রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিএনপি সিইসি হটাও আন্দোলন করে কি সফল হবে?

কাজী সিরাজ

বিএনপি সিইসি হটাও আন্দোলন করে কি সফল হবে?

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ার সূচনা থেকেই বিএনপি এর সঙ্গে সানন্দে জড়িত ছিল। ইসি গঠনের লক্ষ্যে ‘সার্চ কমিটি’র বিষয়টি সংবিধানবহির্ভূত এবং সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘কোন আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে’ রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অপর চার নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও উল্লিখিত আইনটি এখনো প্রণীতই হয়নি তা বিএনপি অবশ্যই জানে।  আবার সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি অন্য সব কর্ম সম্পাদন করিবেন’ এ কথাও বিএনপির অজানা নয়। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে বিএনপির পছন্দ অনুযায়ী সিইসি ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ দেবেন বলে কি ভেবেছিল বিএনপি? ভাবলে তা ভুল ছিল। তবুও কমিশনে বিএনপির প্রস্তাবিত একজন আছেন। আমার মনে হয় পছন্দ মতো নির্বাচন কমিশন গঠন নয়, এ প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বার্তাই দিয়েছে বিএনপি। আগামী নির্বাচনটা তাদের মূল লক্ষ্য হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপির কোনো কোনো বড় পদবিধারী এখনো কিছু কথাবার্তা বলছেন। তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। বিএনপির লোকজন (সবাই নন) বলছেন, তিনি ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাতেই তিনি নিয়োগ পেয়েছেন। এককালে ছাত্রলীগ নেতা বা আওয়ামী কানেকশন থাকলেই এখনো তিনি আওয়ামী লীগকে সেবা দিয়ে যাবেন, এমন চিন্তা সুস্থির চিন্তা নয়। যারা এসব কথা বলছেন, তারা কি জানেন না নূরুল হুদার চেয়ে অনেক অনেক বড় ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ নেতা বিএনপিতে আছেন, বিএনপি করেছেন! শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের’ দুবার সাধারণ সম্পাদক ও একবার সভাপতি ছিলেন, কে এম ওবায়দুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন, ফেরদৌস আহমদ কোরেশি ছাত্রলীগের সভাপতি ও ডাকসুর ভিপি ছিলেন, মনিরুল হক চৌধুরী ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন এবং বাকশাল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন (সভাপতির কোনো পদ ছিল না), মো. ফজলুর রহমান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, ফজলুর রহমান পটল ছাত্রলীগ নেতা ও রাকসু ভিপি ছিলেন, হাবিবুর রহমান হাবিব ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন, বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রথমে ছাত্রলীগ ও পরে জাসদ ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন, হারিছ চৌধুরীসহ আরও অনেকের নাম উল্লেখ করা যাবে যারা আওয়ামী ওরিয়েন্টেড। অধ্যাপক ইউসুফ আলী, রিয়াজ উদ্দিন আহমদ ভোলা মিয়াসহ অনেক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা বিএনপি সরকারে মন্ত্রী ছিলেন। এদের ব্যাপারে বাক্যবাগিশদের বক্তব্য কী? শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মনিরুল হক চৌধুরী, গয়েশ্বর রায়, হাবিবুর রহমান হাবিব প্রমুখকে নিয়ে বিএনপি তাহলে কী করবে? আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে নেতা ছিলেন বলে তাদের দল থেকে বের করে দেবে? সন্দেহের চোখে দেখবে? নতুন সিইসি সরকারি দলের পছন্দের ব্যক্তি হিসেবে জোটসঙ্গী অন্য কারও প্রস্তাবে আসতে পারেন না তেমন কথা বলতে চাইছি না। তবে আওয়ামী পছন্দের হলেই বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে অতীতে সম্পর্কযুক্ত থাকলেই তিনি আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে হারিয়ে দেওয়ার ‘পণ’ করবেন এমন ভাবা ঠিক হবে না। আবার আওয়ামী ওরিয়েন্টেশন নেই, এমনকি অতীতে অন্য রাজনীতি, আদর্শ ও দর্শনের অনুসারী হয়ে কিংবা কোনো রাজনীতির সঙ্গে অতীতে যুক্ত না থেকেও আওয়ামী লীগ বা সরকারকে কেউ এখন সার্ভ করছে না বা করতে পারে না তা-ও নয়। নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশন বিএনপির কয়েকজন পদাধিকারীর কথামতো পরিবর্তন হয়ে যাবে না। তাছাড়া নির্বাচন কমিশন, বিশেষ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সম্পর্কে বিএনপি দলীয় নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে এখনো জানা যায়নি। এর মধ্যে এ সম্পর্কিত যেসব বক্তব্য-বিবৃতি কেউ কেউ দিয়েছেন তা তাদের ব্যক্তিগত বলেই ধরে নিতে হবে। ধরে নেওয়া যায়, নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনেই আগামী পাঁচ বছর সব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। নির্বাচন কমিশনাররা শপথ গ্রহণের পর তাদের মেয়াদকালে তাদের বা তাদের কাউকে অপসারণ, পদচ্যুত করার কোনো সুযোগ নেই। তাদের কারও আসন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ বা মৃত্যুজনিত কারণ ছাড়া শূন্য হওয়ার সুযোগ কোথায়? প্রবল চাপ সৃষ্টি করে যদি পদত্যাগে বাধ্য করা যায় তো ভিন্ন কথা। কিন্তু বিএনপি এবং তার মিত্ররা কি তা করতে সক্ষম?

 

 

গত ৮ বছরে, বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির  বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর জনমত ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক মনোভঙ্গি অনুকূল থাকা সত্ত্বেও যখন কাজের কাজ কিছুই করতে পারেনি বিএনপি, বরং হঠকারিতা করে শক্তি খুইয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে, শিরদাঁড়া খাড়া করে দাঁড়াতেই পারছে না; তখন এ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনবিরোধী দুর্বার কোনো আন্দোলন তারা গড়ে তুলতে পারবে বলে কেউ বিশ্বাস করে না। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিএনপির জনসমর্থন আছে বিপুল। নারায়ণগঞ্জের উদাহরণটি এ প্রসঙ্গে বারবারই আসতে পারে যে, দলের বর্তমান ভঙ্গুর দশা এবং স্থানীয় কোনো কোনো পুরনো নেতার বিরোধিতা বা অসহযোগিতার পরও ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিরুদ্ধে অস্থানীয় এবং দলের বড় কোনো পদধারী না হয়েও বিএনপি প্রার্থীর প্রায় এক লাখ ভোট পাওয়া ছোট বিষয় নয়। এ ভোট অবশ্যই বিএনপির। সারা দেশেই বিএনপির এমন জনসমর্থন রয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। আওয়ামী লীগও তা ভাবছে বলে মনে হয় তাদের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়। নারায়ণগঞ্জের ভাষা তিনি বুঝেছেন বলেই বলেছেন, ‘বিএনপির জনসমর্থনকে ছোট করে দেখা যাবে না।’ কিন্তু এই বিপুল বিশাল জনসমর্থনকে কাজে লাগাতে পারছে না দলটি। নেতৃত্বের দুর্বলতা, অদূরদর্শিতা এবং সাংগঠনিক ভঙ্গুর দশার কারণে তারা ফসল ঘরে তুলতে পারছে না। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, ব্যাংক লুট, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ লোপাট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির খারাপ অবস্থা, গুম, খুন, নিজ দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা-মোকদ্দমাসহ কত জনপ্রিয় ইস্যু এলো-গেল, বিএনপি একটাও কাজে লাগাতে পারল না। জনগণকে সম্পৃক্ত করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শাণাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ তারা। সর্বশেষ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠান ছাড়া গত ১০ বছরে তাদের আলোচনায় আসার মতো সফল কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিই ছিল না। সরকারি বাধা-বিপত্তি আছে, গুম-খুনের ভয় আছে, জেল-জুলুম মামলা-মোকদ্দমার খড়গ আছে— সবই ঠিক। আমাদের এই ভূখণ্ডে জনগণের আশা ও স্বপ্ন পূরণের সর্বাত্মক সংগ্রাম দমনের জন্য শাসকগোষ্ঠীর আরও কঠিন জুলুম-নির্যাতনের ইতিহাসও আছে। সবকিছু মোকাবিলা করেই অনেকে ‘বীরের’ খাতায় নাম তুলেছেন সে ইতিহাসও আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও বিভিন্ন সময়ে সাহসী লড়াই হয়েছে ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও সেই ইতিহাসের এক একটি উজ্জ্বল পাতা। বেগম জিয়া আপসহীন দেশনেত্রীর অভিধা পেয়েছিলেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সাহসী নেতৃত্ব দিয়ে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অভিমুখে লংমার্চে কাঁচপুরে অবরুদ্ধ হয়েও অবিচল ও দৃঢ় ছিলেন তিনি। হার মানেননি। সাহসের পঙিক্ততে ভরা দুজনের এমন আরও অনুপম পদ্য আছে। তাদের সঙ্গী আরও অনেক সাহসী সংগ্রামী নেতা-কর্মী এক একটি পাতা হয়ে রচনা করেছেন গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মোহনীয় কাব্যগ্রন্থ। তেমন কাব্য গত এক দশকে আর একটিও রচনা করতে পারেনি বিএনপি। নতুন নিযুক্ত নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিএনপি কিছু করতে পারবে তা তাদের সমর্থক শুভানুধ্যায়ীরাও মনে করে না। অবশ্য আগেই উল্লেখ করেছি, এ ব্যাপারে বিএনপির দলীয় সিদ্ধান্ত এখনো জানা যায়নি। তবে দলের বিশিষ্ট শুভানুধ্যায়ীরা এরই মধ্যে বিএনপিকে মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন। বিএনপির একজন মুরব্বিস্থানীয় শুভানুধ্যায়ী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপি বা অন্য দল কে কি বলবে তা ভিন্ন কথা। যেহেতু মহামান্য রাষ্ট্রপতি এটি ঘোষণা করেছেন এটা একসেপ্টেড হওয়া উচিত। এ নিয়ে ভিন্ন মত থাকার কোনো কারণ নেই। নতুন কমিশনের সামনে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের অগ্নিপরীক্ষা রয়েছে মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সাবেক উপাচার্য বলেন, কমিশনকে তা উত্তীর্ণ হতে হবে। এখন থেকে তাদের চেষ্টা চালাতে হবে। তাদের উত্তীর্ণ হওয়ার একমাত্র পথ জনসাধারণের আস্থাভাজন হওয়া।’ বিএনপির আরেক শুভানুধ্যায়ী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও বলেছেন, নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিএনপির মেনে নেওয়া উচিত। তিনি বলেছেন, নির্বাচন কমিশন আরও খারাপ হতো যদি মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানকে সিইসি বানানো হতো। সে ক্ষেত্রে নূরুল হুদা অনেক ভালো। সুতরাং ইসি নিয়ে বিএনপির অখুশি হওয়ার কিছু নেই। আর নূরুল হুদা জনতার মঞ্চের লোক ছিলেন সেটা দোষের কিছু নয়। নতুন সিইসিকে আমরা বিশ্বাস করতে পারি। তার ওপর আস্থা রাখতে পারি তিনি কোনো দলের হবেন না। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে কিনা তা বিএনপির ওপরও নির্ভর করছে। কাগমারি সম্মেলন দিবস উদযাপন কমিটির এক সভায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি এসব কথা বলেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এ দুই সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তির পরামর্শ বিএনপির আমলে নেওয়া উচিত। নির্বাচন কমিশনের সমালোচনাই শুধু নয়, নির্বাচন কমিশনের করণীয় সম্পর্কেই তাদের বেশি বেশি কথা বলা উচিত। এ ব্যাপারে দলের নীতিনির্ধারণী কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে নির্বাচন কমিশনের আশু ও চূড়ান্ত করণীয় সম্পর্কে বিএনপি কমিশনকেই একটি ‘ধারণাপত্র’ দিতে পারে— যা জনসাধারণকেও অবহিত করা হবে। সরকারের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী-প্রতিপক্ষ হিসেবে কৌশলগতভাবে বিএনপি সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর একটা চাপ হয়তো অব্যাহত রাখবে; কিন্তু তাদের অবশ্যই ভাবনায় রাখা উচিত যে, নির্বাচনকালীন সরকারের কাছ থেকে যদি নিরপেক্ষ ভূমিকা পাওয়া না যায়, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ থাকতে চাইলেও তা কি সম্ভব? বাংলাদেশে ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার টিএন সেশনের মতো একজন সিইসি খুঁজে পাওয়া যাবে না তা নয়; তবে তা এত সহজ বলে মনে হয় না। অতীতে বিএনপিসহ অন্য কোনো দলের সরকারও তেমন দৃঢ়চেতা লোকদের ইসিতে আনেনি। সবাই পছন্দের লোকই ‘পছন্দ’ করেছেন। নির্বাচনকালীন সরকারকে নিরপেক্ষ রাখতে বা থাকতে বাধ্য করার জন্য এখন বরং নির্বাচন কমিশন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রত্যাশী জনগণের মধ্যে একটা ‘হোলি অ্যালায়েন্স’ হতে পারে। বিএনপি তেমন একটি উদ্যোগে নেতৃত্ব দিতে পারে। কাজটি হবে নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ থাকতে অব্যাহত চাপে রাখা এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায়ের লক্ষ্যে সরকারের ওপরও চাপ প্রয়োগে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে একযোগে কাজ করা। নির্বাচন কমিশনকে আস্থায় না নিয়ে তা সম্ভব নয়। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার ওপরই সবিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে এবং তা এখন থেকেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক  উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান গত ১১ ফেব্রুয়ারি এফডিসিতে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকার কি হবে তা নিয়ে এখনই ভাবা উচিত। তিনি বলেন, এটি শুধু রাজনৈতিক দলের বিষয় নয়, জনগণই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে সিদ্ধান্ত গ্রহণে গণভোট একটি উত্তম পদ্ধতি হতে পারে। এদিকে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকার নিরপেক্ষ না হলে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারবে না। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হলে নির্বাচনকালীন সরকারকে নিরপেক্ষ হতে হবে। তিনি বলেন, দেশে একটি অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া উচিত। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি মিডিয়ায় খবর এসেছে যে, এ ব্যাপারে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেবে বিএনপি। এটি অবশ্যই শুভ চিন্তা। কিন্তু দলকে নির্বাচনের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার ব্যাপারে গুরুত্ব না দিয়ে, সুচিন্তিত পথ বেছে না নিয়ে এবং ঘর ছেড়ে বাইরে আসার চেষ্টা না করে শুধু প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে লড়াই হবে হাওয়ার বিরুদ্ধে তলোয়ার চালানোর মতো।

বিএনপির সামনে এখন ইস্যু কোনটি বড়— নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা গোটা নির্বাচন কমিশন আগামী নির্বাচন, নাকি পার্টি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের দায়ের করা দুর্নীতি মামলার আশু ভবিষ্যৎ? এ ব্যাপারে দলের নীতিনির্ধারণী কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি বলেই জানি। তবে পার্টি চেয়ারপারসনের সঙ্গে দলের সিনিয়র নেতাদের বৈঠকে অনেকেই বেগম খালেদা জিয়াকে ছাড়া আগামী নির্বাচনে অশংগ্রহণ না করার পরামর্শ দিয়েছেন। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৫ ফেব্রুয়ারি এক আলোচনা সভায় বলেছেন, বেগম জিয়াকে বাদ দিয়ে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। তিনি অবশ্য ব্যাখ্যা করে বলেছেন, বেগম জিয়াকে জেলে ঢুকিয়ে নির্বাচন দিলে জনগণ সে নির্বাচন মেনে নেবে না। ‘নির্বাচন হবে না’ আর ‘জনগণ মেনে নেবে না’ এক কথা নয়। অর্থাৎ তারা নির্বাচন না করলেও নির্বাচন হয়ে যাবে— সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি তিনি। তাহলে তাদের সামনে করণীয় কী? নির্বাচন প্রতিহত করা বা আটকে দেওয়া। কিন্তু তা করতে কি তারা সক্ষম? ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের ‘ফলাফল’কে পুঁজি করে সরকার তো তিন বছর চালিয়ে দিল। কী করতে পেরেছেন তারা? তেমন কিছু করতে পারার সক্ষমতা যদি তারা প্রমাণ করতে পারেন তাহলে সরকারও নিশ্চয়ই কোনো ঝুঁকি নেবে না। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সেই সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টাই এখন বিএনপির করা উচিত। উচিত নির্বাচনের দলীয় রোডম্যাপ তৈরি করা। ৩০০ আসনে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী বাছাই করা; নমিনেশন বেচাকেনার ‘বেপারিদের’ খামোশ রাখা, দলকে জনসমর্থন ক্যাশ করতে পারার মতো যোগ্য ও শক্তিশালী করে তোলা।  এমনকি যে কোনো খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করে হলেও ‘নির্বাচনী যুদ্ধে’ শামিল থাকার অঙ্গীকারে অটল থাকা।  সরকার বেগম জিয়াকে জেলে দিলে (জেল সরকার দেবে না, দিলে দেবে আদালত) তা বিএনপির জন্য নির্বাচনে ‘শাপেবর’ হতে পারে— সেভাবে ভাবছে না কেন বিএনপি?

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর