মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
আইন-আদালত

নির্যাতনের মাধ্যমে নেওয়া স্বীকারোক্তি

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

নির্যাতনের মাধ্যমে নেওয়া স্বীকারোক্তি

ন্যায়বিচার এমন একটি শব্দ, যার সঙ্গে কিছু বিষয় এত নিবিড় ও গভীরভাবে জড়িত যে, এর যে কোনো একটির কোনোরকম ব্যত্যয় ঘটলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। মার্কিন মানবতাবাদী মার্টিন লুথার কিং বলেছেন, ‘যে কোনো জায়গায় অবিচার ঘটলে তা সব জায়গার বিচারকে হুমকির মুখে ফেলে।’ ফরাসি দার্শনিক আঁনাতোলে ফ্রান্স বলেছেন, ‘আইন যদি সঠিক হয় তাহলে মানুষও ঠিক হয়ে যায় কিংবা ঠিকভাবে চলে।’ আমাদের বিচারব্যবস্থায় বিদ্যমান চরম দুরবস্থায় উপরোক্ত দুটি উক্তি চরমভাবে প্রণিধানযোগ্য। দোষ স্বীকারোক্তি একটি ভয়ঙ্কর শব্দ, যদি তা হয় ভীতি প্রদর্শনপূর্বক। একটি দেশে, একটি সমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক জনগোষ্ঠীর আইন সম্পর্কে সচেতনতা। যে সমাজে আইনের শাসন নেই সে সমাজ সভ্য বলে বিবেচিত নয়। একটি সচেতন জনগোষ্ঠীই পারে সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু এখানে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার তথা মানবাধিকার— এ ধারণাগুলো প্রকৃতরূপে বিকশিত হতে পারেনি। এ বাস্তবতার নিরিখেই ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার অপপ্রয়োগ নিয়ে আমার এ লেখা। একটি কৌতুক দিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাই। জাতিসংঘের একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বাংলাদেশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা যোগ দেন। তার সঙ্গে সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স আর ব্রিটেনের একজন করে পুলিশ কর্মকর্তাও যোগ দেন। তাদের প্রশিক্ষণের একটি অংশ ছিল আমাজন বনে। এ বনের মধ্যে কয়েকটি হরিণের বাচ্চা ছেড়ে দেওয়া হয়। কর্মকর্তাদের বলা হয় যে, এ বাচ্চাগুলোকে খুঁজে বের করে আনতে হবে। সময় দেওয়া হবে এক দিন। তবে এর বেশি সময় লাগলেও হরিণের বাচ্চা ছাড়া খালি হাতে ফেরা যাবে না। সুইজারল্যান্ডের পুলিশ কর্মকর্তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হরিণের বাচ্চা উদ্ধার করে ফিরলেন। ফ্রান্সের পুলিশ হরিণের বাচ্চা নিয়ে হাজির হন তিন দিন পর। ব্রিটেনের কর্মকর্তা সাত দিন পর। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা ১৫ দিন পর। কিন্তু বাংলাদেশের পুলিশের কর্মকর্তার কোনো খোঁজ নেই। প্রশিক্ষকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। এক মাস পর ব্রাজিলের বিভিন্ন শহর থেকে ঘুরেফিরে একটি ছাগলের বাচ্চা নিয়ে হাজির হলেন বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকর্তা। প্রশিক্ষকরা প্রশ্ন করলেন, ছাগলের বাচ্চা নিয়ে এলেন কেন? জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কে বলেছে এটা ছাগলের বাচ্চা। একে রিমান্ডে দিন। দেখবেন পরদিন এটা নিজেই স্বীকার করবে যে সে একটি হরিণের বাচ্চা।

দোষ স্বীকারোক্তি বলতে অপরাধকারী কর্তৃক স্বেচ্ছায় প্রণোদিতভাবে নিজের অপরাধের স্বীকার করাকে বোঝায়। দেশে প্রচলিত কোনো আইন দ্বারা যে কর্মকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এরূপ অপরাধ সংঘটনের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি যদি সংশ্লিষ্ট ঘটনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে অপরাধ সংঘটন সম্পর্কে বিনা প্ররোচনায়, কোনোরূপ প্রলোভন ছাড়া নির্ভয়ে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বেচ্ছায় সত্য বক্তব্য পেশ করেন তাকে স্বীকারোক্তি বলে।

স্বীকারোক্তি লিখে রাখার সময় ম্যাজিস্ট্রেটকে সন্তুষ্ট হতে হবে যে এটা স্বেচ্ছামূলক। শুধু অপরাধীর বক্তব্যই নয়, বরং তার আচরণের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। দোষ স্বীকারোক্তি লেখার জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারা, ৩৬৪ ধারা, সাক্ষ্য আইনের ২৪ থেকে ৩০ ধারা ও হাই কোর্ট জেনারেল রুলস অ্যান্ড সার্কুলার অর্ডারসের (ক্রিমিনাল) ২৩ ও ২৪ নম্বর রুলস প্রযোজ্য। এ বিধানগুলোর মধ্যে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায়ই দোষ স্বীকারোক্তি সম্পর্কে বিশদ বিবরণ আছে। স্বীকারোক্তি লেখার শেষে স্বীকারোক্তির নিম্নে তিনি একটি প্রত্যয়নপত্র দেবেন।

‘আমি (নাম) এর নিকট ব্যাখ্যা করেছি যে, তিনি স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য নন এবং যদি তিনি স্বীকারোক্তি করেন, তাহলে উক্ত স্বীকারোক্তি তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে এবং আমি বিশ্বাস করি যে, এ স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে দেওয়া হয়েছে। এ স্বীকারোক্তি আমার উপস্থিতিতে এবং আমার শ্রুতি গোচরে গৃহীত হয়েছে। এটা স্বীকারোক্তি প্রদানকারী ব্যক্তিকে পড়ে শোনানো হয়েছে এবং তিনি তা সঠিক বলে স্বীকার করেছেন এবং এই লিখিত স্বীকারোক্তিতে তার প্রদত্ত বিবৃতির পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বিবরণ রয়েছে।’ আসামির স্বীকারোক্তি রেকর্ডের ক্ষেত্রে তার শপথ গ্রহণের কোনো আইনগত বিধান নেই। কোনো অপরাধজনক ঘটনার পুলিশি তদন্ত চলাকালে ঘটনার সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তির জন্য নিয়ে এলে বা উক্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এলে ম্যাজিস্ট্রেট প্রথমে ওই ব্যক্তিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে জানবেন ওই ব্যক্তি স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য ইচ্ছুক কিনা। পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হলে অভিযুক্তকে প্রশ্ন করে জেনে নিতে হবে কখন, কোথায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং কোথা থেকে সে পুলিশের হেফাজতে আছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে যদি ম্যাজিস্ট্রেট মনে করেন ওই ব্যক্তি স্বীকারোক্তি প্রদান করতে আগ্রহী তাহলে তাকে এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনার জন্য যুক্তিযুক্ত সময় প্রদান করবেন। সাধারণত ন্যূনতম তিন ঘণ্টা সময় দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। এই সময়ে ওই ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবেন। এ সময় ওই ব্যক্তিকে পুলিশের সঙ্গে বা অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ বা পরামর্শ করার সুযোগ দেওয়া যাবে না এবং এই সময়ে তিনি যাতে কারও দ্বারা কোনোভাবেই প্রভাবিত না হতে পারেন, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যুক্তিযুক্ত সময় শেষে ওই ব্যক্তি যে স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে বিবেকের তাড়নায় পরিণতি সম্পর্কে অবহিত হয়েও স্বীকারোক্তি করছেন সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজনীয় কিছু প্রশ্ন করবেন এবং তার উত্তর লিখে রাখবেন। এরপর ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৬৪ ধারা অনুসরণে ওই ব্যক্তির স্বীকারোক্তি লিখে তা তাকে পড়ে শোনাবেন। পড়ে শোনানোর পর ওই ব্যক্তি তা সঠিকভাবে লেখা হয়েছে বলে স্বীকার করলে তাতে তার স্বাক্ষর নেবেন এবং ১৬৪ ধারার বিধানমতে প্রত্যয়নপত্র দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট তাতে স্বাক্ষর করবেন।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও গবেষক।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর