মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০১৪ ০০:০০ টা

মহানবী (সা.)-এর নবুয়ত লাভ

মাওলানা মুহম্মাদ আশরাফ আলী

মহানবী (সা.)-এর নবুয়ত লাভ

মানবতার মুক্তিদূত হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল জন্মগ্রহণ করেন। খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ অধ্যাপক কে. আলী লিখেছেন, "৪০ বছর বয়সে হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুয়তপ্রাপ্ত হন (৬১০ খ্রি.) এবং হেরা পর্বতের গুহায় তার কাছে প্রথম অহি নাজেল হয়। প্রথম প্রত্যাদেশ প্রাপ্তির পর তিনি গভীরভাবে বিচলিত হয়ে পড়লেন। কম্পিত ও ভীত-সন্ত্রস্ত হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্ত্রী বিবি খাদিজাকে (রা.) সব ঘটনা বর্ণনা করলেন। ঘটনা শ্রবণের পর পবিত্রতা রমণী খাদিজা (রা.) বুঝতে পারলেন যে, তার স্বামীর ওপর মহান সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ বর্ষিত হয়েছে। তিনি তাকে সাহস ও উৎসাহ দান করলেন। অতঃপর তিনি তার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা-বিন-নওফেলের কাছে এ সংবাদ পেঁৗছালেন। ওয়ারাকা ছিলেন তৎকালীন আরব বিশ্বের প্রখ্যাত পণ্ডিত। ইহুদি ও খ্রিস্টধর্ম সম্বন্ধে তাকে বিশেষজ্ঞ বলে ভাবা হতো। এ ঘটনা শ্রবণে তিনি অভিমত ব্যক্ত করলেন যে, মুসা (আ.) ও ঈসা (আ.) অনুরূপ ঐশীবাণী লাভ করেছিলেন। তাঁর এ উৎসাহসূচক কথাবার্তা ও আশ্বাসের বাণীতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

কোরআন শরিফ অবতীর্ণ হওয়ার কিছু দিন পর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর অহি নাজেল হলো : হে আমার রাসূল, তোমাকে তোমার প্রভু যে সত্য দান করেছেন, তা প্রচার কর। নবুয়ত প্রাপ্তির পর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিপথগামী মক্কাবাসীর কাছে ইসলাম প্রচার করতে শুরু করলেন। তিনি আরবাসীকে পৌত্তলিকতা হতে বিরত হয়ে সত্যধর্ম গ্রহণের দাওয়াত দিয়ে বললেন, 'আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, তিনি স্রষ্টা ও সৃষ্টিকর্তা। তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যুর মাধ্যমে তিনি আবার তা ফিরিয়ে নেন। তার মতো আর কেউ নেই। সর্বপ্রথমে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর অন্তরঙ্গ আত্দীয়-স্বজন ও বন্ধুদের কাছে অত্যন্ত গোপনে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। বিবি খাদিজাই (রা.) প্রথম তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও তাঁর প্রচারিত ধর্ম গ্রহণ করলেন। এর পর যদিও আলী ও জায়েদ ছিলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, কিন্তু আবুবকরই বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে প্রথম তাঁর ধর্মমতকে সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করেছিলেন। শীঘ্রই খাদিজা, আবুবকর, আলী ও যায়েদসহ বিশজন লোক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে দীক্ষা দেন আবুবকর। তারা হলেন পরবর্তীকালে পারস্য বিজেতা সা'দ-বিন-আবি ওয়াক্কাস, যুবাইর ইবনে আল-আওয়াম, ইসলামের তৃতীয় খলিফা ওসমান-বিন-আফফান, পরবর্তীকালে ইসলামের বীর যোদ্ধা তালহা এবং সম্পদশালী ও মহৎ চরিত্রের অধিকারী আবদুর রহমান-বিন-আউফ। আবদুর রহমান আরও চারজন মুসলমানকে ইসলামের পতাকাতলে সমবেত করেন। তাদের মধ্যে সিরিয়া বিজেতা আবু ওবায়দা ইবনে আল-জাররাহও ছিলেন। এসব নবদীক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে যায়েদ ব্যতীত সবাই কুরাইশ বংশের লোক ছিলেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন ক্রীতদাসও ছিলেন, যেমন ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হজরত বেলাল, 'ক্ষুদ্রদেহী অথচ প্রগাঢ় বিশ্বাসী' নামে খ্যাত হজরতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহাবা আবদুল্লাহ-বিন-মাসুদ প্রমুখ।

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো আন্দোলনের নজির নেই যা নারী জাতির সমর্থন, সহানুভূতি ও সহযোগিতা ছাড়া কৃতকার্যতা লাভ করেছে। ইসলামের ক্ষেত্রেও এর সত্যতা প্রমাণিত হয়। কিন্তু সমকালীন আরবের প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদের ভূমিকা ছিল নিতান্ত গৌণ; শুধু নীরব সমর্থন ও উৎসাহ প্রদান ব্যতীত তাদের অন্য কিছু করণীয় ছিল না। ইসলামের প্রথম দিকে নব দীক্ষিত নারীদের গৌণ ভূমিকাও অবহেলার বিষয় ছিল না। স্ত্রী-কন্যাদের সমর্থন, উৎসাহ ও উপদেশ লাভের ফলে অনেক পুরুষ ইসলামের ন্যায়নীতি এবং ধর্মীয় ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছিল। সুতরাং এসব নারীর অবদান ইসলামের ইতিহাসে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

নবুয়ত লাভের তিন বছর পরে (৬১৩ খ্রি.) হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করার জন্য অহী পেলেন : 'এবং তুমি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের আত্দীয়-স্বজনদের নিকট পাপ ও আল্লাহদ্রোহিতার অবশ্যম্ভাবী ফল সম্বন্ধে সতর্ক করে দাও।' অতঃপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকাশ্যে সাফা পাহাড়ের পাদদেশে একটি সম্মেলন আহ্বান করলেন এবং পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, 'হে কুরাইশগণ তোমরা একত্রিত হও, হে কুরাইশগণ তোমরা একত্রিত হও। আল-আমিনের এ ঘোষণায় কুরাইশরা জাতির সম্মুখে আসন্ন বিপদ ঘনায়মান ভেবে পাহাড়ের পাদদেশে সমবেত হলো এবং তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো- ব্যাপার কি? তিনি তখন বললেন, 'আপনারা একটা কথা বিবেচনা করুন, যদি আমি আপনাদের বলি- এ পাহাড়ের পেছনে একদল শত্রু আপনাদের আক্রমণ করার জন্য অপেক্ষা করছে, আপনারা কি আমাকে বিশ্বাস করবেন? তারা বলল, হ্যাঁ, কেননা আপনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি সারা জীবনে একটাও মিথ্যা কথা বলেননি।'

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'আমি আপনাদের কঠিন শাস্তির সতর্ককারী, হে আবদুল মুত্তালিব বংশ, হে আবদুল মান্নাফ বংশ, হে জোহরা গোত্র, হে হাইয়েফ গোত্র, হে মাখজুন গোত্র, হে আসাদ গোত্র, আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছেন- আমি যেন আমার নিকট ও দূর আত্দীয়-স্বজনদের সতর্ক করি। আমি এর জন্য আপনাদের নিকট হতে কি ইহজীবনে, কি পরজীবনে কোনোরূপ লাভ কামনা করিনি। আমি শুধু আপনাদের বলতে চাই- 'আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। হজরতের চাচা আবু লাহাব বলল, 'আজ তুমি ধ্বংস হও। তুমি কি এ জন্যই আমাদের এখানে ডেকেছিলে?'

আবু লাহাবের এ অভিশাপ উচ্চারণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনে অত্যন্ত আঘাত পেলেন। তিনি মুখে কোনো কিছু না বললেও তার পবিত্র মুখের ওপর চরম বিরক্তির ছাপ ফুটে ওঠে। কিন্তু আল্লাহ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ধ্বংস করলেন না। ধ্বংস করলেন, অভিশাপ দিলেন সেই আবু লাহাবকে, আর হজরতকে চরম সান্ত্বনা দিলেন। ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর বাণী সঙ্গে নিয়ে হাজির হলেন-

'আবু লাহাবের দুই হাত ধ্বংস হোক এবং সেও ধ্বংস হোক। তার ধন-সম্পদ এবং সে যা অর্জন করেছে তা তার কোনোই কাজে আসবে না। অচিরেই সে লেলিহান অগ্নিতে প্রবেশ করবে।' আল-কোরআন (১১১১ : ১-৩)।

এ ঘটনার পর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর একাত্দবাদের মাহাত্দ্য সম্বন্ধে এক হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা দেন। সাম্য, মৈত্রী ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তিনি সবাইকে ইসলাম কবুল করতে অনুরোধ করেন। পরবর্তী চার বছর প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের ফলে নবদীক্ষিতদের সংখ্যা বেড়ে গেল। মক্কার অনেক লোক ওই সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। তাদের অনেকেই ইসলামের পরবর্তী ইতিহাসে খুব প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে পরবর্তীতে মদিনায় হিজরত এবং সেখানে দুনিয়ার প্রথম কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়। মক্কা জয় করে ইসলাম আরব ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। মানব ইতিহাসে ইসলাম যে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করেছে তার কোনো তুলনা নেই।।

 

 

সর্বশেষ খবর