রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের মানুষের এক সময় জীবন-জীবিকার নির্ভরতা ছিল নদীর ওপর। আবহমান কাল থেকে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অসংখ্য নদনদী। ভাটিয়ালি, মারফতি, মুর্শিদি গান গেয়ে পাল তোলা নৌকার মাঝিরা নদীর প্রাণকে সজীব করে তুলতেন। পারাপারের জন্য ছিল অসংখ্য খেয়াঘাট। কিন্তু এখন আর এসব দৃশ্য চোখে পড়ে না। উত্তরের ১৬ জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় শতাধিক নদী শুকিয়ে ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। এসব নদী দেখলে এখন আর কেউ মনে করেন না- এক সময় এসব নদীর খরস্রোতা যৌবন ছিল। কোথাও কোথাও নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে আবার কোথাও সেতু নির্মাণ হওয়ার জন্য উত্তরাঞ্চল থেকে হারিয়ে গেছে নদী পথে পারাপারে প্রায় দেড় হাজারের ওপর খেয়াঘাট। এসব নদী, উপনদী, শাখা প্রশাখা নদী, ছড়া নদী, নালা নদী এবং নদী খাতের খেয়া পারাপার এখন শুধুই এ অঞ্চলের মানুষের কাছে স্মৃতি। রংপুরের গঙ্গাচড়া-লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলায় যাতায়াতের জন্য সড়ক হয়েছে। গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুরে তিস্তা নদীতে সেতু হয়েছে। অথচ ছয় বছর আগেও এখানে একটি বিশাল খেয়াঘাট ছিল। নৌকার মাঝিদের হাঁকডাকে মুখর ছিল নদীর তীর। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এসব খেয়াঘাট অতিতের স্মৃতি হতে বসেছে। গাইবান্ধার ঘাঘট, কুড়িগ্রামের ধরলা, নীলফামারীর চারালকাটা এসব নদীতে এক সময় খেয়া পারাপার হতো। এখন নদীতে সেতু হওয়ায় খেয়াঘাট আর নেই। এক সময় তিস্তা নদীর শাখা নদী হিসেবে ঘাঘট ও মানাস দাপটের সঙ্গে এ অঞ্চলের প্রকৃতিকে শাসন করত। এসব বহমান নদীর দুই পাড়ে ছিল অসংখ্য খেয়াঘাট। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ পারাপার হতেন এসব খেয়াঘাট দিয়ে। সেসব খেয়াঘাটের অনেক স্থানে নগরায়ণের সুবাতাসের ফলে ব্রিজ, রাস্তাঘাট নির্মাণ হয়েছে। আবার অনেক স্থান পরিণত হয়েছে আবাদি জমিতে। গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর, সদর উপজেলা, পীরগাছা প্রায় ৮০ কিলোমিটার বিস্তৃতি ছিল মানাস নদীর। এ নদীর এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। জমির বুক চিড়ে বেরিয়ে এসেছে হাজার হাজার একর আবাদি জমি। নৌকার পরিবর্তে সেখানে চলছে এখন কলের লাঙল। ৪ দশক আগেও মানাস নদীতে নৌকা চলেছে পাল তুলে। হাজার হাজার জেলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেছে। মানাস নদীতে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৫০টির মতো খেয়াঘাট ছিল। সেগুলো এখন নেই। একই অবস্থা ঘাঘট নদীর। রংপুর শহরের অদূরে ঘাঘটকে কেন্দ্র করেই এ সময় গড়ে উঠেছিল নদীবন্দর। ঘাঘট নদীর ওপর দিয়ে অনেক স্থানেই ব্রিজ হয়েছে। এ ছাড়া ধরলা, জলঢাকা, দুধকুমার, তিস্তা, স্বতী, ঘাঘট, নীলকুমার, বাঙ্গালী, বড়াই, মানাস, কুমলাই, লাতারা, ধুম, বুড়িঘোড়া, দুধ কুমার, সোনাভরা, হলহলিয়া, লোহিত্য, ঘর ঘরিয়া ইত্যাদি।
নদনদী পারাপারের শত শত খেয়া ঘাট ছিল। এসব নদী এখন মৃতপ্রায়। নদী শুকিয়ে যাওয়া এবং যোগাযোগ উন্নয়নে সড়ক এবং সেতু নির্মাণ হওয়ায় এখন খেয়াঘাট এই প্রজন্মের কাছে ইতিহাস হয়ে গেছে।