এক ছিল ছোট্ট মেয়ে। নাম তার তনিমা। তার ছিল সব কিছুতেই কৌততূহল। তার চোখগুলো সরোবরের মতো নীল আর মেঘের মতো কালো চুল। তনিমার গ্রাম ছিল বিশাল, গহিন বনের কোলঘেঁষে। সেই বনকে সবাই ভয় পেত, বিশেষ করে তার গভীরে লুকিয়ে থাকা ডাকিনী বুড়ির জন্য। লোকে তাকে ‘মায়াবুড়ি’ নামেই জানত, কারণ, বুড়ি নাকি তার আস্তানায় বসে রং মিশিয়ে নানা মায়াজাল তৈরি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করত। তারপর ঘাড় মটকে হাড়গোড় নিয়ে যেত।
এক দিন তনিমা খেলতে খেলতে সাথীদের ফেলে একাই অনেক দূর চলে গেল। তার বাবা-মা তাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে কাঁদতে লাগল। চলতে চলতে তনিমা বনের ভিতর চলে এলো। যতই সামনে যায় ততই দেখে বনের সবকিছু কেমন বিবর্ণ, আর প্রাণহীন পাখিরাও সব রংহীন। হয় সাদা নয় ধূসর। হঠাৎ একটি সাদা ফুল দেখতে পেল। ফুলের পাপড়িগুলো মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করছে, আর তার মাঝে বসা ঝলমলে এক সাদা পরী। পরীটির নাম পুষ্পা, সে হলো ফুলের রং আর সুরক্ষার দেবী। পরী খুব বিমর্ষ, যেন মনে কোনো সুখ নেই।
তনিমাকে দেখে পুষ্পা মৃদু হেসে বলল, তুমি কি পথ হারিয়ে এখানে এসেছো? এই ভয়ংকর জায়গায় কেন এলে?
তনিমা মাথা নেড়ে বলল, না, আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি। এসেই তোমাকে দেখেছি, তুমি কত সুন্দর! কিন্তু সবাই বলে এই বনের গভীরে গেলেই বিপদ, ওখানে নাকি মায়াডাইনি থাকে?
পুষ্পার মুখ বিষণ্ন হলো। ডানা ঝাপটে বলল, হ্যাঁ, মায়াবুড়ি এই বনের সব রং চুরি করে নেয়। আমার সব ভাই-বোন বনের পশুপাখি, জীবজন্তু গাছপালা, নদী সবার রং নিয়ে যায়। আর জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। রংহীন হতে হতে একসময় ওরা মরে যায়। তার হাঁড়িতে যত রং জমা হয়, বন ততই ধূসর আর প্রাণশূন্য হতে থাকে।
তনিমার কষ্ট হতে লাগল। সে বলল, আমরা কি কিছু করতে পারি না? আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই!
পুষ্পা বলল, বুড়ির আস্তানায়? জাদুকরী একটি হাঁড়িতে চুরি করা সব রং রাখা আছে। হাঁড়ি ভাঙতে পারলে সব রং আবার বনের পাখি, ফুল আর পাতায় ফিরে আসবে।
তনিমা বলল, মায়াবুড়ির আস্তানা তুমি জানো কোথায়?
পুষ্পা বলল, জানি।
সাহসী তনিমা আর পুষ্পা তখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই গহিন অরণ্যের দিকে যাত্রা করল। পথ আঁকাবাঁকা, কাঁটা আর মাকড়সার জালে ভরা। গাছের পাতাগুলো আরও বিবর্ণ, যেন প্রাণহীন। অনেকক্ষণ হাঁটার পর তারা এক অন্ধকার নিচু ঢালে পৌঁছাল। সেখানে গাছের ডালপালাগুলো কুঁচকুঁচে কালো, আর বাতাস ভারী। এটাই বুড়ি মায়াপুরী আস্তানা। এক বিশাল, পুরোনো কালো কুঁড়েঘর। ভিতরে নানা ধরনের জাদুকরী সরঞ্জাম, হাড়গোড় আর বুড়ির সেই রঙের হাঁড়ি।
তনিমা আর পুষ্পা চুপিসারে ঘরে ঢুকল। বুড়ি তখন টেবিলের পাশে বসে একটি ফ্যাকাশে পাতার ওপর কালো রং মেশাচ্ছিল। এই ফাঁকে পুষ্পা তার ক্ষুদ্র জাদু দিয়ে বুড়ির চোখ ধাঁধিয়ে দিল। বুড়ি চিৎকার করে উঠল।
এই সুযোগে তনিমা লাফিয়ে উঠে বুড়ির টেবিলের ওপর রাখা সেই রঙের হাঁড়িটিতে একটা জাদুর হাড় নিয়ে সজোরে আঘাত করল। হাঁড়ি ভেঙে চুরমার হতেই, মুহূর্তেই হাজার হাজার উজ্জ্বল রং এর ঘূর্ণী কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে ঝরনার মতো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ সব রং আলোর বেগে বনের দিকে ছুটল। বুড়ি রঙের ঝলকে হতভম্ব হয়ে গেল। তার সব জাদু আর শক্তি সেই রঙে ভরা ছিল। রং চলে যাওয়ায় বুড়ি দুর্বল হয়ে একটা ছায়ায় পরিণত হলো এবং ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।
দেখতে দেখতে গহিন অরণ্য আবার প্রাণ ফিরে পেল। ধূসর পাতাগুলো গাঢ় সবুজ হলো, ফুলেরা আবার তীব্র রঙে ফুটতে শুরু করল। পুষ্পার ডানায় আবার আগের চেয়েও বেশি দ্যুতি দেখা গেল।
পুষ্পা তনিমার কপালে একটি চুমু এঁকে দিল।
ধন্যবাদ, সাহসী বন্ধু। তুমি শুধু ফুল বাঁচাওনি, তুমি এই বনকে বাঁচিয়েছো।
তনিমা হাসল। সে জানত, ভয় পেলেও সাহস আর ভালোবাসা দিয়ে যে কোনো বিপদ জয় করা যায়। এরপর থেকে তনিমা আর তার বন্ধুরা রোজ সেই বনে যেত, কিন্তু আর ভয় পেত না। সে শুধু তার বন্ধু পুষ্পা আর বনের সেই সুন্দর রংগুলো দেখত, যা সে নিজে রক্ষা করেছিল।