শনিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

কুয়াকাটায় বাড়তি টোলের নামে পর্যটক হয়রানি

সঞ্জয় দাস লিটু, পটুয়াখালী

কুয়াকাটায় বাড়তি টোলের নামে পর্যটক হয়রানি

সাগরকন্যা কুয়াকাটায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা পর্যটকদের পিকনিক পার্টির রিজার্ভ বাস হতে কলাপাড়া-কুয়াকাটা মহাসড়কের তিনটি সেতু পারাপারে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত টোল আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে পর্যটক বেড়েছে কুয়াকাটায়। বিশেষ করে শীত মৌসুমে সপ্তাহের বৃহস্পতি ও শুক্রবার গড়ে শতাধিক পিকনিক পার্টির রিজার্ভ বাস আসা-যাওয়া করে কুয়াকাটায়। ইজারাদারের লোকজন রাতে বাসচালকদের জিম্মি করে দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ পর্যন্ত টোল আদায় করে থাকে। প্রতিবাদ করলে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে চালকদের টাকা দিতে বাধ্য করে এবং অশ্লীল ভাষায় গালাগালও করে। এমনকি অতিরিক্ত টাকা উল্লেখ করা রসিদও প্রদান করে। হয়রানির শিকার হয়ে বাসচালক ও পর্যটকদের মধ্যে দিন দিন ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতারিত হয়ে সেখান থেকে ফিরে যাচ্ছেন পর্যটকরা। এভাবে চলতে থাকলে দিন দিন পর্যটনশিল্প প্রসারে বিরূপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা আছে বলে মন্তব্য করেছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। জানা যায়, পটুয়াখালী জেলা শহর থেকে কুয়াকাটার দূরত্ব ৭৪ কিলোমিটার। কলাপাড়া উপজেলা সদর থেকে কুয়াকাটার দূরত্ব ২১ কিলোমিটারের মধ্যে তিনটি নদীর ওপর তিনটি সেতু রয়েছে। ঢাকা-পটুয়াখালী কুয়াকাটা মহাসড়কের কলাপাড়া শহরসংলগ্ন আন্দারমানিক নদীর ওপর শেখ কামাল সেতু, হাজিপুর সোনাতলা নদীর ওপর শেখ জামাল সেতু ও শীববাড়িয়া নদীর ওপর শেখ রাসেল সেতু। চালক ও সুপারভাইজারদের অভিযোগে এবং রসিদে দেখা যায়, গত ২০ জানুয়ারি শেখ কামাল সেতুর রসিদে একটি বড় বাসের (চেয়ার কোচ) ভাড়া ১৮০ টাকার স্থলে রাখা হয়েছে ২৫০ টাকা। ২১ তারিখ একই বাস গন্তব্যে ফিরে যাওয়ার সময়ও রাখা হয়েছে ২৫০ টাকা। একইভাবে শেখ জামাল সেতুতে ৯০ টাকার স্থলে ভাড়া রাখা হয়েছে ১৮০ টাকা। গন্তব্যে ফিরে যাওয়ার সময় আবারও ১৮০ টাকা রাখা হয়েছে। শেখ রাসেল সেতুতে ৯০ টাকার স্থলে একইভাবে ১৮০ টাকা রাখা হয়েছে। খুলনার কয়রা থেকে মিনিবাস নিয়ে আসা একজন চালকের অভিযোগ, তার মিনিবাসে শেখ জামাল সেতুতে ১০০ টাকা ভাড়া নির্ধারিত থাকলেও আদায় করা হয়েছে ২৫০ টাকা। আর শেখ জামাল ও শেখ রাসেল সেতুর ৫০ টাকার স্থলে ১৮০ টাকা রাখা হয়েছে। চালক ও সুপারভাইজারের অভিযোগ, সিন্ডিকেট করে তিনটি সেতুর টোল আদায় করে থাকে ইজারাদাররা। এমনকি পুলিশ সদস্যরা ডিউটিতে থাকলেও তর্ক-বিতর্ক শুনে না দেখার ভান করে অন্যদিকে চলে যান। খুলনা জেলার কয়রা থেকে রিজার্ভ বাস নিয়ে কুয়াকাটায় এসেছেন চালক মো. শাহিন। সুব্রত পরিবহনের একটি মিনিবাস নিয়ে ২০ জানুয়ারি  ভোর রাতে কুয়াকাটায় পৌঁছান তিনি। আসার সময় কলাপাড়া থেকে কুয়াকাটা পৌঁছতে শেষ তিনটা সেতুর টোল দিতে গিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। তিনি বলেন, টোলঘরে তাদের চাহিদামতো অতিরিক্ত টোল দিতে না চাইলে অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করে থাকে। হাজিপুর শেখ জামাল সেতু ও মহিপুর শেখ রাসেল সেতুর নির্ধারিত ৫০ টাকার টোল ১৮০ টাকা রাখছে। আর শেখ কামাল সেতুর নির্ধারিত ১০০ টাকার টোল দিতে হয়েছে ২৫০ টাকা।

এত  বেশি টোল কেন জিজ্ঞাসা করলে ওরা বলে ভাড়া এইটাই। না হলে তুমি ব্রিজ পারাইয়া এপারে আইছো কেন? ব্রিজ পারাইয়া ব্যাগে যাও। তিনি আরও জানান, এভাবে অতিরিক্ত টোল আদায় করলে মালিক-মহাজনরা ব্যবসা করতে পারবে না। ভাড়া তো এইটা না, আসলে আমরা যে ভাড়াটা হিসাব করে মহাজনের কাছ থেকে নিয়ে আসি, ভাড়া যদি বেশি দিতে হয় তাহলে আমরা দিনমজুরি করি, সে হিসাব করলে আমাদেরও বেতন থাকে না। আমাদের পকেট থেকে টোল দিতে হবে। অভিযোগ করে চালক আরও বলেন, তারা (ইজাদাররা) যেটা চাইবে সেটাই তো দেওয়া লাগবে। দূর-দূরান্ত দিয়া আসছি। যদি আমার গাড়িটা আটকাইয়া দেয় তাইলে পার্টিরা তো বুঝবে না। তাই বাধ্য হয়ে দিতে হচ্ছে। চাঁদপুর থেকে রিজার্ভ চেয়ার কোচ নিয়ে আসা তিশা পরিবহনের সুপারভাইজার মো. জসিম জানান, গত ২০ জানুয়ারি থেকে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর আমি পার্টি নিয়ে কমপক্ষে ১০ বার কুয়াকাটা গেছি। শীত মৌসুম পড়ার পর আমার একটু বেশি যাওয়া পড়ে। বিশেষ করে বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার পিকনিক পার্টি রিজার্ভ নিয়ে কুয়াকাটায় যাই। এ ছাড়াও সরকারি ছুটি কিংবা যে কোনো উৎসবের টানা ছুটিতে রিজার্ভ বাস নিয়ে আসি কুয়াকাটায়। দেশের সব প্রান্তেই বাস নিয়ে যাই। দেশের কোথাও সরকার নির্ধারিত টোলের অতিরিক্ত আদায় করতে দেখিনি। কলাপাড়া শহরের পর তিনটি নদীর ওপর টোল আদায় করছে ইচ্ছামতো। চেয়ার কোচে ১৮০ টাকা নির্ধারিত ভাড়া নিচ্ছে ২৫০ টাকা। শেখ জামাল ও শেখ রাসেল সেতুতে ১০০ টাকার স্থলে নিচ্ছে ১৮০ টাকা। প্রতিবাদ করলে তারা গালমন্দ করে জোরপূর্বক টাকা হাতিয়ে নেয়। আবার অতিরিক্ত টাকার রসিদও দিচ্ছে। বাড়াবাড়ি করলে টোলের লোকজন বলে- আসলে আসেন নাইলে ঘুরাইয়া চলে যান। আপনাদের আসা লাগবে না। এখানে লাউকাঠী নদীর ওপর পটুয়াখালী  সেতুর টোলঘরে ভাড়া ১৩৫ টাকা নেয় ঠিকই, কিন্তু রাতে তারা পৌরসভার টোল বাবদ ১০০ টাকা করে আদায় করে থাকে।

পর্যটক সোহাগ রহমান বলেন, কুয়াকাটা যাওয়ার পথে রাত সাড়ে ৩টার দিকে চালক ও সুপারভাইজারের সঙ্গে টোল কর্তৃপক্ষের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে যায়। এগিয়ে শুনতে পাই অতিরিক্ত টোল চাওয়ায় বাসের চালক ও সুপারভাইজারের সঙ্গে ইজারাদারের লোকজনের কথা কাটাকাটি হচ্ছে। টোল কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, পিকনিক পার্টির বাসে এই হারেই টোল দিতে হবে। না হলে বাস ঘুরিয়ে গন্তব্যে চলে যাও। কেন উঠেছো ব্রিজে। ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনস অব কুয়াকাটা (টোয়াক)-এর সভাপতি  মো. ইমতিয়াজ তুষার বলেন, সপ্তাহের সরকারি ছুটির দিনগুলোতে শতাধিক পিকনিক পার্টির বাস আসে কুয়াকাটায়। কোনো কোনো শুক্রবার তারও বেশি পিকনিক পার্টি আসে। সরকার নির্ধারিত হারের চেয়ে যদি সেতুর টোল বেশি আদায় করা হয় সেটা প্রথমত পর্যটকদের হয়রানির একটা অংশ। দ্বিতীয়ত কুয়াকাটার প্রতি পর্যটক যারা আসে তাদের একটা বিরূপ ধারণা তৈরি হবে।  কোথাও প্রবেশের পথেই যদি বাধা আসে বা খারাপ কিছু আসে অথবা কোনো কাজে যদি মন খারাপ করে তাহলে পুরো ট্যুরটাই নষ্ট হয় বা মানসিক অবস্থা ভালো থাকে না। ঢুকতে গিয়েই যদি বিড়ম্বনার শিকার হয়। শুরুতেই যে আঘাতটা তাকে করতেছি, মানসিকভাবে বা আর্থিকভাবে, সেটা একেবারেই আমাদের জঘন্য অপরাধ। বিশেষ করে ট্যুরিস্টের সেবার ক্ষেত্রে। তিনি আরও বলেন, সরকারি যে ভাড়াটা নির্ধারিত আছে সেটা নিতে পারে। কম তো আর নিতে পারবে না। কিন্তু সেটা (টোল) নেওয়ার পাশাপাশিও ভালো ব্যবহার আসা করতে পারেস ট্যুরিস্টরা। সেটা না করে যদি বেশি ভাড়া আদায় করে তাহলে দুদিকেই আমাদের জন্য খারাপ। একদিকে পর্যটকের সঙ্গে আমরা বিরূপ আচরণ করতেছি, আর দ্বিতীয়ত কুয়াকাটার প্রতি তার একটা খারাপ ধারণা তৈরি হবে। পরবর্তীতে ব্যাক করার পর কুয়াকাটার প্রতি পজেটিভ প্রচার করবে না। এটা আমাদের জন্য একেবারে একটা দুঃসংবাদ। এটা থেকে যে কোনোভাবে হোক প্রশাসনিক অথবা যে কাঠামোই হোক এটা বন্ধ করা উচিত বলে আমরা মনে করি। শেখ রাসেল সেতুর ইজারাদার মেসার্স খান ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আবুল বাশার বলেন, অতিরিক্ত টোল আদায় করার বিষয়টি তার জানা নাই। তবে আমার লোকজনকে বলে দিয়েছি। কারও কাছ থেকে একটি টাকাও বাড়তি নেবে না। আপনি বলছেন আমি বিষয়টি দেখতেছি। আমি ঢাকায় এসে আপনার সঙ্গে কথা বলব। শেখ জামাল সেতুর ইজারাদার মেসার্স রফিক এন্টারপ্রাইজের পরিচালক মো. জুয়েল হাসান বলেন, বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখছি। পর্যটকদের সঙ্গে খারাপ আচরণের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা মোটেই সত্য নয়। আপনাকে যারাই বলেছে সেটা মিথ্যা বলেছে। কারণ আমার লোকজনকে আমি বলে দিয়েছি কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করবা না। আমি বুধবার পটুয়াখালীতে আসতেছি আপনার সঙ্গে কথা হবে, চা খাব। শেখ কামাল সেতুর ইজারাদার নাজমুস সায়াদাত বলেন, আমি তো টোলে অনেক দিন ধরে যাই না। খোঁজখবর নিয়ে দেখছি বিষয়টা? কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র মো. আনোয়ার হাওলাদার বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা প্রতি বৃহস্পতি ও শুক্রবার বাস নিয়ে কুয়াকাটায় ঘুরতে আসেন। পর্যটকবাহী বাসে অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিষয়ে আমাকে কেউ জানায়নি। এটা আমার আওতার বাইরে। তবে পর্যটকরা আমাদের মেহমান। টোলের ভাড়া নির্ধারণ করা আছে। যদি এর বাইরে কোনো ইজারাদার বা তার লোকজন বেশি ভাড়া আদায় করে তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

এ বিষয়ে পটুয়াখালী সড়ক ও জনপদের নির্বাহী প্রকৌশলী এ এম আতিক উল্লাহ বলেন, টোলের ইজারাদাররা সরকারি নিয়ম-কানুন মেনেই স্বাক্ষর করে ইজারা নিয়ে থাকেন। প্রত্যেক টোল প্লাজায় নির্ধারিত মূল্য তালিকা উল্লেখ করে বোর্ড টাঙানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ অধিকার সংরক্ষণ করি। এর যদি কোনো ব্যত্যয় হয় বা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে থাকে তাহলে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি ইজারা বাতিল পর্যন্ত করা হবে। কুয়াকাটা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব ও কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শংকর চন্দ্র বৈদ্য বলেন, অতিরিক্ত টোল আদায়ের বিষয়টি তার জানা ছিল না। নির্ধারিত টোল আদায়ের বাইরে যদি কোনো ইজারাদার অতিরিক্ত টোল আদায় করে তবে তা খতিয়ে দেখে সড়ক ও জনপদের নির্বাহী প্রকৌশলীকে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর