মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

সত্যের কল বাতাসে নড়ে

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

সত্যের কল বাতাসে নড়ে

শুনেছিলাম সত্যের কল বাতাসে নড়ে। শেষ পর্যন্ত দেখছিও তা। সৈয়দ আশরাফ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের একজন উল্লেখযোগ্য নেতা। তখন যেখানে ছিলেন, সেখান থেকে একজন ছাত্রনেতা হিসেবে যা করার ছিল তা তিনি করেছিলেন। বর্তমান রাজনীতিতে একজন নির্বিবাদী ভালো মানুষ হিসেবে তার প্রচুর পরিচিতি। তিনি সেদিন ছাত্রলীগের এক বর্ধিত সভায় জাসদ সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটা তার জীবনের এক শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক মূল্যায়ন হতে পারে। সৎ শিক্ষক তার ছাত্রদের অসৎ বানাবে না। ভ্রষ্টা গুরু হলে শিক্ষার কোনো মূল্য থাকে না। জাসদ সম্পর্কে তার মূল্যায়ন শুধু ছাত্রলীগের জন্য নয়, ভুক্তভোগী সবার জন্য প্রণিধানযোগ্য। আর সেদিনের তার একটি কথাও ন্যায়ের বিচারে অন্যায় নয়। তার নিজেরও নয়, সবই ইতিহাসের কথা, কোটি মানুষের অব্যক্ত যন্ত্রণার প্রকাশ। ওই সময় জাসদ সৃষ্টির মধ্যদিয়ে দেশে যে অস্থিতিশীল অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তা না হলে আজ আমাদের এমন দুর্গতি হতো না। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড আমাদের পিছে ছিল, পিছেই থাকত। ওইসব দেশে আমাদের ছাত্ররা পড়তে যেত না। তাদের ছাত্ররা স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে পড়তে আসত। আমাদের অনুদানে তখন তারা পড়ত। মালয়েশিয়া যেদিন দরিদ্রতার কারণে সিঙ্গাপুরকে ছেড়ে দিয়েছিল, সেদিন সিঙ্গাপুরের প্রাণপুরুষ লিকুইন অঝোরে কেঁদেছিলেন। মালয়েশিয়া তাদের এভাবে ত্যাগ করায় তারা এখন যাবে কোথায়? আজ তারা বোঝা নয়। সিঙ্গাপুর আজ এক সম্পদ। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আমরা এশিয়ায় নয়, বিশ্বসম্পদে পরিণত হতাম। বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে পিছিয়ে পড়েছি। সে ক্ষত মুখে বলার নয়।

তাই জাসদকে হঠকারী দল হিসেবে চিহ্নিত করে ছাত্রলীগের কর্মীদের দূরে থাকতে বলে পরম গুরুর কাজ করেছেন জনাব আশরাফ। জাসদ সরকারে আছে কী নাই, থাকবে কি থাকবে না, এটা বিচার্য নয়। বিচার্য স্বাধীনতার পরপরই জাসদ কী করেছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে সবাই জাসদকে অভিনন্দন জানাবে। আমি মনে করি জাসদ বাংলাদেশে রাজনীতির প্রথম সন্তান। সন্তানটির কর্মকাণ্ড ভালো হলে, রাষ্ট্রের হাত শক্তিশালী করার মানসিকতা থাকলে, জাসদ হতো বাংলাদেশের প্রথম আদর্শ রাজনৈতিক দল। দুর্ভাগ্য, তা হয়নি। বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাসদের জন্ম হয়েছিল এটা জোর দিয়ে বলা যায় না। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানসহ বিশ্বের পরাজিত পরাশক্তি বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি, তারাই ফন্দিফিকির করে নানাভাবে মদদ দিয়ে সে সময় জাসদের সৃষ্টি করেছিল। হয়তো সেই গোপন ষড়যন্ত্র মূল নেতারা অনেকে বুঝতেও পারেননি। জাসদ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রতি জনগণের বিপুল সমর্থন দেখার মতো ছিল। তাদের গাড়ি বাড়ি অর্থবিত্তের অভাব ছিল না। কারণ দুই দিন আগে যারা পরাজিত হয়েছিল, মুসলিম লীগ, জামায়াত অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধী— তারা জাসদের কোলে আশ্রয় নিয়েছিল। কারণ সত্যিকার অর্থেই মুুক্তিযুদ্ধের অনেক মেধাবী জাসদে গিয়েছিল।

অবাক করার বিষয় ছিল জাসদ জন্মের আগে জাসদ ছাত্রলীগের জন্ম হয়েছিল। আর সেই ছাত্রলীগে দেশের সবচেয়ে ভালো ভালো যাদের ক্রিম বলা যেতে পারে এমন ছাত্র-ছাত্রীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তখন আওয়ামী ছাত্রলীগে ছিল যতসব নিস্যার দল। শুধু বঙ্গবন্ধুর জন্য এবং এখন জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য ছাত্রলীগ টিকে আছে। ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়ে একটি পল্টনে অন্যটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলন করে, ভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেই সম্মেলনে শরিক হয়েছিলাম। তারপর জাসদের জন্ম হয় এবং সারা দেশে এক অস্থিতিশীল, অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়। জাসদ আবার শুধু জাসদ থাকেনি। জাসদের গণবাহিনী ছিল প্রধান। যার মূল ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের এক নায়ক কর্নেল তাহের বীরউত্তম। হাসানুল হক ইনু ছিলেন সহকারী প্রধান।  মূলত জাসদের জন্ম হয়েছিল কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তমের শক্তি, সামর্থ্য আর তার উদ্দীপনায়। জাসদের প্রধান অংশ জঙ্গি তত্পরতায় লিপ্ত হওয়ার প্রধান ব্যক্তিও ছিলেন তিনি। বয়স হয়ে গেছে, কবে চলে যাব হলফ করে বলতে পারি না। মানুষের জীবনে এক শ্বাসের বিশ্বাস নেই। তাই বুকের ভিতর গুমড়ে মরা বেদনা আর ধরে রাখতে পারছি না। আজ আমি যেখানে যে অবস্থায়ই থাকি, দুই চোখ ভরে হৃদয় উজাড় করে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, হৃদয়ঙ্গম করেছি। মুক্তিযুদ্ধ করেছি, দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধের আনন্দ-বেদনা হৃদয়ে ধারণ করেছি। তাই মুক্তিযুদ্ধের সব কৃতিত্বই যে পাকিস্তানি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সশস্ত্র ব্যক্তিদের, সেটায় মন সায় দিতে চায় না, কেন যেন বড় বেশি বিদ্রোহ করতে চায়। মুক্তিযুদ্ধ সময়ের পাকিস্তান সরকারের বাঙালি সামরিক-বেসামরিক কর্মচারীরা যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল তারা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে। অন্যদিকে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা— যাদের রক্তে পাকিস্তান হানাদাররা ভেসে গেছে তারা সত্মায়ের সন্তানের মতো অবহেলিত হয়েছে। পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ পাওয়া ৪-৫ হাজার সশস্ত্র লোক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। বীরত্বসূচক খেতাবের শতকরা ৯৫টি তাদের দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষেত্রে জাসদের প্রাণপুরুষ, মূল শক্তি কর্নেল তাহের সবচেয়ে ভাগ্যবান। জিয়াউর রহমানের সামরিক আদালতে তাকে ফাঁসি দেওয়া কোনোমতেই সমর্থন করি না। কিন্তু আজ যদি কেউ বর্তমান সরকারকে উত্খাতের চেষ্টা করে ধরা পড়ে, তাহলে তাকেও চুমু খাওয়া হবে না, ফাঁসি দেওয়া হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতা একটা মারাত্মক জিনিস। ক্ষমতায় যে যখন থাকে সে তার বাইরে আর অন্যকিছু দেখে না, বিবেচনা করে না। ক্ষমতাই সেখানে মুখ্য হয়ে দেখা দেয়। এই জল্লাদি ক্ষমতার হাত থেকে মানবিক সহনশীল ক্ষমতা পরিচালনার জন্যই গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক কাঠামো। সে জন্য গণতন্ত্রে খুন খারাবির জায়গা নেই। গণতন্ত্রে মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার জায়গা। যদিও সেদিকটাও বর্তমানে একেবারে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে। তবুও চেষ্টা করলে এখনো মানুষের নিরাপত্তাসহ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা যেতে পারে।

ভাগ্যবান কর্নেল তাহেরের কথা বলি। ভদ্রলোক আগস্টের দিকে সপরিবারে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়েছিলেন। একজন নিখাদ মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধা নেতা হিসেবে যুদ্ধকালীন তার কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল তেমনটা এখনো আমি খুঁজে পাই না। একজন দলপতি হিসেবে কামালপুর পাকিস্তানি হানাদার ঘাঁটি পতনের প্রত্যক্ষ যুদ্ধে তিনি আঘাত পেয়ে পা হারান। স্বাধীনতার পর এক পা হারা কর্নেল তাহেরকে কখনো হীনবল মনে হয়নি। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি সব সময় আমার মাথার মুকুট। প্রশ্নটা হলো স্বাধীন দেশ, যে সরকারের নেতৃত্বে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি তার পতন ঘটানোর জন্য প্রকাশ্য ও গুপ্তহত্যার আশ্রয় নেওয়া অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক ছিল। কর্নেল তাহেরকে ভাগ্যবান বলেছি এ জন্য, তিনি যথার্থই বীরউত্তম খেতাব পেয়েছেন। তার ভাই ইউসুফ বীরবিক্রম পেয়েছেন। আরেক ভাই ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীরপ্রতীক। শুনেছিলাম তার কোনো বোনও নাকি খেতাব পেয়েছেন। আবার তাদের কারও কারও নাম খেতাবের তালিকায় নাকি দুই জায়গায় আছে। দুইবার বীরপ্রতীক অথবা বীরবিক্রম। ভাগ্য বলে কাকে। যুদ্ধ আমিও করেছি। আমার হাজার হাজার যোদ্ধা যুদ্ধ করেছে, প্রাণ দিয়েছে, অধিকাংশ যুদ্ধে জয়লাভ করেছে। সে যুদ্ধগুলো নিরাপদ সীমান্তে থেকে নয়, একেবারে হানাদারদের পেটের মধ্যে থেকে করতে হয়েছে। তাই বয়স হয়েছে, একটু তো বুকে বাজেই। বুকের ভিতর গুমড়ে মরা সত্যগুলো প্রকাশ না করে এখন আর স্বস্তি পাই না।

আমাদের আরেক বীরউত্তম এয়ার মার্শাল একে খন্দকার তাকে নাকি খেতাব প্রদান কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বসূচক খেতাব প্রদানের কমিটিতে ভদ্রলোকেরা সশস্ত্র বাহিনীর ৩-৪ জন ছিলেন। খেতাবগুলো তারাই ভাগাভাগি করে নিয়েছেন যার একটা তিনিও নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বসূচক খেতাব প্রদানের ক্রাইটেরিয়া অনুসারে একে খন্দকারের কোনোমতেই বীরউত্তম তো দূরের কথা, কোনো খেতাবই পেতে পারেন না। তিনি খেতাবের জন্য বিবেচিতই হতে পারেন না। কারণ তিনি কোনো সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। খেতাবের প্রধান শর্তই ছিল সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং সাহসীকতার। যিনি কোনো যুদ্ধে অংশই নেননি, তিনি কী করে খেতাব পাবেন? তাহলে তো মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক আতাউল গনি ওসমানীকে শ্রেষ্ঠ খেতাব দেওয়া উচিত ছিল। কেন রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সরকারপ্রধান বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ খেতাব পেলেন না? আত্মসমর্পণের দিন একে খন্দকারকে কলকাতা নিউ মার্কেট থেকে ধরে আনা হয়েছিল। তাই বিষয়গুলো কেন যেন খুব ভাবিয়ে তুলে। আমি পুরো পরিবার নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। স্বাধীনতার পর আমার পরিবারের কেউ ভারতের হাইকমিশনার সমর সেনকে জিম্মি করতে হাইকমিশন ভবন আক্রমণ করেনি। সেই আক্রমণের মূল হোতা ছিলেন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ঢাকা মহানগরের গণবাহিনীর কমান্ডার। হায়রে কপাল! তিনি আজ বড় বেশি আওয়ামীপ্রেমী। ছোট ভাই ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল বীরপ্রতীক এমপি। তিনিও পায়ে পায়ে তাল রেখে সব কয়টি অঘটনে প্রথম সারিতে ছিলেন। আজ তারাই বর্তমান সরকারের সর্বে সর্বা।

কয়েক মাস আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন তাকে ছাড়া আওয়ামী লীগের সবাইকে কেনা যায়। প্রথম অবস্থায় তার কথায় মনটা বেশ খারাপ হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখছি তার কথাই ঠিক। কেনা যায় কিনা জানি না কিন্তু সবাই চায় জননেত্রীর বা সরকারের পতন হোক! তা না হলে রিমান্ডের আসামি হাতে হ্যান্ডকাফ থাকা অবস্থায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত, এটা কোনো কাজের কথা? নকল আসামিদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের মহড়া দেওয়া যত সোজা, প্রকৃত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কখনো বন্দুকযুদ্ধ করতে হলে সেদিন পুলিশ কোনো পার পাবে না। সাজানো নাটক আর প্রকৃত যুদ্ধ সেটা যত ছোটই হোক এক কথা নয়। সময় থাকতে রাষ্ট্রের স্বার্থে বাঙালি জাতির স্বার্থে যাদের হাতে এখন নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব তাদের ব্যাপারটা ভেবে দেখতে অনুরোধ জানাচ্ছি।

বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যেসব হত্যাগুপ্ত হত্যার মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে জাসদ গণবাহিনীর দ্বারা তার  চেয়ে হাজার গুণ বেশি অরাজকতার মাধ্যমে সরকার পতনের চেষ্টা হয়েছিল। অনেকে বলছেন গুপ্তহত্যা করে সরকারের পতন ঘটানো যাবে না। তখনো এমনটাই বলা হয়েছিল। তবে তখন সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিরোধিতা ছিল প্রবল। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক নেতৃত্ব কেউ মেনে নিতে চায়নি। কিসিঞ্জার বলেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা তার কূটনৈতিক পরাজয়। সৌদি আরবসহ অধিকাংশ আরব দেশ বিরুদ্ধে ছিল। গণচীন আজ বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারাও পক্ষে ছিল না। যেভাবে সম্ভব বঙ্গবন্ধুর সরকারের পতন ঘটাতে তারা প্রায় সবাই ছিল বদ্ধপরিকর। এই ক্ষেত্রে স্বার্থগত কারণে বর্তমান সরকারের ওপর এসব খুন-খারাবিতে কতটা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বা চাপ আছে হলফ করে বলতে পারব না। যদিও নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কিছু কিছু আন্তর্জাতিক শক্তি না ঘরকা, না ঘাটকা অবস্থায়। তবে এটা ঠিক তারা কেউ তীব্র সরকারবিরোধী নয়। গোপনে কিছু করলেও করতে পারে। কিন্তু তত সক্রিয় নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উত্খাতের জন্য সবাই ছিল এক জোট, রসুনের এক কোয়া। পাটের গুদামে আগুন, কলকারখানা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া, ঈদের জামাতে প্রকাশ্যে সংসদ সদস্য হত্যা করা, তাও আবার একজন দুজন নয়, বেশ কয়েকজন। এসবের মূল ছিল জাসদের গণবাহিনী। অন্যদিকে অগ্নিকন্যা জাতির পিতার চামড়া দিয়ে অবিরত ডুগডুগি বাজিয়েই চলেছিলেন। এসব কর্মকাণ্ড কারও মুখের কথা নয়, বাস্তব ঘটনা। গণবাহিনী আর জাসদ একেবারে গুলিয়ে ফেলাও ঠিক হবে না। গণবাহিনীর ওপর জাসদের কতটা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব ছিল সেটার বিচার-বিশ্লেষণ করা দরকার। তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে জাসদের ছত্রছায়ায় তখন যে কর্মকাণ্ড হয়েছে তা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। জাসদ এবং সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি না হলে ’৭৫-এর সেই ভয়াবহ নির্মম হত্যাকাণ্ড হতো না। আর সেটা না হলে আজ আমাদের রাষ্ট্রীয় অবস্থান থাকত পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর কাছাকাছি।

সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের যথার্থই বলেছেন, সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য তার নিতান্তই ব্যক্তিগত। কথাটা অবশ্যই সত্য। দলীয় সিদ্ধান্ত হলে পরবর্তী কার্যক্রম অন্যরকম হতো। কিন্তু সেতুমন্ত্রী যা বলেছেন সেটাও দলীয় কোনো বক্তব্য নয়। সেটিও নিঃসন্দেহে তার একান্তই ব্যক্তিগত। ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের পরপরই বাজারে খবর বেরিয়েছে তিনি নাকি জাসদ ছাত্রলীগ করতেন। মহসীন হল না কোন হলে জাসদ ছাত্রলীগ প্যানেলে নির্বাচন করেছিলেন। হতেও পারে তাতে দোষ কী? তখন যে কোনো ভালো ছাত্র জাসদ ছাত্রলীগ করত এবং শুরুর দিকে জাসদ ছাত্রলীগের প্যানেলে কেউ কোনো নির্বাচন করে থাকলেই তিনি পচ্চা, বাদ পড়ে যাবেন তা কেন হবে। আর কিছু কিছু আওয়ামী নেতা আজ কদিন থেকে বলছেন জেনে, শুনে, বুঝেই হাসানুল হক ইনুর জাসদকে জোটে নেওয়া হয়েছে। এটা তো অবধারিত সত্য। কেউ কি কোনো কাজ না বুঝে-শুনে করে? সবাই তো বুঝে-শুনেই সব কাজ করতে চায়। কোনো সময় কারও বুঝ ঠিক হয়, আবার কারও কারও ঠিক হয় না, এই যা পার্থক্য। আওয়ামী ঘরানার কথা শুনে বিএনপিও তো বলতে পারে তারাও জেনেশুনেই জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন। নিশ্চয়ই জামায়াত পাকিস্তানের মদদে পরাধীন বাংলাদেশে হত্যালীলায় মেতেছিল। তার শাস্তি হচ্ছে এবং আরও হবে। কিন্তু গণবাহিনী স্বাধীন দেশে, নিজের দেশের সরকারকে উত্খাত করতে নিজের দেশের মানুষকে হত্যা করেছে, সেকি কোনো অপরাধ নয়? স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের সেই ভয়াবহ অবস্থা যারা দেখেছেন তারা ছাড়া অন্য কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন না। তবে এতটা থিতিয়ে যাওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যদি হতে পারে তাহলে যথাসময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে তার পিতা-মাতা, চাচা-ভাইদের হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুতকারীদের সহজে নিষ্কৃতি দেবেন না, এটা অবলীলায় বলতে পারি। তিনি তার মা-বাবা ভাই-বোনদের যতটা ভালোবাসতেন তাতে আল্লাহ তায়ালা তাকে তৌফিক দিলে তার পিতা-মাতা, ভাইদের হত্যাকারীরা খুব সহজে পার পাবে না। জাসদকে মন্ত্রিসভায় রাখার এমনও হয়তো হতে পারে দূরে থেকে আলোচনার বাইরে চলে যাওয়া বা পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে মন্ত্রিসভায় রেখে চোখে চোখে রাখা, যাতে প্রয়োজনে কুপি জ্বালিয়ে খুঁজতে না হয়।

     লেখক : রাজনীতিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর