রাজধানীর লালবাগ থানা। গত ৫ আগস্টের পর অনেকটা কঙ্কালসার অবস্থা। ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উত্তেজিত জনতা পুড়ে ফেলে থানা কম্পাউন্ডে রাখা থানার অপারেশনাল গাড়ি এবং আলামতের ১৫টি মোটরসাইকেল। এর মধ্যে অনেকের ব্যক্তিগত মোটরসাইকেলও ছিল। নতুন স্থাপনার ওপর গত দুই বছর ধরে চালু হওয়া এই থানার প্রায় সব কিছুই গত ৫ আগস্ট লুট হয়েছে। উত্তেজিত জনতার আড়ালে থানায় থাবা পড়ে কিছু দুর্বৃত্তের। থানার চেয়ারটেবিল থেকে শুরু করে স্যান্ডেল পর্যন্ত নিয়ে যায় তারা। ওপরের তথ্যগুলো দিচ্ছিলেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হেলাল উদ্দীন।
গতকাল এ প্রতিবেদককে বলেন, লজিস্টিকস সাপোর্ট ছাড়া তো কর্মকা শুরু করতে বেগ পেতে হবে। তবে সাধারণ ডায়েরি এবং মামলা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী তারা সংগ্রহ করেছেন। এরই মধ্যে প্রায় সব সদস্যই থানায় যোগ দিয়েছেন। মাত্র দুজন সদস্য ঢাকার বাইরে রয়েছেন। তাদের একজনের বাড়ি বরিশাল এবং আরেকজন নোয়াখালীর। আগামীকালের মধ্যেই তারা থানায় যোগ দেবেন বলে জানিয়েছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যে কটা স্থাপনা বেশি আক্রান্ত হয় তার মধ্যে অন্যতম মিরপুর মডেল থানা। তিন তলাবিশিষ্ট থানাভবনটি পুরোটাই আগুনে পুড়েছে। আহত হয়েছেন অনেকে। পুলিশ সদস্যদের বাঁচাতে সেখানে সেদিন অবস্থান নিতে হয় সেনা সদস্যদের।
শুধু লালবাগ কিংবা মিরপুর নয়, ডিএমপির বেশির ভাগ থানার চিত্র অনেকটা একই। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৫১টি থানার মধ্যে কেবল অক্ষত ছিল তিনটি থানা। এর মধ্যে অন্তত ২০টি থানার অবস্থা খুবই নাজুক। কঙ্কালসারে রূপ নিয়েছে যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, ভাটারা, উত্তরা পশ্চিম ও আদাবর থানা।
হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বেশির ভাগ থানাই এখনো রয়ে গেছে ব্যবহারের অনুপযোগী অবস্থায়। যদিও ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশে সীমিত পরিসরে বেশির ভাগ থানাই বিকল্প ব্যবস্থাপনায় শুরু হয়েছে কার্যক্রম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ও প্রাণহানি হয়। বিশেষ করে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে-পরে শেষ তিন দিনে থানা, ফাঁড়িসহ পুলিশের বেশ কিছু স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর সারা দেশে পুলিশি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। স্থাপনা পাহারা দেওয়ার জন্য মোতায়েন করা হয় আনসার সদস্য। সেনাবাহিনীর সদস্যরাও গত কয়েকদিন ধরে থানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন। দুপুরে সরেজমিন মিরপুর থানায় দেখা যায়, সহিংসতায় পুড়ে গেছে পুরো থানা কমপ্লেক্স। এখনো যায়নি পোড়া গন্ধ। থানা চত্বরে থাকা রায়ট কার, পুলিশের পিকআপ ভ্যান আর মোটরসাইকেল এখনো সেদিনের ভয়াবহতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। থানার ভিতরে ঢোকা মাত্রই চোখে পড়ে পুলিশ সদস্যদের পোশাক। ধ্বংসস্তূপে পড়ে আছে থানার সব কাগজপত্র, নথি। পুড়ে ভস্মীভূত চেয়ারটেবিলসহ আসবাবপত্র। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপাই নেই এটি ঢাকার একটি মডেল থানা।
ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় পুড়ে গেছে চারতলা বিশিষ্ট মোহাম্মদপুর থানার বেশির ভাগ কক্ষ। থানা চত্বরে থাকা গাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার কাগজপত্র, নথি, চেয়ারটেবিল সব পুড়ে ভস্মীভূত। নেই কোনো অস্ত্রও। বলা যায় পুরো ভবনটি কঙ্কালসার।
আদাবর থানায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, থানার বাইরে সেনাবাহিনী নিরাপত্তা দিচ্ছে। থানার ভিতরে কেউ প্রবেশ করতে গেলে সেনাবাহিনী তার পরিচয় জানতে চাচ্ছেন। বেলা সাড়ে ৪টার দিকে থানার ওসিসহ ১০-১২ জন পুলিশ সদস্য মিটিং করছিলেন। তবে থানার চেয়ারটেবিল পুড়ে যাওয়ায় দাঁড়িয়েই মিটিং সারতে হচ্ছিল তাদের। তবে আগে থেকেই সাত-আটজন শিক্ষার্থী থানায় প্রবেশ করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছিলেন।
মোহাম্মদপুর থানায় সরেজমিন দেখা যায়, থানার গেটে সেনাবাহিনীর সদস্যরা চেয়ারটেবিল নিয়ে পুলিশ সদস্যদের হারিয়ে যাওয়া মোবাইল, সিমকার্ড, ব্যাজ, ওয়াকিটকিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র উদ্ধারের তালিকা করছেন। থানা ভবনের ভিতরে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৫০-৬০ জন শিক্ষার্থী থানার প্রতিটি রুমে পুড়ে যাওয়া কাগজপত্র গুছিয়ে পরিষ্কার করছে।
মোহাম্মদপুর থানার ওসি দীপক চন্দ্র সাহা বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা থানা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছে। আমাদের থানার কোনো কক্ষ এখনো ঠিকঠাক হয়নি। চেয়ারটেবিলও নেই যে বসে কাজ করব। তবে ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিকঠাক হবে।’ থানা থেকে কতগুলো অস্ত্র লুট হয়েছে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘এখনো লুট হওয়া অস্ত্রের তালিকা করা হয়নি। তালিকা করে পরে জানানো হবে।’ তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ সদস্য জানান, মোহাম্মদপুর থানায় ৫ আগস্ট হামলা করে সব অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পল্টন থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানার গেট এখনো বন্ধ। সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন। তবে গেটে কোনো পুলিশ সদস্যকে দেখা যায়নি। রমনা থানায় গিয়ে দেখা যায়, থানায় কোনো হামলা কিংবা ভাঙচুর করা হয়নি। তবে গেট বন্ধ এবং কোনো পুলিশ সদস্য নেই। জানা গেছে, তেজগাঁও বিভাগের সবগুলো থানা (তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, মোহাম্মদপুর, আদাবর, শেরেবাংলা নগর ও হাতিরঝিল) চালু হয়েছে। তবে সব থানায় এখনই জিডি-মামলা করা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত তেজগাঁও, হাতিরঝিল ও শেরেবাংলা নগর থানায় মামলার এজাহার দায়ের করা যাচ্ছে। শাহবাগ থানার এসআই মাইনুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার তারা কাজে যোগ দিয়েছেন। দুটি লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। একটি পরিচয়পত্র হারানোর জিডি হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, গতকাল পর্যন্ত সারা দেশের মোট ৬৩৯টি থানার মধ্যে ৫৯৯টির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মেট্রোপলিটনের ১১০টি থানার মধ্যে ৯৭টি এবং জেলার ৫২৯টি থানার মধ্যে ৫০২টির কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
থানা-কারাগারের লুট হওয়া অস্ত্র সেনাক্যাম্পে জমা দেওয়ার অনুরোধ : আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্ততে জানানো হয়, দেশের বিভিন্ন থানা ও কারাগার থেকে লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ অতি দ্রুত নিকটস্থ সেনাক্যাম্পে জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
নৌবাহিনীর নিরাপত্তায় উপকূলীয় ২৯ থানার কার্যক্রম শুরু : বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সহায়তা ও নিরাপত্তায় উপকূলীয় অঞ্চলের ২৯ থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। থানাগুলো হলো- ভোলা সদর, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, লালমোহন, তজুমদ্দিন, মনপুরা, চরফ্যাশন, দক্ষিণ আইচা, দুলারহাট, শশীভূষণ, বরগুনা সদর, বামনা, বেতাগী, আমতলী, তালতলী, পাথরঘাটা, মোংলা, রাঙ্গাবালী, খুলনা সদর, খালিশপুর, হরিণটানা, লবণচরা, কয়রা, দিঘলিয়া, দাকোপ, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া।
বিজিবির নিরাপত্তায় সীমান্তবর্তী ২১ থানার কার্যক্রম শুরু : বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) রংপুর ও যশোর রিজিয়নের সার্বিক তত্ত্বাবধানে রংপুর রেঞ্জের সীমান্তবর্তী ১১টি থানা এবং খুলনা রেঞ্জের সীমান্তবর্তী ১০টি থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
৫৯৯ থানার কার্যক্রম শুরু : পুলিশ সদর দপ্তরের এক বার্তায় বলা হয়, দেশের ৬৩৯টি থানার মধ্যে ৫৯৯টির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ১১০টি মেট্রোপলিটন থানার মধ্যে ৯৭টির এবং জেলার ৫২৯টি থানার মধ্যে ৫০২টির কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
রাজশাহীর থানায় ফিরছেন পুলিশ সদস্যরা : রাজশাহী জেলা ও মহানগরের থানাগুলোতে পুলিশ সদস্যরা ফিরতে শুরু করেছেন। গতকাল সকাল থেকে বিভিন্ন থানায় গিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা (ওসি)। একই সঙ্গে এসআই ও কনস্টেবলরা থানায় উপস্থিত হয়েছিলেন। লোকজন নিয়ে তারা ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন। ফাঁড়িগুলোও পরিষ্কার করার কাজ শুরু হয়েছে। রাজশাহী মহানগর পুলিশের সদর দপ্তরে সকাল ৯টার দিকে আসেন কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার। গত সোমবার আরএমপি সদর দপ্তরও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে লুটপাট করা হয়। পুলিশ কমিশনারের কক্ষে একটি টেবিল ছাড়া কিছুই ছিল না। পুলিশ কমিশনার আরএমপি সদর দপ্তরে গিয়ে কিছু সময় ক্ষতিগ্রস্ত সবকিছু ঘুরে দেখেন। আরএমপির মুখপাত্র এডিসি জামিরুল ইসলাম বলেন, আরএমপি সদর দপ্তরে বসার পরিবেশ নেই। আমরা পুলিশ লাইনসে বসে কাজ করছি। থানাগুলোতে ওসিরা চলে গেছেন। বসার মতো পরিবেশ করা মাত্রই অন্য পুলিশ সদস্যরা কাজ শুরু করবেন। তবে আরও কয়েকদিন সময় লাগতে পারে। একই অবস্থা জেলার বিভিন্ন থানায়। সেখানেও ওসি ও এসআইরা গেলেও থানার কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি।
শ্রীমঙ্গলে শান্তি মিছিল, থানায় এসেছে পুলিশ : মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে শান্তি মিছিল হয়েছে। থানায় এসে যোগ দিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। তবে তাদের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী ও আনসার সদস্যা থানায় রয়েছেন। গতকাল সকাল থেকে পুলিশ সদস্যরা থানায় আসতে শুরু করেন। এদিকে, সকালে পৌরসভার মেয়র, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য, রোভার স্কাউট, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সুধীজন ও সাধারণ মানুষসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আয়োজনে শহরে শান্তি মিছিল করেন।
কুড়িগ্রামে ১১ থানায় পুলিশের কার্যক্রম শুরু : সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে ও তাদের সহায়তায় কুড়িগ্রামের ১১টি থানায় পুলিশি কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। এদিকে, জেলার সব থানায় পুলিশি কার্যক্রম শুরু হওয়ায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। এ ব্যাপারে সদর থানার ওসি মাসুদুর রহমান জানান, আমরা স্বল্প পরিসরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় থানায় কার্যক্রম শুরু করেছি। আমাদের এ কাজে সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা থানায় রয়েছেন।
ঝালকাঠিতে ফুলেল শুভেচ্ছা : ঝালকাঠিতে কাজে ফিরতে পুলিশের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন রোভার স্কাউটস লিডাররা। গতকাল ঝালকাঠি সদর থানায় গিয়ে পুলিশ সদস্য ও সেনাবাহিনীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়। এ সময় সদর থানার ওসি শহিদুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন ঝালকাঠি জেলা রোভার স্কাউটের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম, সাউথ বেঙ্গল ওপেন স্কাউট গ্রুপের রোভার স্কাউট লিডার এস এম রেজাউল করিম প্রমুখ।