শনিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

১১৪ বছর পরে গণতন্ত্র

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

১১৪ বছর পরে গণতন্ত্র

১৯০৫ সালে মহাত্মা গান্ধী সাতটি মৃত্যুসম পাপের কথা বলেছিলেন যাতে ছিল সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, জ্ঞান এমনকি বিবেকহীন আনন্দের মতো মহাপাপের কথা। সেগুলো হলো : Wealth without Work (বিনাপরিশ্রমে সম্পদের মালিক হওয়া). Pleasure without Conscience (বিবেকহীন আনন্দ). Science without Humanity (মানবতাশূন্য বিজ্ঞান). Knowledge without Character (চরিত্রহীন পণ্ডিত ব্যক্তি). Politics without Principle (নীতিবিবর্জিত রাজনীতি). Commerce without Morality নৈতিকতাবিবর্জিত বাণিজ্য) এবং Worship without Sacrifice (আত্মোৎসর্গ ছাড়া পূজা বা অর্চনা).

১৯০৫-এর পরে আজ ২০১৯ সাল। ১১৪ বছর পরে উপমহাদেশে নীতিবিবর্জিত রাজনীতির এক চরম পর্যায়। আগেও তা ছিল, তবে যৎসামান্য। আমার জানা মতে, ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদ ও জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে হিমালয়সম উচ্চতায় অধিষ্ঠিত বাঙালির প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পরবর্তীতে জাতির পিতা, তিনি যাদের মনোনয়ন দিয়েছিলেন, ওইসব মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে কারও দাঁড়ানোর সাহস ছিল না। শুধু প্রাদেশিক পরিষদে কুমিল্লার চান্দিনা আসনে অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ স্বতন্ত্র দাঁড়িয়ে জামানত হারান। জাতির জনকের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হলো। বাঙালির আরাধ্য সেই মহাপুরুষ শুধু বঙ্গবন্ধু নন, মহানায়ক নন এখন তিনি জাতির পিতা। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো কোনো আসনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। দুটো আসনে টাঙ্গাইলের কালিহাতী এবং কুমিল্লার দাউদকান্দি হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছিল। কালিহাতীতে শাজাহান সিরাজ এবং লতিফ সিদ্দিকীর মধ্যে আর দাউদকান্দিতে খুনি মোশতাক ও রশিদ ইঞ্জিনিয়ারের মধ্যে। অবশ্য এই স্থলে জাসদের এ দুজনের জন্মই আওয়ামী লীগের ঘরে। তারা স্বাধীনতা-উত্তর নতুন দল জাসদের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা। ’৭৩-এর নির্বাচনেও কুমিল্লা-৭ চান্দিনা থেকে বঙ্গবন্ধুর মনোনীত প্রার্থী হলেন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা, বঙ্গবন্ধুর প্রিয় পাত্র হাজী রমিজউদ্দীন। এবারও অধ্যাপক আলী আশরাফ স্বতন্ত্র প্রার্থী। এবার তিনি প্রার্থী হয়েছেন খুনি মোশতাকের সহযোগিতা নিয়ে। হাজী রমিজউদ্দীন ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত প্রিয়, নির্লোভ নেতা। যেহেতু তার বাড়ি বাবুটীপাড়া অর্থাৎ চান্দিনা থানার বাইরে, তাই খুনি মোশতাক চান্দিনায় স্থায়ীভাবে বসবাসরত হাজীকে হারানোর জন্য আঞ্চলিকতার ধুয়া তুলে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সামান্য ভোটের ব্যবধানে জয়ী হতে সাহায্য করেন।

নীতিবিবর্জিত রাজনীতি ব্যাপকভাবে শুরু হয় জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে। তিনি তখন মৃত বা বিলুপ্ত দলের রাজনৈতিক নেতাদের যাদের স্বাধীন বাংলাদেশে বসবাসের কোনো অধিকার ছিল না, তাদের দিয়ে শুরু করেন নীতিবিবর্জিত রাজনীতি। ক্ষণিকের জন্য লাভবান হলেও বেশি দিন বাঁচতে পারেননি। জিয়ার নীতিবিবর্জিত রাজনীতির উত্তরাধিকার হিসেবে বিএনপি, রাজনৈতিক নেতৃত্বের একই শিক্ষা, একই পথচলা। সামান্য অর্থ লোভে, ক্ষমতার লোভে একজন রাজনৈতিক নেতা তার বিবেক, দলীয় আদর্শ সব বিসর্জন দিয়ে রাজনৈতিক দল পরিবর্তন করেন।

বঙ্গবন্ধুর হাতে তৈরি ছাত্রলীগের সভাপতি হতে পারা এক বিরাট অর্জন। দেখা গেল ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েও আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হয়ে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থিত বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে নেমে পড়েন। তারপর ‘৯৬, ২০০১-এর নির্বাচনের নীতিবদলের হাওয়া দুই দলেই প্রচণ্ডভাবে দোল খেতে লাগল। ১৯৭০ সালে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি। ছাত্রলীগের এমন কোনো কর্মী নেই, যিনি একাধারে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হয়েছিলেন। তিনিও বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ছেড়ে বা যাদের সঙ্গে রাজনীতি করছেন, তা দেখলে বা শুনলে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। কেননা, তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু সেøাগান ধরে ’৭০-এ নির্বাচন, ’৭১-এ স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছি।

আসলে নীতিবিবর্জিত রাজনীতির অন্যতম কারণ প্রকৃত শিক্ষার অভাব। অতিদ্রুত বিশাল কিছু হওয়ার আকাক্সক্ষা। আজকের রাজনীতিবিদরা যদি নেলসন ম্যান্ডেলা, দালাইলামা, মাও সে তুং লেনিন, মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ বোস সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর জীবনের ইতিবৃত্তান্ত পড়তেন তাহলেও এই দলবদলের প্রার্থী হতে পারতেন না। হলেও ন্যূনতম অনুশোচনা হতো। মহাত্মা গান্ধীর উল্লিখিত সাতটি মৃত্যুসম পাপ আজ তাদের উদ্দেশ্যেই উৎসর্গ করলাম। আজকের জাতির পিতা, শেখ মুজিব কোনো ব্যক্তির নাম বা কোনো দলীয় প্রধান নয়, শেখ মুজিব এক কালজয়ী আদর্শ, এক জ্বলন্ত শিখা। এই অগ্নিশিখার আলোকে অনাগত ভবিষ্যতের অগণিত নিপীড়িত জনতা আলোর পথ দেখে নেবে। বিশ্বের যেখানে অত্যাচার, অনাচার, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-শাসন, ফ্যাসিবাদী নির্যাতন, নির্মম আঞ্চলিক বৈষম্য বিরাজমান, সেসব এলাকার মানুষের জন্য শেখ মুজিব এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ, সোচ্চার প্রতিবাদ, স্বৈরতন্ত্র ও সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অনড় চ্যালেঞ্জ; বাস্তব, প্রাণবন্ত ও নির্ভেজাল গণতন্ত্রের প্রতীক এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার বিমূর্ত প্রকাশ। অন্যান্য বহু প্রসঙ্গ না টেনেও শুধু নেতা প্রণীত ছয় দফা কর্মসূচির আলোকেই উপরিউক্ত সত্যকে নির্দ্বিধায় প্রতিষ্ঠিত করা যায়। বঙ্গবন্ধুর ছয দফা যদিও পাকিস্তানের দুটি বিচ্ছিন্ন অংশের আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণের একটা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মসূচি ছিল, ১৯৭১-এ সেটা বাংলাদেশের জন্য এক দফায় রূপান্তরিত হলেও অদূর ভবিষ্যতে এর আবেদন চিরন্তন বলেই আমাদের বিশ্বাস। ছয় দফাই পরিণত হয় এক দফায় ‘স্বাধীনতা’। ইচ্ছা করলেই শুধু বাঙালির দাবির সঙ্গে সামান্যতম অবহেলা প্রদর্শন করলেই তিনি হতে পারতেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। সব হুঙ্কার, পাকিস্তানের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ৭ মার্চ যেই ঐতিহাসিক ঘোষণা দিলেন, ইতিহাসে তা বিরল। তাই আজ ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের কাছে স্বীকৃত এক আন্তর্জাতিক দলিল।

এই চেতনাবোধের গভীরতা আর ব্যাপ্তির পেছনে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ কর্ম-প্রচেষ্টা এবং সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রোগ্রাম। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আর পাকিস্তান ভগ্নোন্মুখ। বিদ্রোহ ও বিক্ষোভ ঘনায়িত। পাকিস্তানের অস্তিত্ব প্রায়-বিলীয়মান। এই মুহূর্তে ভগ্নোন্মুখ পাকিস্তানের আশু বিচ্ছিন্নতা রোধের জন্য প্রয়োজন বঙ্গবন্ধু প্রণীত ছয় দফা কর্মসূচির অনুরূপ কোনো বাস্তব ও বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ। যে ছয় দফার আক্ষরিক প্রয়োগ হয়তো সেখানে সম্ভব নয় কিন্তু তার গভীরতম অন্তরে নিহিত চূড়ান্ত বক্তব্যটিকে গ্রহণ করতেই হবে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদও প্রণেতাদের ধ্যান-ধারণাকে অতিক্রম করে অবস্থা ও অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে রূপান্তরিত হয়েছে। বাস্তব প্রয়োগ ক্ষেত্রে লক্ষিত হয়েছে বিভিন্নতা। এটা নিতান্ত স্বাভাবিক এবং স্বাভাবিক বলেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্রে কতকগুলো মৌলিক পার্থক্যও রয়েছে।

যা বলছিলামÑ নীতিবিবর্জিত রাজনীতি। ’৯১-’৯৬-তে বিএনপির মন্ত্রী, ’৯৬-এর নির্বাচনে এসে আওয়ামী লীগে মনোনয়নপ্রত্যাশী এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থী। জয়-পরাজয় তাদের কাছে তুচ্ছ। পুনরায় ১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, ২০০১-এ আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিতে না চাইলে ছোটেন হাওয়া ভবনের দিকে, মাঝপথ থেকে ফিরিয়ে এনে পুনরায় মনোনয়ন দেওয়া হয়। দলীয় আদর্শ, দলীয় আনুগত্য যাদের কাছে মুখ্য নয়, উদ্দেশ্য শুধু এমপি হওয়া এবং এলাকায় জমিদারিত্ব বহাল রাখা। মানুষের খাদেম হওয়া নয়। সেই ক্ষেত্রে গান্ধীজির অমোঘ বর্ণীত ‘নীতিবিবর্জিত রাজনীতি এক মহাপাপ’-তাদের জন্যই নিবেদন।

বর্তমান গণতান্ত্রিক চর্চায়, আদর্শ ও নৈতিকতা কি বিবর্জিত হবে? সমাজতন্ত্রের চেতনা ধূলিসাৎ হওয়া, সমাজতান্ত্রিক ধব্জাধারী জনগণ আজ কীসের বিরোধিতা করছেন বরং তারা বিভিন্ন উগ্র ধর্মীয় শক্তিকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগ দ্বিধাবিভক্ত হলো, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশে, নেপথ্যের কারণ কী, রাজনৈতিক গবেষকরা হয়তো কখনো খুঁজে পাবেন না। সেটা কোনো নীতি বা আদর্শের দ্বন্দ্ব ছিল না। অতি উচ্চভিলাষী কিছু লোকের ধারণা বা কৌশলের বাইরে গিয়ে দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়াটাই ছিল তাদের কাছে অপ্রাপ্তি। যেই আদর্শ নিয়ে চারটি মৌলিক চেতনা নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেই চেতনা থেকে সরে গিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ছাত্রলীগের একটি মেধাবী গ্রুপকে ধ্বংস করে দিলেন, কীসের স্বার্থে? ১৯৭৩ সালে জাসদ ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এক সম্মেলনে তখনকার ছাত্রনেতা মাহমুদুর রহমান মান্না তার বক্তৃতায় ছাত্রদের কাছে সহজ প্রশংসার জন্য এক উদ্ধৃতি দিলেনÑ ‘এক ইন্দিরা তিন মুজিব’। তারপর উনি ব্যাখ্যা করলেন বাংলাদেশের ১০০ টাকা সমান ভারতের ৩৩ টাকা।

তাই এক ইন্দিরা সমান তিন মুজিব। আজকের মান্নার নীতিবিবর্জিত রাজনীতি দেখে মনে হচ্ছে, মান্না কোনো মানুষের সঙ্গে তুলনীয় নয়, অন্য কোনো কিছুর সঙ্গেই তুলনা চলে। তবে বঙ্গবন্ধুকে উপমহাদেশের এক মহান নেত্রীর সঙ্গে তুলনা করায় স্বস্তিই পেয়েছিলাম। এবারের নির্বাচনে যেভাবে দলবদল বা নীতি বিসর্জন হচ্ছে, তা দেখলে হয়তো মহাত্মা গান্ধী আত্মহত্যার পথ বেছে নিতেন।  একজন বয়স্ক মানুষ যখন জীবনের ক্রান্তিকালে এসে নানা অজুহাতে আদর্শ ত্যাগ করে এবং বিশেষত নির্বাচনের সময় দল ত্যাগ করে তার চেয়ে বড় জ্ঞানপাপী আর কেউ হতে পারে না, এ বিশ্বাসে আমি অটল থাকব। শুধু আদর্শ ত্যাগ নয়, নতুন আদর্শ গ্রহণ ৭০-৮০ বছর বয়সে, তা পাপিষ্ঠদেরও হার মানায়।

লেখক : সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর