মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

পানিশূন্য তিস্তা-ধরলা

লালমনিরহাট প্রতিনিধি

পানিশূন্য তিস্তা-ধরলা

করালগ্রাসী প্রমত্তা তিস্তা ও ধরলা নদী বর্ষায় ফুলে ফেঁপে দু’কূল ভাসিয়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করে। এ নদী দুটির হিংস্র থাবায় ভেঙে নিয়ে যায় ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও স্থাপনা। এ নদী দুটি এখন শুকিয়ে ধু-ধু বালুচরে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। খেয়া পাড়ে বা মাছ ধরতে বর্ষায় নৌকা নিয়ে ছুটে চলা মাঝি-মাল্লাদের দৌড়-ঝাঁপ নেই। পানি আর মাছে পরিপূর্ণ তিস্তা-ধরলার বুকে জেগে উঠেছে শুধুই বালুচর। মাছ ধরতে না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন নদীর দু-পাড়ের কয়েক হাজার জেলে পরিবার। বিপন্ন হতে বসেছে তিস্তা-ধরলার বুকে বাস করা নানা জীববৈচিত্র্য। নৌকা নয় পায়ে হেঁটেই তিস্তা-ধরলা পাড়ি দিচ্ছে নদী দু-পাড়ের মানুষজন। তিস্তা-ধরলা পাড়ে শুধু চলছে হাহাকার অবস্থা। কৃষক, জেলে থেকে শুরু করে তিস্তা-ধরলার সুবিধাভোগী কয়েক লাখ মানুষের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠছে। লালমনিরহাটের মৎস্য অফিস সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ অংশে তিস্তা-ধরলার বুক জুড়ে বাস করত ৬৭ প্রজাতির মাছ। পানি না থাকায় আজ সেগুলো বিলুপ্তির পথে। এখন বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৭ প্রজাতির মাছ। আর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমের মতে, তিস্তা-ধরলায় বাস করা ১১৭ প্রজাতির জীববৈচিত্র্যের মধ্যে অধিকাংশই এখন বিপন্ন। শুধু  তিস্তা-ধরলাই নয় অন্যান্য নদীতেও পানি সংকটের কারণে রংপুর অঞ্চল ধীরে ধীরে মরুকরণের দিকে যাচ্ছে বলে অভিমত পোষণ করেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও রিভারাইন পিপলস এর পরিচালক ও নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ। তার মতে, তিস্তাসহ অন্যান্য নদী এখন শুধুই ইতিহাস। আগামী প্রজন্ম জানবেই না নদী নামের শব্দটি। তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি চুক্তি করা না গেলে কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে সব নদী, নিশ্চিত মরুকরণ হবে এই অঞ্চল এমনটাই দাবি এই নদী গবেষকের। তিনি আরও বলেন, ভারতের অংশে তিস্তায় পর্যাপ্ত পানি থাকা সত্ত্বে¡ও ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা মরতে বসেছে, এটি ভারতের স্পষ্টত আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। লালমনিরহাটের ১৩টি নদীতে পানি না থাকায় পরিবেশের ভারসাম্যেও বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

 নদীগুলোর অধিকাংশই এখন আবাদী জমিতে পরিণত হয়েছে। তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের লালমনিরহাটের সভাপতি ড. শফিকুল ইসলাম মনে করেন, তিস্তা-ধরলাসহ অন্যান্য নদীগুলোতে অবশ্যই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে খনন করতে হবে। অন্যথায় নদীর বুক থেকে যেমন জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাবে পাশাপাশি কয়েক লাখ মানুষ বেকার হয়ে যাবে। সূত্র জানায়, ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ঐতিহাসিক এ তিস্তা নদী। লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে রয়েছে প্রায় ১৬৫ কিলোমিটার। ভারতের গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে সেই দেশের সরকার একতরফা তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণ করায় তিস্তা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ফলে লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলার ১৬৫ কিলোমিটার তিস্তার অববাহিকায় জীবনযাত্রা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দেশের অন্যতম সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার তিস্তা ব্যারাজ অকার্যকর হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সেখানে ভরা ইরি বোরো মৌসুমে পানি পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১৩০০ কিউসেক বললেন ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদৌল্লা।

তিস্তা নদীর উপর নির্মিত তিস্তা রেলসেতু, তিস্তা সড়ক সেতু ও নির্মাণাধীন দ্বিতীয় তিস্তা সড়ক সেতু দাঁড়িয়ে রয়েছে ধু-ধু বালুচরের তিস্তার উপর। ব্রিজ থাকলেও পায়ে হেঁটেই পার হচ্ছে অনেকেই। ঢেউহীন তিস্তায় রয়েছে শুধু বালুকণা। তিস্তা নদীতে মাছ আহরণ করে শুঁটকি ও মাছ বিক্রি করে জীবনযাপন করতেন এ অঞ্চলের হাজারো জেলে। তারাও আজ কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এছাড়াও মাঝি-মাল্লারাও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। হারিয়ে গেছে তিস্তার বুকে বাস করা নানা বৈচিত্র্যময় প্রাণী। তিস্তাপাড়ের মানুষের কাছে এসব যেন এখন ইতিহাস। পানি না থাকায় তিস্তার সুবিধাভোগী জেলে ও মাঝি মাল্লাদের কষ্টের কথা স্বীকার করে লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী  প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানালেন, যতটুকু পানি আছে, সেই পানিটুকু ব্যারেজের মাধ্যমে ক্যানেলে নেওয়ার পর তিস্তার বুক জুড়ে ধু-ধু বালুচর হওয়ায় তিস্তার সুবিধাভোগীদের কষ্ট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। পানিই যেহেতু নদীর প্রাণ, তাই পানি না থাকলে এর সুবিধাভোগীরা বেকায়দায় পড়বে এটাই স্বাভাবিক।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর