রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

গুনাহ মাফ করানোর রাত শবেবরাত

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

গুনাহ মাফ করানোর রাত শবেবরাত

ফারসি শব মানে রাত। বরাত মানে মুক্তি। শবেবরাত মানে মুক্তির রাত। নাজাতের রাত। শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে শবেবরাত বলা হয়। আল কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘... সুস্পষ্ট সত্য প্রকাশ করে দেয় যে গ্রন্থ তার শপথ! নিশ্চয় এক বরকতময় রাতে আমি এ গ্রন্থ নাজিল করেছি। আর এভাবেই আমি মানুষকে সতর্ক করে আসছি।’ দেখুন সূরা দুখান, আয়াত ১-৩। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর ছাত্র হজরত ইকরিমা (রা.) বলেন, ‘লাইলাতিম মুবারাকাতিন তথা বরকতময় রজনি হলো শাবানের ১৫ তারিখ রাত।’ দেখুন তাফসিরে বাগাভি, সপ্তম খণ্ড।

আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) বলেন, ‘মধ্যশাবানের রাতে লাওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আসমানে কোরআন নাজিল হয়। পরে রমজান মাসে কদরের রাতে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর “ইকরার” মাধ্যমে দুনিয়ায় কোরআন নাজিলের সূচনা হয়। অর্থাৎ কোরআন নাজিল হয় মোট দুবার। প্রথমবার লাওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আসমানে। আর এটা ছিল শবেবরাতে। দ্বিতীয়বার প্রথম আসমান থেকে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর। এটা ছিল রমজান মাসে লাইলাতুল কদরে। লাওহে মাহফুজ থেকে যখন নাজিল হয় তখন পুরো কোরআন একসঙ্গে নাজিল হয়। আর প্রথম আসমান থেকে যখন নাজিল হয় তখন অল্প অল্প করে প্রয়োজনীয় অংশ নাজিল হতে থাকে। এভাবে পুরো কোরআন নাজিল হতে লাগে দীর্ঘ ২৩ বছর।’ দেখুন তাফসিরে জালালাইন।

আল কোরআনের শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার ইমাম তাবারি (রহ.) বলেন, ‘শবেবরাতে প্রথম আসমানে কোরআন নাজিল হয়েছে। এ ছাড়া এ রাতে সৃষ্টিরাজ্যের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়। যেমন সূরা দুখানের ৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, “ওই বরকতময় রাতে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।” বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায়, শবেবরাতে আগামী এক বছরে কে জন্ম নেবে আর কে মারা যাবে, কার রিজিক বাড়ানো হবে, কার রিজিক কমানো হবে, কে হজে যাবে কে যাবে না- এমনিভাবে প্রতিটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। শুধু তাই নয়, এ রাতে বিগত এক বছরে কে কী আমল করেছে সে সম্পর্কেও আল্লাহর কাছে প্রতিবেদন পেশ করা হয়।’ দেখুন তাফসিরে তাবারি, দশম খণ্ড। এ তাৎপর্যপূর্ণ রাতের করণীয় সম্পর্কে হজরত আলী (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘হে আমার উম্মত! তোমরা শবেবরাতে নফল নামাজ পড় এবং দিনে রোজা রাখো। এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহতায়ালা প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তিনি বান্দাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হন। গুনাহগার বান্দার দিকে মায়ার নজরে তাকান। পৃথিবীর মানুষকে তিনি ডাকতে থাকেন, কে আছো গুনাহ করতে করতে নিজেকে কলুষিত করে ফেলেছ? এসো! আমি ক্ষমার চাদরে তোমাকে জড়িয়ে নেব। কে আছো রিজিকের অভাবে কষ্টের জীবনযাপন করছ? আমি তোমাকে দুই হাত ভরে রিজিক দেব। কে আছো যার রোগযন্ত্রণায় জীবন বিষিয়ে উঠেছে? আমি তোমাকে সুস্থতার নিয়ামত দেব। এভাবে ফজর পর্যন্ত আল্লাহ ডাকতে থাকেন।’ দেখুন সুনানে ইবনে মাজাহ।

হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘এক রাতে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডেকে বলেন, হে আয়শা! তুমি কি জানো আজ কোন রাত? আজ হলো শাবানের মধ্যরজনি। এ রাত বড়ই বরকতময়! বড়ই ফজিলতপূর্ণ রাত। এ রাতে আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমতের ডানা বিছিয়ে দেন। বনি কালব গোত্রের ভেড়া-বকরির পালের পশমের সমানসংখ্যক গুনাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন।’ দেখুন তিরমিজি। হে আমার দরদি পাঠক! জীবনে কত গুনাহই না করেছি আমরা। সব গুনাহ মাফ নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাদের। শবেবরাত আমাদের সব গুনাহকে ধুয়েমুছে পবিত্র করে রমজানের সিঁড়িতে দাঁড় করিয়ে দিতে চায়। যেন এ রমজান আমাদের মুত্তাকি বানিয়ে জান্নাতের সিঁড়িতে পৌঁছে দিতে পারে। তাই আসুন! শবেবরাতের সুযোগ কাজে লাগাই। জীবনের সব গুনাহ মাফ করিয়ে তবেই রমজানে প্রবেশ করি। হে আল্লাহ! আপনার ক্ষমার শিশিরে সিক্ত হওয়ার তাওফিক আমাদের দিন। শবেবরাতকে আমাদের নাজাতের অসিলা বানিয়ে দিন।

 

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর