বুধবার, ২৯ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

হয়ে যান ভয়ংকর প্রতারক

♦ ডলার দেওয়ার কথা বলে হাতিয়েছেন লাখ লাখ টাকা ♦ টাকা নেওয়ার পর দিতেন ব্লক

আলী আজম

জাকির হোসেন ফেসবুকে পণ্য বিক্রির একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পান। তিনি ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ করলে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি তাকে বিকাশে টাকা পাঠাতে বলেন। পরবর্তীতে বিকাশে টাকা পাঠালে প্রতারক পণ্য না দিয়ে জাকিরকে ব্লক করে দেন। এতে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। পরে তিনি একই পদ্ধতিতে অন্যদের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করেন। তিনি নিজের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকার বিনিময়ে ডলার বিক্রির জন্য স্ট্যাটাস দেন। এরপর ভুক্তভোগীরা ডলার কেনার জন্য জাকিরের সঙ্গে ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ করেন। জাকির তাদের কাছ থেকে বিকাশ, নগদ, রকেট ও বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা নেন। এরপর ভুক্তভোগীদের ডলার না দিয়ে ম্যাসেঞ্জারে ব্লক করে দেন। এভাবে তিনি একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে ডলার বিক্রির নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি জাকিরের। গতকাল রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২৭ মার্চ রাজধানীর পল্টন থানায় প্রতারণার শিকার হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন মো. ইহসান ইফতেখার লাবীব। তিনি অনলাইনে ওয়েব-ডেভেলপার হিসেবে ফ্রিল্যান্সিং করেন। সার্ভার, ডোমেইনের বিল পরিশোধের জন্য তিনি জাকিরের পেওনিয়ার অ্যাকাউন্টে টাকার বিনিময়ে ডলার কিনতে চান। লাবীব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ডলার বিক্রির জন্য একটি পোস্ট দেখে তিনি তা কিনতে ম্যাসেঞ্জারে কথা বলেন। অজ্ঞাতনামা ফেসবুক ব্যবহারকারী ডলারের জন্য লাবীবকে বিকাশে টাকা পাঠাতে বলেন। তখন লাবীব ইসলামী ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর কথা জানান। কিন্তু অজ্ঞাতনামা ফেসবুক ব্যবহারকারী রাজি হননি।

তখন তার কাছ থেকে ডলার কেনেননি লাবীব। কিন্তু লাবীবের ডলারের বিশেষ প্রয়োজন হলে পুনরায় অজ্ঞাতনামা সেই ফেসবুক আইডিতে যোগাযোগ করেন। তখন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি লাবীবকে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে বলেন। তখন লাবীব বিকাশের মাধ্যমে ৩০ হাজার ৯০০ টাকা পাঠান। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি লাবীবের পেওনিয়ার অ্যাকাউন্টে ডলার না পাঠালে তাদের সঙ্গে পুনরায় ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ করেন। দেখতে পান ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জার আইডি থেকে লাবীবকে ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। এরপর লাবীব প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে পল্টন থানায় মামলা করেন। ওই মামলার তদন্তে জাকিরের সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে আসে এবং পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সূত্রটি আরও জানায়, দেশে বর্তমানে অনেক ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন যাদের প্রতিনিয়ত তাদের কাজের জন্য বিভিন্ন অনলাইন অ্যাকাউন্টে ডলার রিসিভ ও পেমেন্ট করতে হয়। ডলার রিসিভের ক্ষেত্রে তেমন কোনো সমস্যা না হলেও, ডলার দিয়ে অনলাইনে কোনো কিছুর পেমেন্ট (যেমন, ফেসবুক বিজ্ঞাপন, ডোমেইন, সার্ভার, ক্লায়েন্ট রিফান্ড ইত্যাদি) করতে গেলে বাংলাদেশের ব্যাংক থেকে প্রতিবার সর্বোচ্চ ৩০০ মার্কিন ডলার পরিশোধ করা যায়। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ ফ্রিল্যান্সারেরই এলসি করে ডলার পাঠানোর সুযোগ নেই। একদিকে ডলারের পরিমাণ কম থাকে, অন্যদিকে প্রত্যেকেই সাধারণত অনলাইন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পেওনিয়ার, পেপাল বা ট্রান্সফার ওয়াইজ ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এসব অ্যাকাউন্টে ডলার নেওয়ার কোনো উপায় নেই।

ফলে, শুধু অ্যাকাউন্ট টু অ্যাকাউন্ট পেমেন্ট বা সেন্ড মানি করা সম্ভব হয় এবং এটাই একমাত্র উপায়। আর এ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আসামি জাকির কিছু মানুষের ছবি দিয়ে বিভিন্ন নামে ২৬টি ফেক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলেন। এসব অ্যাকাউন্টের প্রোফাইল এমনভাবে সাজাতেন দেখে মনে হয় এগুলো কোনো ফ্রিল্যান্সারের অ্যাকাউন্ট। জাকির এ আইডিগুলো ব্যবহার করে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে ফ্রিল্যান্সার খুঁজে সবাইকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে থাকেন। জাকিরের প্রোফাইল একজন ফ্রিল্যান্সারের প্রোফাইলের মতো করে সাজানোয় অনেকেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করতেন।

এরপর জাকির বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সারের ফ্রেন্ডলিস্ট ও মিউচ্যুয়াল ফ্রেন্ড লিস্টে ঢুকে যান। জাকির তাদেরই টার্গেট করার লক্ষ্যে টাকার বিনিময়ে অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ডলার বিক্রির স্ট্যাটাস দেন। এতে কেউ ডলার কিনতে চাইলে তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে জাকির তার অ্যাকাউন্টে কিংবা বিকাশে টাকা পাঠাতে বলতেন। টাকা পাওয়ার পর জাকির তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ব্লক করে দেন। এ জন্য জাকির অনেকগুলো সিম ব্যবহার করতেন। যেগুলো ব্যবহার করে তাদের সঙ্গে কথা বলার পর বন্ধ করে রাখতেন। যাতে ভুক্তভোগীরা জাকিরের সঙ্গে যেন কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে না পারেন।

এভাবে প্রতারণা করে ‘অমিত বর্মণ কল্লোল’ নামের আইডির মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা, ‘সিদ্দিকুর রহমান’ নামের আইডির মাধ্যমে ৪ লাখ টাকা, ‘জুবায়েদ আহম্মেদ আনসারী’ নামের আইডির মাধ্যমে ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকা, ‘চন্দন বিশ্বাস পুলক’ নামের আইডির মাধ্যমে ৬ লাখ ১০ হাজার টাকা, ‘খান মুহাম্মদ সাব্বির’ নামের আইডির মাধ্যমে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা, ‘কার্তিক দাস’ নামের আইডির মাধ্যমে ২ লাখ ১৩ হাজার টাকা, ‘আতিকুর রহমান রাসেল’ নামের আইডির মাধ্যমে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৩১৮ টাকা, ‘আবদুল কাদের’ নামের আইডির মাধ্যমে ১ লাখ ৪১ হাজার ৫০০ টাকা, ‘নাবিল হাসান মধু’ নামের আইডির মাধ্যমে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ‘জিআর পলাশ’ নামের আইডির মাধ্যমে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫১৮ টাকা ছাড়াও অনান্য আইডি থেকে আনুমানিক ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রতারক জাকির।

ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেন, প্রতারক জাকির টাকার বিনিময়ে ডলার বিক্রির কথা বলে বিকাশের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। পেপাল, পেওনিয়ার ও ট্রান্সফার ওয়াইজের লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর