নিরাপদ শহর বলতে আমরা বুঝি যেখানে জানমাল, ইজ্জত-আব্রু নিরাপদ, শান্তি-প্রশান্তির অবারিত ধারা প্রবহমান। থাকবে না বিবাদ-বিসম্বাদ, মারামারি হানাহানি। আর কোরআন-হাদিসের দৃষ্টিতে সুরক্ষিত বলতে বুঝি যেখানে ইসলামের প্রতিটি বিধিবিধান পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে পালন করা যায়। আদল ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠিত আছে পবিত্র কোরআন আর হাদিসের ওপর বাস্তব আমল ইত্যাদি।
পবিত্র কোরআনে হাকিমে উল্লেখ করা হয়েছে, যখন হজরত ইব্রাহিম আ. দোয়া করলেন, পরোয়ারদিগার। এ শহর (মক্কা)-কে শান্তিধাম করে দাও এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও কেয়ামতে বিশ্বাস করে তাদের ফলের দ্বারা রিজিক দান কর। (সূরা বাকারা, আয়াত-১২৬)। অর্থাৎ হত্যা, লুণ্ঠন, মারামারি, হানাহানি, কাফেরদের অধিকার স্থাপন এবং বিপদ-আপদ থেকে নিরাপদ ও সুরক্ষিত কর। সেই দোয়ার বদৌলতে আজ পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রপ্রধান, কোনো শত্রুবাহিনী এই শহরের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি বা কখনো পারবে না। যার বাস্তব দৃষ্টান্ত আস্হাবে ফিল তথা হস্তি বাহিনীর ঘটনা। বাদশাহ আবরাহার প্রবল শক্তিধর বাহিনীকে আল্লাহতায়ালা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আবাবিল পাখি দ্বারা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এ শহরটি মহান আল্লাহ কর্তৃক এত সুরক্ষিত যেখানে কোনো হত্যা, লুণ্ঠন, রাহজানি এবং ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটেনি। একজন ব্যক্তি যখন পবিত্র মক্কাতুল মুকাররমায় পৌঁছে সঙ্গে সঙ্গে কুদরতি এক প্রশান্তি সে হৃদয় অনুভব করে। বিশেষ করে হজের মৌসুমে। কোনো শারীরিক, মানসিক টেনশন থাকে না। শারীরিক যত সমস্যাই হোক না কেন, আছে কুদরতি মহাওষুধ আবে জমজম বা জমজমের পানি। পানি পান করার সঙ্গে সঙ্গেই এমন এক তৃপ্তির ঢেঁকুুর আসে যেন হাজারো রোগে জর্জরিত ব্যক্তি একেবারে সুস্থ সবল হয়ে যায়। অপরদিকে নিরাপদ শহরে প্রবেশের বরকতের কারণে নিরাপত্তাদাতা মহান রাব্বুল আলামিন ওই ব্যক্তির পরিবার-পরিজনের জন্য সম্পূর্ণ জিম্মাদার হয়ে যান। ফলে ওই ব্যক্তির হৃদয় তাদের ব্যাপারে থাকে না কোনো ভয়, থাকে না কোনো পেরেশানি।
জাহেলি যুগের আরবরা বর্বরতা, হিংস্রতা, অনাচার, কুফর ও শিরকে লিপ্ত থাকার পরও পবিত্র কা'বাতুল্লাহ ও হরমের পাশর্্ববর্তী এলাকাকে নিরাপদ এবং সুরক্ষিত রাখার ব্যাপারে নিজেদের ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করত। নিজেদের প্রাণের শত্রুকে হরমের কাছে হাতের নাগালে পেয়েও প্রতিশোধ নেওয়াকে বৈধ মনে করত না। শুধু তাই নয়, এ শহরের অধিবাসীদের সম্মান প্রদর্শন করাকে নিজেদের ঈমানি দায়িত্ব মনে করত। ফলে মক্কাবাসী নির্বিঘ্নে ইরাক, ইয়েমেন এবং সিরিয়া প্রভৃতি দেশে বাণিজ্যিক সফর করত। কেউ তাদের ক্ষতিসাধন তো দূরের কথা, ক্ষতিসাধনের কোনো চিন্তাও করত না। এ ছাড়া অন্যান্য জীবজন্তুও হরমে নিরাপদ ছিল। আল্লাহপাক তার কুদরতে চতুষ্পদ জীবজন্তুর অন্তরে এমন একটি নিরাপত্তার হাওয়া চালু করে দেন। ফলে প্রাণীগুলো মাঠে-ময়দানে, চারণ ভূমিতে মনের আনন্দে স্বাধীনভাবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আপন রিজিক আহার করে সন্ধ্যায় মালিকের বাড়িতে ফিরে আসে। কোনো শিকারি দেখলেও তারা ভয় পায় না। পবিত্র মক্কাতুল মুকাররমা শুধু নিরাপদ আর সুরক্ষিত শহরই নয়, বরং এ শহরটি একটি জনবহুল শহর, বিশ্ববাসীর প্রত্যাবর্তনস্থলও বটে। এ শহরে সারা বিশ্বের চারদিক থেকে মুসলমানরা মৌমাছির ন্যায় আগমন করে নিজেদের পরম সৌভাগ্যবান মনে করে। এ শহরে প্রবেশ করে নিজেদের জীবনের কাঙ্ক্ষিত আশা পূর্ণ হয়েছে বলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। কী আছে সেখানে? না আছে কোনো মনোমুঙ্কর দৃশ্যপট। না আছে কোনো ঐতিহাসিক জাদুঘর। না এখানে পৌঁছা সহজ, না আছে ব্যবসায়িক কোনো সুবিধা, তা সত্ত্বেও পবিত্র শহর মক্কাতুল মুকাররমায় জীবনে অন্তত একবার যাওয়ার আগ্রহ হৃদয়ে অবিরাম ঢেউ খেলতে থাকে। লাখ লাখ অর্থকড়ি ব্যয় করে সেই শহরে পৌঁছার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। দেখার তৃপ্তির যেন শেষ নেই, একবার দেখে আসার পর মানব হৃদয় বারবার দেখার আগ্রহ প্রবল থেকে আরও প্রবল হতে থাকে। উলামায়ে কেরামরা বলেন, একবার হজ করে আসার পর আবার যাওয়ার আগ্রহ হজের কবুলিয়াতের আলামত। এ বিস্ময়কর ব্যাপারটি একমাত্র পবিত্র কা'বাতুল্লাহর সঙ্গেই সীমাবদ্ধ। অন্যথায় পৃথিবীর যত উন্নত শহর, মনোমুঙ্কর দৃশ্য হোক না কেন, তা এক বা দুবার দেখার পর আর দেখার কোনো আগ্রহ থাকে না। কিন্তু কাবাতুল্লাহকে যত দেখে ততই যেন আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। হাজিরা পবিত্র মক্কাতুল মুকাররমা থেকে দেশে ফেরার পথে দোয়া করে আসেন, হে আল্লাহ তোমার এ পবিত্র শহরে আমাকে বারবার আসার সুযোগ করে দাও। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে সেই পবিত্র শহর মক্কাতুল মুকাররমায় বারবার যাওয়ার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : মুহাদ্দিস জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা।