অপেক্ষায় আছেন সন্তানের ঘরে ফেরার।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর