১৬ জানুয়ারি, ২০২২ ২০:১১

নোয়াখালী পৌরসভায় আবারও নৌকার জয়

বিশেষ প্রতিনিধি, নোয়াখালী থেকে

নোয়াখালী পৌরসভায় আবারও নৌকার জয়

মো. সহিদ উল্যাহ খান (ডানে)

নোয়াখালী পৌরসভা নির্বাচনে আবারো নৌকার জয় হয়েছে। ২৬ হাজার ৪০৮ ভোট পেয়ে মেয়র পদে ফের জয়ী হয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান মেয়র শহিদ উল্যাহ খাঁন সোহেল। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নোয়াখালী জেলা বিএনপি থেকে অব্যাহতি প্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক স্বতন্ত্র প্রার্থী মো: শহীদুল ইসলাম কিরণ কম্পিউটার প্রতীকে পেয়েছেন ৮ হাজার ৬২৮ ভোট। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী লুৎফুল হায়দার লেনিন মোবাইল প্রতীকে পেয়েছেন ২ হাজার ২৪৪ ভোট। রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সবকটি কেন্দ্র ৩৪টির ফলাফল ঘোষণা করেন জেলা নির্বাচন ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. রবিউল আলম। 

এর আগে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া, একজনের ফিংগার প্রিন্ট আর বাটনে অন্যজনের চাপ দেওয়াসহ বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে বিকাল চারটায় শেষ হয় ভোট গ্রহণ। এরপর শুরু হয় ভোট গননা। সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোটের ফলাফল প্রকাশ করেন রির্টানিং অফিসার। 

সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত একটানা বিরতীহিন ভাবে পৌরসভার ৯ টি ওয়ার্ডের ৩৪ টি কেন্দ্রে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।

সকাল থেকে জেলা শহরের প্রতিটি কেন্দ্রে বিপুল সংখ্যক নারীপুরুষ ভোট দেবার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। দুপুরের পর ভোটারদের উপস্থিতি কমে আসে। কোনো কোনো কেন্দ্র এসময় ফাঁকা হয়ে যায়। তবে কেন্দ্রগুলোর চারপাশের সড়কগুলো ছিলো নৌকার কর্মী সমর্থকদের ভিড়। তাদের এসময় মিছিল করতেও দেখা যায়। 

সকাল ৮টা ১০ মিনিটে নোয়াখালী পৌসভার ৪ নং ওয়ার্ডের মাইজদী পাবলিক কলেজ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বর্তমান মেয়র শহিদ উল্যাহ খাঁন সোহেল তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের ভি চিহ্ণ দেখিয়ে বলেন, বিগত সাড়ে ৫ বছর তার উন্নয়ন ও মানুষের জন্য যদি কিছু করে থাকি তবে তার প্রতিদান ভোটাররা অবশ্যই দেবেন। তিনি জয়ের বিষয়ে শতভাগ আশাবাদী। এতো সুন্দর পরিবেশে এবং এতো নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে ভোট করার জন্য তিনি প্রশাসনকেও ধন্যবাদ জানান।

সকাল সাড়ে ৮টায় পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডের মাইজদী লইয়ার্স কলোনী প্রভাতি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভোট প্রদান করেনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত বিদ্রোহী প্রার্থী লুৎফুর হায়দার লেনিন। সকাল সাড়ে ১০টায় তিনি কয়েকটি কেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, কোনো সহিংসতা না ঘটলেও ভোটারদের নৌকার লোকজন ভয়ভীতি দেখানোর কারণে অনেকে ভোট কেন্দ্রে আসেননি এবং মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেননি। তিনি জানান, সকালে আওয়ামী লীগের কর্মীরা মাইজদী পাবলিক কলেজ কেন্দ্র, অরুন চন্দ্র স্কুল কেন্দ্র, গোপাই প্রাইমারী স্কুল কেন্দ্র, চাইল্ড কেয়ার স্কুল, দত্তেরহাট দারুসুন্নাহ মাদ্রাসা কেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের বের করে দেয়। এ সকল কেন্দ্রে তারা জোর করে নৌকায় ভোট দিয়ে দেয়।

সকাল সাড়ে ৯টায় পৌর এলাকার সোনাপুর কারামতিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে নোয়াখালী জেলা বিএনপি থেকে অব্যাহতি প্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক স্বতন্ত্র প্রার্থী শহিদুল ইসলাম কিরন তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। বিকালে তিনি জানান, ভোটগ্রহণ শান্তিপূর্ণ হলেও বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের বের করে দেওয়া এবং মেয়র পদে ভোটটি নৌকায় দেওয়ার জন্য সেখানে সরকারী দলীয় কর্মীদের সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। সকালে সোনাপুর ব্রদার আন্দ্রে কেন্দ্রে তার এজেন্টদের ফরম নিয়ে যাবার সময় আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসী তমাল তার অন্যতম কর্মী শওকত হোসেন দিদারকে মারধর করে ফরম ছিনিয়ে নেয়। খবর পেয়ে তিনি সে কেন্দ্রে গিয়ে নতুন করে ফরম পূরণ করে তার এজেন্টদের সেখানে বসিয়ে দিলেও পরবর্তীতে তাদেরকে ভয়ভীতি দেখানো হয়।

অন্য মেয়র প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোট
স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু নাছের নারিকেল গাছ প্রতীকে পেয়েছেন ১ হাজার ১১৭ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী মো: মো: কাজী আনোয়ার হোসেন জগ প্রতীকে পেয়েছেন ২২৭ ভোট। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মো: সহিদুল ইসলাম হাতপাখা প্রতীকে পেয়েছেন ৯৫০ ভোট। জাতীয় পার্টির মো সামছুল ইসলাম মজনু লাঙ্গল প্রতীকে পেয়েছেন ১৭৯ ভোট।

এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ
নোয়াখালী পৌরসভা নির্বাচনের বেশ কয়েকটি  কেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। রোববার সকালে ভোট শুরুর আধা ঘণ্টার মধ্যেই মাইজদী পাবলিক কলেজ, আল ফারুক স্কুল কেন্দ্র ও হরিরামপুর ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটে। বেলা সাড়ে ১১টায় এসব কেন্দ্রে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্টদের দেখা যায়নি। অনেককেই কেন্দ্রের বাইরে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়।

সকাল সাড়ে ১০টায় পাবলিক কলেজ কেন্দ্রে সতন্ত্র মেয়র প্রার্থী লুৎফুল হায়দার লেনিন বলেন, সকাল আটটার দিকে ভোট শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এজেন্টরা মোবাইল মার্কাসহ অন্য সকল স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। পাবলিক কলেজ কেন্দ্রের মোবাইল মার্কার এজেন্ট রাসেল আহমেদ বলেন, আমাদের কাউকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়নি নৌকার প্রতীক এজেন্টরা। তাদের অভিযোগ, ৮টি কেন্দ্র থেকে তাদের ৪০ জন এজেন্টকে বের করে দেওয়া হয়। 

ফিঙ্গার প্রিন্ট একজনের বাটন চাপছেন আরেকজন
নোয়াখালী পৌরসভা নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রের বুথে টোকেন মিলিয়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়া ভোটারের বাটন চেপে দিচ্ছেন আরেকজন। এমন অভিযোগ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এজেন্টদের। রোববার নোয়াখালী পৌর নির্বাচনের ভোট গ্রহণের কয়েকটি কেন্দ্রের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এজেন্টরা এসব অভিযোগ করেন। বেলা ১২ টার দিকে মাইজদী পাবলিক কলেজ কেন্দ্রে মোবাইল প্রতীকের লুৎফর হায়দার লেনিনের এজেন্ট ইমাম হোসেন অভিযোগ করে বলেন, কেন্দ্রের বুথে প্রবেশ করলে তাকে বের করে দেয়া হয়। ভোটাররা কেন্দ্রে প্রবেশ করলেও ফিঙ্গার মিললেও ভোট দিতে পারছে না। নৌকা প্রতীকের এজেন্টরা বাটন চেপে ভোট দিচ্ছেন।  

কম্পিউটার প্রতীকের এজেন্ট মাকসুদুর রহমান রনি বলেন, পাশের মহিলা কেন্দ্র আল ফারুক স্কুলেও একই অবস্থা। বুথের ভেতরে থাকা সবাই নৌকা প্রতীকের হয়ে কাজ করছে। পুলিশ, আনসার সবার সহযোগিতায় চলছে ভোট কারচুপি। একই ভাবে হরিরামপুর কেন্দ্র,  আলিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রসহ আরও অন্তত ১০ টি কেন্দ্রে বুথ ক্যাপচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে।  

ছেলের কোলে এসেও ভোট দিতে পারেননি 
বয়স ৮০ পেরিয়ে ৯০ কৌটায়, হাঁটতে চলতে পারেন না। ছেলের কোলে করে আজ ভোট দিতে এসেছেন নিজাম উদ্দিন। নোয়াখালী পৌরসভা নির্বাচনের মাইজদী পাবলিক কলেজ কেন্দ্রে দেখা মিলে এই ভোটারের সঙ্গে।  

বৃদ্ধ নিজাম উদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘হাত-রত নাই চলতে পারি না, তাতে কী? ভোট অধিকার, ভোট দিতেই হবে। তাই কষ্ট করে হলেও ভোট দিতে এসেছি’। বৃদ্ধের ছেলে বলেন, ‘পছন্দের মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের ভোট দিতে বাবা ভোট কেন্দ্রে এসেছেন। অনেক কষ্ট করে এলেও বুথে গিয়ে দেখা দেয় বিপত্তি। ফিঙ্গার মিলেনি অনেক চেষ্টা করেও। পরে ভোট না দিয়েই ফিরে যেতে হলো’।

জানতে চাইলে সোনাপুর ব্রাদার আন্দ্রে উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রিসাইডিং অফিসার জসিম উদ্দিন জানান তার কেন্দ্রে কোন অনিয়ম হয়নি। তবে সকালে কম্পিউটার প্রতিকের প্রার্থী এসে নুতন করে এজেন্ট ফরম দিয়ে তার এজেন্টদের বসিয়েছেন।

পৌরসভা নির্বাচনের রিটার্ণিং অফিসার ও জেলা জৈষ্ঠ নির্বাচন কর্মকতা রবিউল আলম বলেন, সকলের অংশগ্রহণে সুন্দর নির্বাচন আমরা উপহার দিতে পেরেছি।

নোয়াখালী পুলিশ সুপার মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে, আমরা সফল হয়েছি। এ জন্য ভোটারদেরও সহযোগিতা ছিলো। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আমরা নোয়াখালী পৌরসভায় দিতে পেরেছি এটি আমাদের সফলতা।

নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা য়ায়, নোয়াখালী পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের ৩৪টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে মেয়র পদে ৭, কাউন্সিলর পদে ৬৩ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ১৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য ৭৫০ জন পুলিশ, ৪৫০ জন আনসার, ৩ প্লাটুন বিজিবি, ৩ প্লাটুন র‌্যাব, পুলিশের ৪টি মোবাইল টিম, ১ জন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও ৯ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্বে ছিলেন। এ পৌরসভায় মোট ভোটার ৭৫ হাজার ৭”শ ২৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৩৭ হাজার ৪শ ১ জন, নারী ৩৮ হাজার ৩শ ২৫ জন।  


বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর