শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

অব্যবস্থাপনায় ভঙ্গুর চসিক

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

অব্যবস্থাপনায় ভঙ্গুর চসিক

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) এক দশক আগেও ছিল দক্ষ ব্যবস্থাপনায় স্বনির্ভর সংস্থা। পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল সংস্থাটি। কিন্তু এখন অবহেলা ও অব্যবস্থাপনায় সংস্থাটির ভঙ্গুর অবস্থা তৈরি হয়েছে। বাড়েনি কোনো প্রতিষ্ঠান। বরং অবহেলা-অব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান কিছু প্রতিষ্ঠানের অবস্থা বেহাল, কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং কিছু উপকরণ নষ্টের পথে। জানা যায়, সাবেক মেয়র প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ১৭ বছরের সময়ে চসিকে প্রতিষ্ঠা হয় প্রায় ৭০টি স্কুল-কলেজ, তিনটি মাতৃসদন হাসপাতাল, ওয়ার্ডভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও আরবান স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। ফলে নগরের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করে আসছিল। কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে পট পরিবর্তন হয়। ক্রমে ফিকে হয়ে আসে চসিকের সুনাম ও সেবা।

লাইফ সাপোর্টের অ্যাম্বুলেন্স নিজেই ‘মুমূর্ষু’ : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর কেন্দ্র করে লাইফ সাপোর্টের সুবিধাসংবলিত কোটি টাকা মূল্যের একটি অ্যাম্বুলেন্স উপহার দেওয়া হয় চসিককে। তৎকালীন ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার চসিক মেয়রের কাছে অ্যাম্বুলেন্সের চাবি হস্তান্তর করেছিলেন। অ্যাম্বুলেন্সটিতে আইসিইউ সুবিধাসহ ট্রমা রোগীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু এমন অত্যন্ত জরুরি বাহন পরিচালনা করতে পারেনি চসিক। হস্তান্তরের পর বছর পার হলেও অ্যাম্বুলেন্সটি চালু করতে পারেনি সংস্থাটি। অবহেলায় পড়ে আছে চসিকের পুরনো নগর ভবনের সামনে। সেখানে রোদে পুড়ছে, বৃষ্টিতে ভিজছে। ঢেকে রাখা হয়েছে প্লাস্টিক দিয়ে। লাইফ সাপোর্টের অ্যাম্বুলেন্সটি এখন নিজেই ‘মুমূর্ষু’। অভিযোগ আছে, চট্টগ্রামে এমনিতেই লাইফ সাপোর্ট-সংবলিত অ্যাম্বুলেন্সের চরম সংকট। সরকারি অ্যাম্বুলেন্সগুলোর টিকিটি পাওয়া সোনার হরিণ। বেসরকারিগুলোর ভাড়া আকাশচুম্বী। ফলে প্রতিনিয়তই থাকে লাইফ সাপোর্ট-সংবলিত অ্যাম্বুলেন্স সংকট। এমন অবস্থায় অত্যাধুনিক একটি অ্যাম্বুলেন্স এভাবে অবহেলা-অযত্নে পড়ে থাকাটা বড়ই দুঃখজনক। এটি কেবলই চসিকের ব্যর্থতা, দায়িত্বহীনতা।

পড়ে আছে ৪২ কোটি টাকার আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার : ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার স্থাপন প্রকল্প নেয় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে আরবান পাবলিক অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথ সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (ইউপিইএইচএসডিপি) আওতায় এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে প্রায় ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম নগরের বিবিরহাটে নির্মিত হয় আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার। ২০১৩ সালের ১২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৫ সালে ল্যাবটি চালু হয়। নির্মাণের পর সেটি হস্তান্তর করা হয় চসিককে। বসানো হয় ১০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের প্রায় ৮৯টি ছোট-বড় মেশিন। এর মধ্যে ৯৯ শতাংশ মেশিনই জার্মানির উন্নত প্রযুক্তির আর কিছু মেশিন যুক্তরাজ্যের। তৈরি করা হয় পৃথক ছয়টি ল্যাব। কিন্তু ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে শেষ হয় প্রকল্পের মেয়াদ। মেয়াদ শেষ হওয়ায় ১৮ মাস ধরে এটি বন্ধ। বিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ। বন্ধ কর্মরতদের বেতন। নষ্ট হওয়ার পথে আধুনিক মেশিনগুলো। ২০১৫ সালে চালুর পর এখানে প্রকল্পের অধীনে ২৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়। এরই মধ্যে ১৫ জন অন্যত্র চলে যান। এটি দেশের দ্বিতীয় আধুনিক খাদ্য পরীক্ষাগার। চালুর পর এখানে নিয়মিত নানা ধরনের খাবারের নমুনা পরীক্ষা করা হতো। পরীক্ষার মাধ্যমে আয়ও হতো। আধুনিক এ পরীক্ষাগারে দুধ ও দুধজাতীয় পণ্য, মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় পণ্য, বেভারেজ, জুসজাতীয় পণ্য, ড্রিংকিং ওয়াটার, সসজাতীয় পণ্য, মসলা পণ্য, স্ন্যাকস ফুড, বেকারি পণ্য, আইসক্রিম, ড্রাই স্যুপ, নুডলস, পাস্তা, আটা, ময়দা, সুজিসহ ২০ জাতের খাবার টেস্ট করা হতো। বর্তমানে সব কার্যক্রম বন্ধ।

অভিযোগ আছে, চসিকের দায়িত্বশীলদের অবহেলা-উদাসীনতায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাদ্য পরীক্ষাগারটি এখন বন্ধ হয়ে আছে। চসিক নিয়মিত হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও এটির প্রতি কোনো দায় যেন নেই তাদের। অথচ চসিক চাইলে এটিকে আয়বর্ধক প্রকল্প হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করতে পারত। দরকার ছিল কেবল আন্তরিকতা ও উদ্যোগের। কিন্তু এখন ৪২ কোটি টাকার সম্পদটি নষ্ট হওয়ার পথে। দীর্ঘদিন ধরে চালু না থাকায় মেশিনগুলোও নষ্ট হওয়ার পথে।

বন্ধ নির্মাণসামগ্রী পরীক্ষণ গবেষণাগার : চসিক রাস্তাঘাট, ভবনসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর উন্নয়নকাজে ব্যবহৃত উপকরণের মান যাচাই করতে নগরের সাগরিকায় নিজস্ব জায়গায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণসামগ্রী পরীক্ষণ গবেষণাগার নির্মাণ করে। ২ হাজার ৮০০ বর্গফুট জায়গায় নির্মিত দ্বিতল ভবনের ল্যাবটি ২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধন হলেও টেকনিশিয়ানসহ প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে এটি আর চালু হয়নি। চসিকও বলছে, পরীক্ষাগারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এগুলো পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকেও জনবল কাঠামোর অনুমোদন না থাকায় নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। তবে কীভাবে চালু করা যায় এ জন্য প্রকৌশল ও স্বাস্থ্য বিভাগ কাজ করছে।

পড়ে আছে ১২ কোটি টাকার সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ট্রাক : সড়কে গর্ত সৃষ্টি হলে বা ভেঙে গেলে দ্রুত সংস্কার করা, কম জনবল দিয়ে কাজ করা এবং বর্ষাকালে বৃষ্টি হলেও অল্প সময়ের মধ্যে গর্ত ঠিক করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে ১২ কোটি টাকা দিয়ে কেনা হয় পোট হোল পেচার (সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ট্রাক) নামের চারটি গাড়ি। গত বছর ২৬ ডিসেম্বর এগুলো উদ্বোধন করা হয়েছিল। কিন্তু বছর পার না হতেই সড়ক সংস্কার ও গর্ত ভরাটের কাজে গাড়িগুলো এখন সেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। সেগুলো পড়ে আছে নগরের সাগরিকার ইয়ার্ডে। এভাবে পড়ে থাকলে গাড়িগুলো একসময় নষ্ট হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন প্রকৌশলীরা। গাড়িগুলো ব্যবহারের জন্য ইমালসন নামের এক ধরনের বিটুমিনের প্রয়োজন, যা চসিকের কাছে নেই। চসিকের বিভিন্ন ‘গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এবং ব্রিজসমূহের উন্নয়নসহ আধুনিক যান যন্ত্রপাতি ও সড়ক আলোকায়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় গাড়িগুলো কেনা হয়েছিল। এ প্রকল্পের আওতায় ২ কোটি ১৪ লাখ টাকায় কেনা পোর্টেবল বা ভ্রাম্যমাণ অ্যাসফল্ট প্লান্টও ব্যবহার না করে ফেলে রাখা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর