কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার গোহারুয়ায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ শয্যা সরকারি হাসপাতাল স্থাপিত হলেও জনবল এবং যন্ত্রপাতি সংকটে চিকিৎসা সেবা চালু নেই। হাসপাতালটি উদ্বোধনের ১৭ বছরেও চিকিৎসা সেবার সুফল পায়নি সীমান্ত এলাকার চার উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। দ্রুত হাসপাতালটিতে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সেবা চালুর দাবি স্থানীয়দের।
সূত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালের ১৫ এপ্রিল নাঙ্গলকোট উপজেলার জোড্ডা পশ্চিম ইউনিয়নের গোহারুয়া গ্রামে ২০ শয্যা হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। উপজেলার দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে হাসপাতালটির অবস্থান হওয়ায় নাঙ্গলকোট, সোনাইমুড়ি, মনোহরগঞ্জ ও সেনবাগ উপজেলার সীমান্ত এলাকার লক্ষাধিক মানুষ এ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার আশায় প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকে।
দুই বছর পর ২০০৬ সালের ১৩ জুন গোহারুয়া ২০ শয্যা হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ওই বছরের ১৭ অক্টোবর জনবল নিয়োগ না করেই তৎকালীন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী আমান উল্লাহ আমান হাসপাতালটির বহিঃবিভাগ উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের প্রায় দুই মাসের মধ্যে জনবল সংকট ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে হাসপাতালটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কেটে যায় বছরের পর বছর। দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় হাসপাতাল এলাকা ঝোঁপ জঙ্গলে ছেয়ে যায়। হাসপাতালের চারদিকে সীমানা প্রাচীর না থাকায় গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়।
২০১৪ সালের ৪ জুন হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করার জন্য কুমিল্লা জেলা তৎকালীন সিভিল সার্জন মুজিবুর রহমান স্বাস্থ্য সচিবের কাছে চিঠি দেন। ওই চিঠিতে জনবল নিয়োগসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে চিকিৎসকের ছয়টি এবং নার্স ও কর্মচারীর ছয়টি পদ অনুমোদন দেওয়া হয়। বিভিন্ন পদে আরও জনবল প্রয়োজন থাকলেও নিয়োগ দেয়া হয়নি। রোগীদের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও সরবরাহ করা হয়নি। আন্তঃবিভাগে চিকিৎসার জন্য ছিল না কোন শয্যা। সংকট আর সমস্যা থেকেই যায়।
সরকারি চিকিৎসা বঞ্চিত এলাকাবাসীর কথা বিবেচনায় নিয়ে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম হাসপাতালটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে চালু করতে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে অনুরোধ করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ওই বছরের ২২ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. দ্বীন মোহাম্মদ নুরুল হকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল হাসপাতালটি পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্টদের চিকিৎসা সেবা চালুর নির্দেশ দেয়। ওই সময় স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী শওকত মহীবুর রব হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করার জন্য ২ কোটি ৫৪ লাখ ৭৫ হাজার ৬০১ টাকা বরাদ্দ চান। কিন্তু ওই বরাদ্দ না দেয়ায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন সমস্যা থেকে যায়।
নানা সংকট ও সমস্যার মাঝে ২০১৫ সালের ৫ নভেম্বর পুনরায় হাসপাতালটি উদ্বোধন করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক ডা. আলাউদ্দিন মজুমদার, চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহকারী পরিচালক ডা. মোহাম্মদ সালাউদ্দিন ও কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মজিবুর রহমান হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন।
দ্বিতীয় দফায় হাসপাতালের বহিঃবিভাগ উদ্বোধন করা হলেও চিকিৎসা সেবার চিত্র ছিল বেহাল। চিকিৎসক ও নার্সরা তাদের খেয়াল খুশিমতো আসতো আর যেতো। ছিল না প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। নিয়োগপ্রাপ্ত ২/১জন চিকিৎসক তাদের সুযোগ-সুবিধা মতো আসলেও ধীরে ধীরে তারাও আসা বন্ধ করে দেন। এরপর থেকে একজন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার (সেকমো) ও একজন ওয়ার্ডবয় দিয়ে সপ্তাহে ২/৩দিন নামেমাত্র চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়।
এরই মধ্যে ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রী, স্বাস্থ্যসচিব, স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক গোহারুয়া ২০ শয্যা হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। ওই সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাসপাতালটি পুরোদমে চালু করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেন। চাহিদাপত্র পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত পূরণ না হওয়ায় হাসপাতালটি আর চালু করা সম্ভব হয়নি।
সূত্র জানায়, সর্বশেষ ২০২০ সালের জুন মাসে তিনজন ডাক্তার, তিনজন নার্স, একজন ওয়ার্ডবয় ও একজন অফিস সহকারীকে পদায়ন করা হয়। বর্তমানে সেখানে আউটডোরে সেবা দিচ্ছেন মাত্র একজন ডাক্তার। তবে ইনডোর সেবা দেওয়ার জন্য এখনো কোনো শয্যা স্থাপন করা হয়নি হাসপাতালটিতে।
বর্তমানে তিনজন চিকিৎসক ও তিন নার্সের নিয়োগ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে হাসপাতালে না গিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সময় দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। মাঝে-মধ্যে সেবা দিতে এলেও ঘণ্টাখানেক থেকে চলে যান তারা। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। তবে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের দাবি, নিরাপত্তাজনিত কারণেই চিকিৎসকরা সেখানে অবস্থান করেন না। তবে চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রেখেছেন।
গোহারুয়া ২০ শয্যা হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সেবা চালু না হওয়ায় এলাকার মানুষকে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে নাঙ্গলকোট, লাকসাম ও কুমিল্লায় যেতে হয়। এতে অর্থ ও সময় দুটোই ব্যয় হয়। হাতের নাগালে সরকারি-বেসরকারি বিকল্প কোন চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান না থাকায় ওই এলাকার রোগীদের দূর-দূরান্তের হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা সেবা নিতে হয়। অনেক সময় মুমূর্ষু রোগীদের বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণের ঘটনাও ঘটে।
প্রতিষ্ঠার ১৭ বছরেও হাসপাতালটিতে চিকিৎসা সেবার সুফল না পাওয়ায় এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। সীমান্ত এলাকার চার উপজেলার মানুষের সুচিকিৎসা নিশ্চিতের লক্ষ্যে দ্রুত হাসপাতালটির আন্তঃবিভাগ ও বহিঃবিভাগ চালু করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
জানা যায়, সীমানা প্রাচীর না থাকায় হাসপাতালের সামনে গরু-ছাগল চরতে দেখা দেখা যায়। হাসপাতালের ভবনগুলো ঝোঁপ জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। যেন ভুতুড়ে পরিবেশ। বৈদ্যুতিক সুইচ-মিটারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। হাসপাতালের ভবনের প্রধান ফটকে নেই তালা। গেট ভেঙে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে ভবনটিও। নষ্ট হয়ে গেছে ভেতরের আসবাবপত্র।
গোহারুয়া গ্রামের এনামুল হক ভূঁইয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নাঙ্গলকোটের সীমান্ত এলাকায় গোহারুয়া হাসপাতালটি স্থাপিত হওয়ায় চার উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ সহজে প্রত্যাশিত চিকিৎসা সেবা পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী ছিল। কিন্তু দুই দফায় হাসপাতালটির বহিঃবিভাগ চালু হলেও জোড়াতালি দিয়ে চিকিৎসা সেবা অল্প কিছুদিন স্থায়ী ছিল। এলাকাবাসীর সুচিকিৎসা নিশ্চিতে দ্রুত হাসপাতালটিতে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সেবা চালুর দাবি জানান তিনি।
নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. দেবদাস দেব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, হাসপাতালটির সীমানা প্রাচীর না থাকায় নিরাপত্তার বিষয়টি বড় ধরনের একটি সমস্যা। হাসপাতালটি উদ্বোধনের পর থেকে এখনো আন্তঃবিভাগ চালু হয়নি। তবে বহিঃবিভাগ চালু রয়েছে বলে তিনি জানান।
কুমিল্লা জেলা ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. নিসর্গ মেরাজ চৌধুরী হাসপাতালটিতে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সেবা চালু করার উদ্যোগ অব্যাহত আছে জানিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চিকিৎসকের পদায়ন এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় শতভাগ চিকিৎসা সেবা চালু করতে বিলম্ব হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা সেবা চালুর জন্য প্রয়োজনীয় জনবল, সরঞ্জাম এবং অর্থ বরাদ্দসহ সব চাহিদা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে পাঠানো হয়েছে।
বহির্বিভাগে স্বাস্থ্য সেবার দায়িত্বে যারা আছেন তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন কিনা সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কেউ অবহেলা করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা