শনিবার, ১৮ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফের মন্তব্য ও জাতীয় ঐক্য

স্বপন দাশগুপ্ত

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের সাম্প্রতিক বক্তব্য গণতন্ত্রমনা মানুষকে ব্যথিত করেছে।  এক সময়ের গণতান্ত্রিক রাজনীতির একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে এ বক্তব্য আমাকেও হতাশ করেছে। তিনি ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ‘হঠকারী রাজনীতি’ সম্পর্কে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ আহ্বানের সময় জাসদ সৃষ্টি এবং এর রাজনীতি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন তিনি। সৈয়দ আশরাফের এ ধরনের মন্তব্য আজকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যথাযথ কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ১৪ দলের অন্যতম শরিক দল জাসদ। দেশে যখন সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়োজন, তখন সৈয়দ আশরাফের এ বক্তব্য আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্তের প্রতি চ্যালেঞ্জ। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়োজনে ৯০ দশক থেকে আওয়ামী লীগ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলে। ১৯৯৬ সালের পর আওয়ামী লীগ প্রথম জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করে। ওই সরকারে জাসদ অংশীদার ছিল। পরবর্তী সময়ে তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ ও ২০১৪ সালের সরকারে জাসদসহ বিভিন্ন দলকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় ঐক্যের জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার সিদ্ধান্তের কারণে সমমনা রাজনৈতিক দল নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছে। প্রথমে ৮ দল, ৭ দল ও ৫ দলীয় জোট গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৫ দল ও ৭ দল গঠন করে আন্দোলন চলে আসছিল। বিএনপি ও জামায়াতের সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদের উত্থানের কারণে এই ঐক্য ধীরে ধীরে মজবুত হয়। ২০০৮ সালে নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোট জয়ী হয়। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ এর ক্রমবর্ধমান উত্থানের কারণে জাতীয় ঐক্যের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়নি। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যখন রাজনৈতিক দল, সংগঠন, ব্যক্তির সমন্বয়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা প্রয়োজন, সে সময়ে সৈয়দ আশরাফের এ বক্তব্য বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার বিরোধী কিনা তা একবার ভেবে দেখার অনুরোধ করছি ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদককে। এ বক্তব্য ১৪ দলে বিভক্তির রেখা টেনে দেবে। ১৪ দলে ইস্পাতকঠিন ঐক্যের পরিবর্তে অনৈক্যের সৃষ্টি করবে। ১৪ দলের ঐক্য যেখানে সম্প্রসারিত হওয়ার কথা সেখানে এ ঐক্যে ফাটল ধরবে কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। হঠকারী রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলা এক জিনিস, আর এভাবে ১৪ দলের শরিক কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি সরাসরি আক্রমণ ভিন্ন জিনিস। সৈয়দ আশরাফের দৃষ্টিতে জাসদ হঠকারী রাজনীতি করেছে। কিন্তু ’৭২-এর প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে জাসদ কি সত্যি সত্যিই হঠকারী রাজনীতি করেছে?

মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে তৎকালীন ছাত্রলীগের একাংশের নেতারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের রাজনৈতিক দল ও শক্তি নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন এবং মাও সে তুং এর আলোকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে থাকার অনুরোধ জানিয়েছিল। তিনি জাতীয় সরকার গঠন করবেন কিন্তু তিনি জাতীয় সরকারে থাকবেন না। জাতীয় সরকার তার পরামর্শ ছাড়া কোনো কাজ করতে পারবে না। যে কোনো কারণেই হোক জাতীয় সরকার গঠন করা হয়নি। যদিও পরবর্তী সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশে প্রথমে ত্রিদলীয় ঐক্য জোট এবং পরবর্তী সময়ে বাকশাল গঠন করেছিলেন। কিন্তু ’৭২ সালের ছাত্রলীগের ওই অংশের দাবি অনুযায়ী তিনি যদি তখনই জাতীয় সরকার গঠন করতেন তাহলে প্রেক্ষাপট ভিন্ন হতো বলে ধারণা। ছাত্রলীগের ওই অংশটির নেতা সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাসদ সৃষ্টি হয়। জাসদ সৃষ্টির প্রথম দিকে মরহুম তাজউদ্দীন আহমদ, ড. আলিম আল রাজি, আবদুর রাজ্জাক ও রহমত আলিসহ অনেকের আসার কথা ছিল। কিন্তু তৎকালীন প্রেক্ষাপটে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জনমনে যে আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়েছিল, সেই আকাঙ্ক্ষা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ২২-৩০ বছর পর্যন্ত তরুণরা সেদিন জাসদ প্রতিষ্ঠা করে। মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধা, যারা ছাত্রলীগ করতেন তারাই জাসদকে সৃষ্টি করে। শুরুতে মেজর জলিল ছাড়া ছাত্রলীগের বাইরের কেউ জাসদের নেতৃত্বে যুক্ত ছিলেন না। জাসদ কীভাবে প্রতিষ্ঠা হয় এ ইতিহাস আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত লক্ষ্যসমূহ ১৯৭২ সালের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, ওই লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়ন করাও জাসদের অন্যতম রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। এক কথায় সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এ দেশে বৈষম্যের আবসান হবে এটাই ছিল জনগণের আকাঙ্ক্ষা, এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্যই সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান নিয়ে জাসদের জন্ম হয়।

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সরকারি দল ও বিরোধী দল হলো এক বৃন্তের দুটি ফল। সরকারি দল এবং বিরোধী দল একে অপরের পরিপূরক। বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতি সম্ভব নয়। স্বাধীনতার পর জাসদ গণতান্ত্রিক রাজনীতিই করতে চেয়েছিল। কিন্তু ফ্যাসিস্ট কায়দায় জাসদকে নির্মূল করার জন্য তৎকালীন শ্রমিক নেতা আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে লাল বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনী গঠন এবং রক্ষী বাহিনী সৃষ্টি করা হয়। ওই সময়ে রক্ষী বাহিনী ও এসব বাহিনীর হাতে কত জাসদ নেতা-কর্মী যে জীবন দিয়েছে তার হিসাব দেওয়া আজও কঠিন। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিরোধী দল গঠন ও তার রাজনীতি করার অধিকার আর রইল না। জাসদও বাধ্য হয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেল। জাসদ একটি ভুল রাজনীতির খপ্পরে পড়ে গেল। প্রথম দিকে জাসদ তৎকালীন বামপন্থি রাজনীতির সমালোচনা করে বলেছিল, আমাদের দেশে সশস্ত্র রাজনীতি করার আর্থসামাজিক অবস্থা নেই। অর্থাৎ যারা সশস্ত্র সংগ্রাম করে বিপ্লব করতে চাচ্ছেন, সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি আমাদের দেশে নেই। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক জাসদ সশস্ত্র পথ বেছে নেয়। ভুল রাজনীতির গহ্বরে চলে যায় জাসদ। এর পরিণতিতে জাসদ আজ বহুধা বিভক্ত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য রাজনৈতিক ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছিল জাসদ— মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফের এ বক্তব্য অনেকাংশে সঠিক। কিন্তু জাসদ কখনই বঙ্গবন্ধুর হত্যা চায়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে আওয়ামী লীগের একাংশ। কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একাংশের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে খন্দকার ফারুকের বক্তব্যে তৎকালীন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জড়িত ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে সেই মন্ত্রিসভায় অধিকাংশ মন্ত্রী ছিলেন আওয়ামী লীগের। সৈয়দ আশরাফ এ বিষয়টিও ভেবে দেখবেন।

জাসদের গোপন রাজনীতির সময় কিংবা ১৫ আগস্টের মূল্যায়নের জন্য একাধিক লিফলেট ও বুকলেটে বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জাসদ কোনোভাবেই জড়িত নয় একথা বার বার বলে এসেছে। ওই বুকলেট ও লিফলেটে বলা হয়েছে, ‘ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যা চায়নি জাসদ। তারা গণতান্ত্রিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন চেয়েছে।’ তবে সৈয়দ আশরাফের ভাষায় জাসদ কেন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল তাও ভেবে দেখার অনুরোধ করছি তাকে।

দেশে আজ টার্গেট কিলিং চলছে। সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গি নিয়ে হিন্দু পুরোহিত, আশ্রমের সেবায়েত, খ্রিস্টান দোকানদার, হিন্দু ব্যবসায়ী এমনকি জঙ্গি দমনে দক্ষ পুলিশ অফিসারের স্ত্রীকেও হত্যা করা হচ্ছে। মুক্তমনা ব্লগারও রেহাই পাচ্ছে না। এসব হত্যাকাণ্ড চালিয়ে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চাচ্ছে জঙ্গিরা। ১৯৭১ সালে যেমন আলবদর বাহিনীও একই কায়দায় এদেশের বুদ্ধিজীবী ও স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিকে হত্যা করেছে আজও তাই করা হচ্ছে। দেশের এ অবস্থায় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের রাজনৈতিক দল ও শক্তিসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এ মুহূর্তে এ ধরনের ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করেই জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। কিন্তু তার ঘনিষ্ঠতম ব্যক্তি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফের এ মন্তব্য জাতীয় ঐক্যের মর্মমূলে কুঠারাঘাত করবে। অনৈক্য সৃষ্টি হলে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ আরও শক্তিধর হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির ওপর আঘাত আনার সাহস দেখাবে। দেশে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে যা জাতির জন্য অকল্যাণ বয়ে আনবে।  তাই এ অবস্থায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফের এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া উচিত হয়নি। অসমোচিত মন্তব্য থেকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ হলো আমাদের প্রধান শত্রু। এ প্রধান শত্রুকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করতে হবে।  যে কোনো মূল্যে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হবে।

            লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর