অনিল বাবু। এই নামটা একটা বাহির বাড়ির গেটের দেয়ালে খোদাই করে লেখা আছে। বাড়িটা অনেক পুরোনো। ১৭৭৭ খ্রি.। এই বাড়িটা জমিদারের বাড়ি। এই বাড়িতে এখন আর কেউ থাকে না। অনিল বাবুর বংশধর বলতে এখানে কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। এখানে তিনি কিছু নিদর্শন রেখে গেছেন। হয়তো তিনি জানতেন হায়াতের দড়িয়াই কেউ বেঁচে থাকতে আসে না। বেঁচে থাকবে তার আদিপত্য, তার দৃষ্টি কালসার। বেঁচে থাকবে তার জমিদার ও জমিদারি। তার নির্মিত তার রক্ষিত কিছু কারুকার্য। এই বাড়িটা অন্য অন্য জমিদার বাড়ির চাইতে অন্যরকম। বাড়ির বাহিরে একটা গেট করা আছে। গেটের যে কারুকার্য আছে বর্তমান কোনো আর্কিটেক্স এটা আর্টিস করতে পারেনি। কোনো ডিজাইন মিস্ত্রির ধারণার বাইরে। এই গেটের কল্পনা করতে বা এর যে নকশা এখানে স্থাপন করা হয়েছে, বসানো হয়েছে তা আজ পর্যন্ত এর কোনো নকল গেট কেউ তৈরি করতে পারেনি। আর পারবে বলেও কেউ আশা করে না। এখানে এই গেটে মোট আটটি পিলার আছে। আর আটটি পিলার তৈরি হয়েছে শ্বেতপাথর দিয়ে। অবশ্য শ্বেতপাথরগুলো প্লাস্টারের সঙ্গে মসৃণ করে পিলারের সঙ্গে লাগানো হয়েছে। নির্মাণশৈলী দেখে মনে হবে চুনসুরকি দিয়ে নির্মাণ হয়নি শুধু শ্বেতপাথর দিয়ে তৈরি। আসলে শ্বেতপাথর দিয়ে বাইরে লেপন দেওয়া হয়েছে। নির্মাণ হয়েছে শুধু পাথর দিয়ে। গেটের ওপরে দুটি বাঘ আছে। এখনো আছে। তবে অনেকটা দরপতন ঘটেছে। কালার উঠে ডিসকালার হয়েছে। তবে এই বাঘ বনের বাঘের মতো না। গেটের উত্তরে ও দক্ষিণে দুই হাতির শুঁড় আঁকা আছে। দেয়ালের গায়ে আছে ময়ূরের ছবি। এরপর গেট পার হয়ে ভিতরে ঢুকে তো আপনি অবাক হবেন। বিশাল বাগান। ফুলের বাগান ছিল বলে মনে হয়। এখন আগাছায় ভরে গেছে। বড় বড় দেবদারু গাছ পুরো জায়গাজুড়ে ঘিরে আছে। এই দেবদারু গাছের ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে অনিল বাবুর সখের সেই নিদর্শন। যেমন রয়েছে গরুর গাড়ি ঘোড়ার গাড়ি চার বিহারির পালকি। মহিষের গাড়ি ছাড়াও আরও রয়েছে মাটি দিয়ে তৈরি বক, শালিক, কবুতর, রাজহাস, পাতিহাস, চিল, কাক, বাজপাখি, দোয়েল-এরকম বেশ কয়েক রকমের পাখির ছবি বানানো আছে। তার নিদর্শন পাওয়া যায়। এর বাড়ির ভিতর যে যে রুমগুলো আছে, দেখার মতো। একটা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢোকা যায়। ভিতরে ঢুকলে একটা রুম থেকে আরেকটা রুম দেখলে দেখা শেষ হবে না। কোনো রুম দিয়ে প্রথমে ঢুকে পড়েছেন তা নমুনা আপনি পাবেন না। ঢোকা যত সহজ বাহির হওয়া তত সহজ নয়। তবে অনিল বাবু প্রতিটি দরজার সঙ্গে এক একটা নিদর্শন এঁকে রেখেছিলেন। যাতে কোনো মানুষ হারিয়ে না যায়। প্রতিটি দরজার সঙ্গে একটা করে পাখির ছবি খোদায় করে আঁকানো আছে। অনিল বাবু সেই সময়ে তার রাজপ্রাসাদ কেন বানিয়েছিল তার নমুনা হিসেবে একটা আলমারি বানিয়েছিলেন। সেখানে নির্মাণশৈলী হিসেবে কত সালে রাজপ্রাসাদ বানিয়েছিলেন, কত সালে রাজপ্রাসাদ নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল, কত জন লেবার মিস্ত্রি সেই নির্মাণকাজ করতে লেগেছিল-তার হিসাব তিনি তার নির্মাণ ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন। কত মাল মেটিরিয়াল লেগেছে তার দাম কত তা লেখা আছে। এখানে কোন আর্টিসম্যান এ রাজপ্রাসাদ আর্টিস করেছিলেন তার নাম লেখা আছে। কত দিন পর্যন্ত এই রাজপ্রাসাদে বানানো সময় লেগেছে। কত মিস্ত্রি কত লেভার লেগেছে, তাও লেখা আছে। এই অনিল বাবু তার জীবন ডায়েরিতে লিখে গেছেন। মানুষের মনোরঞ্জনে এই রাজপ্রাসাদ উপহার হিসেবে রেখে গেলাম। আমি থাকব না কিন্তু আমার রাজপ্রাসাদ থাকবে। এই রাজপ্রাসাদ বলে দেবে ওমুক এলাকায় অনিল বাবু নামে একজন লোক ছিল তিনি তার জীবদ্দশায় মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য রাজপ্রাসাদ বানিয়ে রেখেছেন। সত্যিই তার আজ এই রাজপ্রাসাদ মানুষের বিনোদন কেন্দ্রে হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই রাজপ্রাসাদে অনেক জিনিসপত্র আছে কেউ হাত দেয় না। প্রতিটি স্তরে লেখা আছে, দেখবেন হাত দেবেন না।