চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার, জহুর হকার মার্কেট, খাতুনগঞ্জ, টেরিবাজারের মতো জনবহুল বাণিজ্যিক এলাকার বেশির ভাগ ভবন ও শপিং মলে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা নেই। নগরীতে প্রায়ই আগুন লাগলও এসব বাজারে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা নিয়ে সচেতনতা নেই। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে কয়েক দফা বলার পরও এ বিষয়ে তোয়াক্কা করেন না ভবন মালিক ও দোকানদাররা। ফলে কয়েকটি বাণিজ্যিক এলাকার ৩০ হাজারের বেশি দোকানে অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক প্রাণহানি ও আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক জরিপে বলা হয়, নগরের আবাসিক ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত বহুতল ভবনগুলোর ৯৭ ভাগই অগ্নিঝুঁকিতে। এর মধ্যে ৯৩ ভাগের অগ্নিনিরাপত্তার সনদ নেই। এ ছাড়া বহুতল ভবনের পর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে মার্কেট, শপিং মল, বস্তি ও কলোনি। ঝুঁকিতে থাকা ৪৩ এলাকার তালিকা করা হয় জরিপে। সেখানে রিয়াজউদ্দিন বাজার, হকার মার্কেট, খাতুনগঞ্জ, টেরিবাজারের মতো বাজারগুলো সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানানো হয়। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করলেও ভবন মালিক ও দোকানদারদের পক্ষ থেকে অসহযোগিতা করা হয়। ২০২০ সালের আগস্টে রিয়াজউদ্দিন বাজারের চৌধুরী প্লাজা, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাজার এলাকার হোটেল সফিনাসহ একাধিক আগুনের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বিকালে রিয়াজউদ্দিন বাজারের নূপুর মার্কেটে আগুন লাগে। এ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি না থাকলেও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, আগুনের সময় ফায়ার সার্ভিসের আটটি গাড়ি ঘটনাস্থলে গেলেও স্থানসংকুলান না হওয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে। এ মুহূর্তে শীত মৌসুম হওয়ায় আগুনের ঝুঁকিও বেশি। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় আগুনে এক পরিবারের পাঁচজনের মৃত্যু হয়। ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপপরিচালক মো. আনিসুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শুধু চট্টগ্রাম নয়, সারা দেশের একই অবস্থা। এখানকার রাস্তাগুলো অনেক সরু। তাই ঝুঁকির পরিমাণ একটিু বেশি। আমরা অনেক দিন ধরে মার্কেটগুলোয় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখার জন্য বলে আসছি। কিছু মার্কেটের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি, এটা চলমান রয়েছে। এক দিনে সম্ভব নয়, ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসবে।’ রিয়াজউদ্দিন বাজার ও পাশের তামাককুণ্ডি লেন গার্মেন্ট, মোবাইলসামগ্রী, জুতা, ব্যাগ, ইলেকট্রনিক্স ও গৃহস্থালি, কাঁচাবাজারসহ বিভিন্ন পণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার। এ দুটি বাজারে অন্তত ২০০ ভবনে ১৫ হাজারের বেশি দোকান আছে। দামে কিছুটা কম এবং ভালো পণ্যের আশায় প্রতিদিন হাজার হাজার ক্রেতা সেখানে ভিড় করেন। সরেজমিন দেখা যায়, এ বাজারের অবস্থা এতটাই ঘিঞ্জি যে, কেউ বাজারের এক গলি দিয়ে ঢুকলে অন্য গলিতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেন। আবার যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সেখানে আগুন নেভানো কিংবা জরুরি যানবাহন ঢোকার রাস্তা নেই। অনেক দোকানের কর্মচারী ভবনের ওপরে আবাসিক ফ্ল্যাটে গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার করেন। এমন অবস্থা যে বাজারের, সেই বাজারের গলিগুলো বৈদ্যুতিক, ডিশ ও ইন্টারনেট, টিঅ্যান্ডডি ও জেনারেটর, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগসহ বিভিন্ন ধরনের তারের জঞ্জালে ভরে আছে। এসব তার থেকে যে কোনো মুহূর্তে আগুনের ব্যাপক ঝুঁকি আছে। অগ্নিদুর্ঘটনায় বাজার থেকে বের হওয়ার মাত্র দুটি সরু রাস্তা। রিয়াজউদ্দিন বাজার বণিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি সালামত আলী বলেন, ‘এখানে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় ইন্টারনেটের তারের কারণে। সংযোগ দিতে নিষেধ করলেও শোনে না। ফায়ার সার্ভিসও সবাইকে সচেতন করার জন্য একাধিকবার নোটিসও করেছে। সমিতির পক্ষ থেকেও সবাইকে সচেতন করা হয়। তবু কাজ হয় না।’ এদিকে অগ্নিঝুঁকিতে থাকা জহুর হকার্স মার্কেটে ২৬ মার্চ ফায়ার সার্ভিসকে নিয়ে অভিযান চালায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, এ মার্কেটের ১ হাজার ২০০ দোকান চরম অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। মার্কেটের বৈদ্যুতিক লাইনগুলো চরম ঝুঁকিপূর্ণ। ২০২১ সালেও এ মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়। ওই সময় অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা ও ওয়াটার রিজার্ভার নির্মাণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এ নির্দেশের দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি। মার্কেটের প্রতিটি দোকানে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে দেশের সবচেয়ে বড় ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, চাক্তাই, শুঁটকিপট্টি ও টেরিবাজার এলাকায় ১৫ হাজারের মতো দোকান, অফিস ও গুদাম রয়েছে। ওই এলাকার অবস্থাও একই। বিভিন্ন ধরনের তারের পাশাপাশি ঘিঞ্জি পরিবেশ ও যান চলাচলের রাস্তা খুবই সীমিত। মালবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যানের কারণে এখানে সার্বক্ষণিক যানজট লেগেই থাকে। এসব ভবনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে যে কোনো মুহূর্তে তাজরীন ফ্যাশন কিংবা চকবাজার অগ্নি ট্র্যাজেডির মতো ভয়ানক দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানি ও ব্যবসায়িক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক জামাল হোসেন বলেন, এটা দীর্ঘদিনের সমস্যা। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারের অন্য দফতরগুলোর আরও কঠোর হওয়া উচিত।