সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে পরিবেশগত পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। বিশেষ করে জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন— বন্যা, খরা, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদী ভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, বজ্রপাত ইত্যাদির প্রবণতা বৃদ্ধি। বেশ কিছু দিন ধরে বিভিন্ন মিডিয়ার সংবাদে লক্ষ্য করা যায় যে, বজ্রপাতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অতীতের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধি জলবায়ুগত এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানের পরিবর্তনের ফল তা সহজেই বলা যায়।
বজ্রপাত উষ্ণমণ্ডলীয় গোলযোগের মধ্যে অন্যতম একটি। জানমালের ক্ষয়ক্ষতির বিবেচনায় বজ্রপাত একটি দুর্যোগ হলেও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যা হোক, এটি বন্ধের উপায় এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। বজ্রপাত সংঘটনের বিষয়টি বুঝতে হলে দুটি বিষয়ে ধারণা থাকা প্রয়োজন। প্রথমত, নিরক্ষ অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চল পর্যন্ত সূর্যরশ্মির পতন কোণ। দ্বিতীয়ত, বায়ুমণ্ডলের স্তরসমূহের উলম্ব বিস্তার। নিরক্ষরেখা পৃথিবীর মাঝ বরাবর পূর্ব-পশ্চিমে বেষ্টন করে আছে। এখান থেকে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু সমান দূরত্বে অবস্থিত। সূর্য নিরক্ষ অঞ্চলে প্রায় সারা বছর লম্বভাবে এবং মেরু অঞ্চলে তির্যকভাবে কিরণ দেয়। ফলে নিরক্ষ অঞ্চল প্রায় সারা বছর উত্তপ্ত থাকে এবং মেরু অঞ্চল শীতল থাকে। যে কারণে নিরক্ষীয় অঞ্চলে (উষ্ণমণ্ডল) বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে থাকে।
অপরপক্ষে বায়ুমণ্ডলের উলম্ব বিস্তার অনুযায়ী ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন নিকটবর্তী স্তর হচ্ছে ট্রপোস্ফিয়ার। এরপর স্ট্রাটোস্ফিয়ার, মেসোস্ফিয়ার এবং থার্মোস্ফিয়ার। ট্রপোস্ফিয়ারের গড় গভীরতা ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে প্রায় ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত, স্ট্রাটোস্ফিয়ারের ট্রপোস্ফিয়ারের ওপর থেকে ৪৭-৪৮ কিলোমিটার পর্যন্ত, মেসোস্ফিয়ারের স্ট্রাটোস্ফিয়ারের ওপর থেকে ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত এবং মেসোস্ফিয়ারের ওপর থার্মোস্ফিয়ার বা আয়োনোস্ফিয়ার অবস্থিত। তাপমাত্রার উলম্ব বিস্তারণ বায়ুমণ্ডলের এসব স্তরকে অনুসরণ করে হ্রাস বা বৃদ্ধি পায়। ট্রপোস্ফিয়ারে তাপমাত্রা কমতে থাকে এবং শেষ সীমায় স্থিতিশীল থাকে যাকে ট্রপোপজ বলে। এরপর স্ট্রাটোস্ফিয়ারে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে এবং শেষ সীমায় স্থিতিশীল থাকে যাকে স্ট্রাটোপজ বলে। অতঃপর মেসোস্ফিয়ারে তাপমাত্রা কমতে থাকে এবং শেষ সীমায় স্থিতিশীল থাকে যাকে মেসোপজ বলে। মেসোপজের উপরে অবস্থিত আয়োনোস্ফিয়ারে পুনরায় তাপমাত্রা বাড়তে থাকে এবং এই স্তরের উপরের দিকের তাপমাত্রা প্রায় ১৩৮০ সেন্টিগ্রেড। এই আয়োনোস্ফিয়ার বজ্রপাত সংঘটনের অন্যতম অনুঘটক। আয়োনোস্ফিয়ারের মূল উপাদান হলো আণবিক নাইট্রোজেন এবং পারমাণবিক অক্সিজেন। এই দুই উপাদান সূর্যের গামা ও এক্স রশ্মি শোষণ করে। ফলে প্রতিটি অণু ও পরমাণু ধনাত্মক ইলেক্ট্রোন সৃষ্টি করে যা আয়ন নামে বেশি পরিচিত। এসব মুক্ত আয়ন পৃথিবীর চারদিকে বলয় সৃষ্টি করে। সাধারণ বা মেঘমুক্ত আবহাওয়ায় ধনাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জ আয়োনোস্ফিয়ার থেকে পৃথিবীতে আসে। এভাবে কেবল ধনাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জ আসতে থাকলে পৃথিবীর ঋণাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জ ১০ মিনিটের মধ্যে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেত। বজ্রপাতের সময় ঋণাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জ পৃথিবীতে এসে পৃথিবীর ঋণাত্মক চার্জ বজায় রাখে। পৃথিবীতে একসঙ্গে প্রতি মুহূর্তে প্রায় ১৮০০ বজ্র ঝড় বিদ্যুৎ চমকের মাধ্যমে পৃথিবীর ঋণাত্মক বৈদ্যুতিক চার্জ বজায় রাখতে সাহায্য করে।
এবার আসা যাক মেঘ সৃষ্টি এবং মেঘে বৈদ্যুতিক চার্জ সৃষ্টির প্রক্রিয়ায়। দিনের বেলায় সূর্যের রশ্মির কারণে জলভাগ ও স্থলভাগ হতে জলীয়বাষ্প এবং উদ্ভিদের প্রস্বেদনের ফলে ত্যাগকৃত জলীয়বাষ্প বায়ুমণ্ডলের উপরের দিকে উঠে আসে। উল্লেখ্য, নিরক্ষীয় অঞ্চলে বেশি পরিমাণে সূর্য রশ্মি পতিত হওয়ায় এই অঞ্চলে বাষ্পীয়-প্রস্বেদনের হার বেশি। এই জলীয়বাষ্প উপরে উঠে শীতল হতে থাকে। একপর্যায়ে হিমাংকে পৌঁঁঁঁঁছলে বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত ধূলিসহ অন্যান্য ক্ষুদ্রকণাকে ঘিরে ঘনীভূত হতে থাকে যা প্রথমে জলকণায় এবং আরও শীতল হলে বরফ কণায় পরিণত হয়। এভাবে মেঘের সৃষ্টি হয়। কালবৈশাখী (বজ্র বিদ্যুত্পূর্ণ ঝড়) মেঘে কীভাবে বিদ্যুৎ উত্পন্ন হয় তা এখনো সম্পূর্ণরূপে নিরূপিত হয়নি। তবে ঝড়োপুঞ্জ মেঘে বরফদানা (শিলা) সৃষ্টির মাধ্যমে বিদ্যুতের সঞ্চার হয়। বরফদানা সৃষ্টির সময় জলকণার বহির্ভাগ প্রথমে বরফে রূপান্তরিত হয় এবং ধীরে ধীরে কেন্দ্রভাগ জমাট বাঁধে। এ প্রক্রিয়ায় বরফকণাটির শীতল বহির্ভাগে ধনাত্মক চার্জ এবং অপেক্ষাকৃত উষ্ণ কেন্দ্রভাগে ঋণাত্মক চার্জের সৃষ্টি হয়। এ সময় শিলাগুলো ভেঙে যায় এবং বায়ু তাড়িত হয়ে ধনাত্মক চার্জযুক্ত শিলাখণ্ডগুলো উপরের দিকে এবং ঋণাত্মক চার্জবিশিষ্ট শিলাখণ্ডগুলো মেঘের তলদেশের দিকে নামতে থাকে। ফলে মেঘের উপরিভাগ ধনাত্মক চার্জযুক্ত এবং নিচের ভাগ ঋণাত্মক চার্জযুক্ত হয়। পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে এই প্রক্রিয়ায় চার্জ বিভক্ত হয়। আয়োনোস্ফিয়ার হতে পৃথিবীতে আগত ধনাত্মক চার্জ এবং ঝড়োমেঘপুঞ্জের নিচের দিকের ঋণাত্মক চার্জের আকর্ষণের মাধ্যমে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়।
বজ্রপাতের সময় করণীয় সম্পর্কে প্রতিটি মানুষের সম্যকজ্ঞান থাকা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে যারা ঘরের বাইরে ক্ষেতখামারে কাজ করে তারা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। যেহেতু মেঘের নিম্নদেশের ঋণাত্মক চার্জ এবং পৃথিবীর ধনাত্মক চার্জের স্পার্কিংয়ের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি হয় এবং এই ক্ষেত্রের মধ্যে যা কিছু পড়ে তা অতিরিক্ত তাপের কারণে পুড়ে যায়। সেহেতু উঁচু স্থান অর্থাৎ উঁচু গাছ, ইলেকট্রিক পোল, মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি এরূপ বস্তুর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে। কেননা যে স্থান বা বস্তু যত উঁচু সে স্থান মেঘের তত সন্নিকটে থাকায় বজ্রপাতের সম্ভাবনা তত বেশি। বাড়ির ছাদ কিংবা উঁচু স্থানে অবস্থান করলে দ্রুত সেখান থেকে নেমে নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। মৌসুমে ঘনকালো (ঝড়মেঘ) মেঘ দেখলেই সাবধান হতে হবে এবং বৃষ্টি শুরুর আগে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। পাকা বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া বেশি নিরাপদ। তবে পাকাবাড়ি সুউচ্চ হলে সেক্ষেত্রে বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় জানালার কাছে না থাকাই ভালো। পায়ে রাবারের স্যান্ডেল পরে থাকা এবং পানি ও যে কোনো ধাতববস্তুর যেমন সিঁড়ির বা বারান্দার রেলিং, পানির কল ইত্যাদির স্পর্শ থেকে বিরত থাকা বেশি নিরাপদ। বিদ্যুৎ পরিবাহী যে কোনো বস্তুর স্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে। পুকুর বা জলাশয়ে থাকা নিরাপদ নয়। বজ্রপাতে বাড়ির ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্র যেগুলো ইলেকট্রিক সংযোগ বা ডিসের সংযোগ থাকে সেগুলো বিচ্ছিন্ন করা ভালো। নতুবা পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ছাড়া এগুলো বন্ধ থাকলেও স্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে। মাঠের মধ্যে ফাঁকা জায়গায় থাকলে যদি বজ্রপাত হওয়ার অবস্থা তৈরি হয় তাহলে কানে আঙ্গুল দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিচু হয়ে বসে থাকতে হবে। তবে মাটিতে শোয়া যাবে না, কেননা মটিতে শুয়ে পড়লে বিদ্যুৎ পৃষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। গাড়িতে থাকা অবস্থায় বজ্রপাতের পরিস্থিতি তৈরি হলে গাড়ির মধ্যে থাকায় নিরাপদ। তবে মনে রাখতে হবে গাড়ির ধাতব কোনো অংশের সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে।
টিনের বাড়ির চেয়ে ছনের বাড়ি এমনকি কংক্রিটের দালান বাড়ি বেশি নিরাপদ। তবে সব বাড়িকে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শক্রমে বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা লাগাতে হবে। যেসব বাড়িতে বৈদ্যুতিক সংযোগ রয়েছে সেগুলোর সংযোগের সময় আর্থিং ব্যবস্থা সঠিকভাবে স্থাপন করতে হবে।
তাল জাতীয় সুউচ্চ প্রজাতির গাছ প্রচুর পরিমাণে মাঠের মধ্যে লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা বৈদ্যুতিক শকে আহত ব্যক্তিদের মতো। শরীর থেকে দ্রুত বৈদ্যুতিক চার্জ অপসারণের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আহত ব্যক্তির অস্বাভাবিক আচরণে বিচলিত না হয়ে দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার-প্রচারণা চালনার মাধ্যমে জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যবইয়ে পঠিত বিষয় হিসেবে সংযুক্ত করতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হয়। মনে রাখতে হবে বজ্রপাত সম্পর্কে জানা এবং করণীয় সম্পর্কে সচেতনতাই পারে বজ্রপাতের হাত থেকে জানমাল রক্ষা করতে।
লেখক : অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।