ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে সংস্কৃতি রাজধানী ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি হিসেবে বলা হয়ে থাকে। সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধ বিজড়িত নানান চিহ্ন রয়েছে এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। দিল্লি থেকে আগত ইসলাম ধর্ম প্রচারক শাহ সুফী হযরত কাজী মাহমুদ শাহ এ শহর থেকে উল্লিখিত ব্রাহ্মণ পরিবার সমূহকে বেরিয়ে যাবার নির্দেশ প্রদান করেন, যা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়। সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে খ্যাত হওয়ার কারণ সুর স¤্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, ব্যারিস্টার এ রসুল, নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, কথা সাহিত্যিক অদ্বৈত মল্ল বর্মণ, কবি আবদুল কাদির, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ বহু জ্ঞানী গুণীদের জন্ম। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৫ সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিয়ে সরাসরি অংশগ্রহণ করে। এ ছাড়া তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মহকুমার প্রায় ১০ লাখ মানুষই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশকে মোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ অঞ্চল ছিল ২নং এবং ৩ নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি হলেও এগুলো সংরক্ষণে ছিল না কোন জাদুঘর। দীর্ঘ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কোনো জাদুঘর না থাকায় স্মৃতি বিজড়িত অনেক কিছু আজ হারিয়ে গেছে। তাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্মৃতিগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ ৫০ বছর পর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে উদ্বোধন করা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘর। সম্প্রতি পৌর এলাকার দক্ষিণ মৌড়াইলে সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক হায়াত উদ দৌলা খান জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলা শহরের দক্ষিণ মৌড়াইল এলাকায় এক সময় সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয় ছিল। পরে ভূমি কার্যালয় স্থানান্তরিত হয়। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই জায়গাটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। পরে এক একর জায়গায় জেলা প্রশাসন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিভাগীয় কমিশনারের টিআর কর্মসূচি, জেলা প্রশাসকের বিশেষ বরাদ্দ ও বিভিন্ন মাধ্যমে জাদুঘর নির্মাণের অর্থ জোগাড় করা হয়। জাদুঘর নির্মাণে প্রায় ২০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এই জাদুঘরে ১১১টি উপকরণ রয়েছে। সবচেয়ে পুরনো জিনিস যেটি রয়েছে সেটি হচ্ছে হাজার বছর পূর্বের একটি ফসিল। ভিতরে প্রথমে রয়েছে অভ্যর্থনা কক্ষ। পাশেই তিনটি কক্ষ। প্রথম কক্ষটি মুক্তিযুদ্ধ, দ্বিতীয় কক্ষটি ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং তৃতীয় কক্ষটি সংস্কৃতি। মুক্তিযুদ্ধের কক্ষে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল এবং স্বাধীনতার সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বক্তব্য রাখার সময়কার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে ছবিসহ মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতি। দ্বিতীয় কক্ষে জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য- বিপ্লবী উল্লাস কর দত্তের বাড়ি, নৌকাবাইচ, আঁচিল বা হাঁসলি মোরগ, হাতির পুল, কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া গ্রামোফোন রেকর্ড, টেলিফোন, টাইপ মেশিন, পুরনো পয়সা, পিতলের জিনিসপত্রের ছবি এবং তৃতীয় কক্ষে ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, অন্নপূর্ণা খাঁ, প্রয়াত হরলাল রায়, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ছবি ও তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র রয়েছে। ১৯৯৪ সালের রানী এলিজাবেদের পাঠানো পেয়ালা, ১৮৮০ সালে ইংরেজ আমলের মুদ্রা, ১৯৫৪ সালের ২টি রেডিও। তাছাড়া অধ্যক্ষ হরলালের রায়ের টাইপ মেশিন, দোয়াত কলম, হাজারো বছর পূর্বের পাহাড়ের তলদেশ থেকে উদ্ধার করা জীবাশ্ম, ২ ইঞ্চির একটি কোরআন শরীফ, ৩০০ বছর পূর্বের নোঙর, ১৪০ বছরের পূর্বের নারিকেল কুড়ানিসহ হাজার ও শত বছরের পুরনো জিনিস রয়েছে জাদুঘরে।
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক, লেখক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি জয়দুল হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ ও সংস্কৃতির রাজধানী এই জেলা। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে জেলায় একটি জাদুঘর নির্মাণের আমাদের দাবি ছিল। জাদুঘর নির্মাণ করায় বিদায়ী জেলা প্রশাসককে ধন্যবাদ। সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক হায়াদ উদ দৌলা খাঁন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য, সংস্কৃতির অনেক কিছু আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। দীর্ঘদিন ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি জাদুঘর তৈরির দাবি ছিল। এই জেলার সম্পর্কে জানতে জাদুঘরটি তৈরি করা হয়েছে।