সোমবার, ২৭ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

সুশাসন কি অধরাই রয়ে যাবে?

তুষার কণা খোন্দকার

সুশাসন কি অধরাই রয়ে যাবে?

বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু আছে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী দেশের অভিভাবক। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ কয়েক বছর ধরে প্রায় প্রতিদিন আমাদের নিত্যনতুন উন্নয়নের বার্তা দিচ্ছেন। পত্রিকার পাতায় খবর পড়তে গিয়ে কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় খবর দেখতে গিয়ে আমরা ক্রমাগত উন্নয়নের খবর পেতে থাকি। উন্নয়নের গৌরবগাথা শুনতে সত্যি ভালো লাগে। উন্নয়নের খবরগুলো শুনে আমরা সাধারণ মানুষ ভাবি দেশ সঠিক পথে এগিয়ে চলেছে। চারপাশে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই এত উন্নয়ন করতে সক্ষম একটি সরকারের হাতে দেশ বর্তমানে নিরাপদ আছে। আরও বিশ্বাস করি, আমাদের সামনে অমিত সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। দেশজুড়ে শহর কিংবা গ্রাম সর্বত্র বয়ে যাওয়া উন্নয়নের জোয়ারে অনর্গল ভেসে যেতে ইচ্ছা করে। এত উন্নয়নের পরও আমাদের মনের গভীর থেকে অনিশ্চয়তার দোলাচল দূর হচ্ছে না। মনে হচ্ছে উন্নয়নের সব চেষ্টা ইট-কাঠ-পাথরে আটকে গেছে। রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট কিংবা বড় বড় দালান আমাদের দেশের উন্নয়নের প্রতীক হয়ে গেছে। কিন্তু অন্যান্য সামাজিক ইস্যু যাকে সভ্য দেশে উন্নয়নের মাপকাঠি বলে বিবেচনা করা হয় সেগুলো ভয়ানক অবহেলিত।

প্রত্যাশাপূর্ণ উন্নয়নের খবর বাদ দিলে টেলিভিশনের পর্দায় আমরা যা দেখি কিংবা পত্রিকার পাতায় যেসব খবর ছাপা হয় সেগুলো ভয়ানক হতাশাব্যঞ্জক। প্রতিদিন বীভৎস খুনের খবর দেখে মানুষের গায়ে কাঁটা দেয়। বাস, ট্রাকের ড্রাইভাররা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে সড়কে নির্বিচার নরহত্যা করে হাসতে হাসতে পার পেয়ে যাচ্ছে। বাসের ড্রাইভার, হেলপার মাত্রই যেন ধর্ষক এবং খুনি। পরপর দুটি মহিলা যাত্রীকে যেভাবে বাসের ড্রাইভার ও হেলপাররা ধর্ষণ এবং হত্যা করেছে তাতে মনে হয় বাংলাদেশে প্রতিটি বাসের ড্রাইভার এবং হেলপার স্বভাবগত ধর্ষক এবং খুনি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমাদের চারপাশে অসংখ্য খুনির অবাধ বিচরণ। দেশের সব জায়গায় ভয়ঙ্কর খুনিরা নির্দ্বিধায় নরহত্যা করে বেড়াচ্ছে এমন ভাবনা আমরা মাথা থেকে দূর করতে পারছি না। খুনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধর্ষণের মাত্রা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্ক আমাদের ক্রমাগত গিলে ফেলতে শুরু করেছে; যা অস্বীকার করার উপায় নেই।

দেশে উন্নয়নের খবর বাদ দিলে বাকি সব খবর মনের মধ্যে ভয়ঙ্কর ভয়ের জন্ম দেয়। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিন আমাদের মনকে রক্তাক্ত করছে। দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা বহাল আছেন সেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলো আগে-পিছে পুলিশ পাহারা নিয়ে পথ চলেন। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা পড়ার আতঙ্ক নিয়ে তাদের পথ চলতে হয় না। যে ভিআইপিরা এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন, আগে-পিছে পুলিশের গাড়ি ভেঁপু বাজিয়ে যাদের পথচলা নিষ্কণ্টক করে দেয় তারা আমাদের জীবনের অনিশ্চয়তা বুঝবেন এমনটা আশা করাও অনুচিত। আমরা সাধারণ মানুষ যারা সড়ক দুর্ঘটনার আতঙ্ক নিয়ে পথ চলি তারা সড়কে গাড়িচাপা পড়ে মরাকে দুর্ঘটনা বলি না। আমরা বলি সড়কে নরহত্যা। মোটরগাড়ির ড্রাইভাররা মালিকের মদদ ও কর্তৃপক্ষের প্রশ্রয় পেয়ে নির্বিকারচিত্তে সড়কে নরহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা জানে, বেপরোয়া বেগে গাড়ি চালিয়ে মানুষ খুন করা স্মার্ট ড্রাইভিংয়ের অংশ। যে যত বেগে গাড়ি চালিয়ে সবার আগে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে তার কোম্পানির থলিতে লাভের টাকা বেশি জমা হবে। লাভের টাকার পোঁটলা থেকে কোথায় কাকে কত টাকা পৌঁছে দেওয়া দরকার সেসব সুলুক-সন্ধি মালিক খুব ভালো করে জানে। মালিকের মদদে ড্রাইভার নির্বিচারে নরহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। সে জানে মালিকের পকেট লাভের টাকায় ভরে রাখতে পারলে সেই টাকার ভাগ তার পকেটেও আসবে। বেপরোয়া ড্রাইভিং করতে গিয়ে সড়কে কত মানুষ চাকার তলে পিষ্ট হচ্ছে, কত মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মরার বাড়া যন্ত্রণা নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে সেসব নিয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষ কিংবা বাসের মালিক-শ্রমিক কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। ড্রাইভার বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে এতটুকু দ্বিধা করছে না, কারণ সে জানে মাকড় মারলে ধোকড় হয়। বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মানুষ মারলে ড্রাইভারকে বাঁচানোর লোকের অভাব নেই। কর্তৃপক্ষ যেখানে টাকার কাঙাল সেখানে আইন-কানুনের কথা শিকেয় তুলে রাখাই ভালো। সড়কে নরহত্যার বিচার চেয়ে পাষাণের পায়ে মাথা কুটে লাভ কী! সরকারি কর্তৃপক্ষের সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর প্রতিশ্রুতি এখন একদম কাগুজে। টেলিভিশনের স্ক্রলে তিনটি খবর দেখানো হলে তার একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন পনের-বিশ জন মানুষের মৃত্যু কারও মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পারে না। সরকারি কর্তৃপক্ষ যদি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তিদের জন্য শোকবাণী দেওয়ার তাগিদ বোধ করতেন তাহলে প্রতিদিন শোকবাণী লেখার জন্য তাদের বাড়তি লোকবল নিয়োগ করতে হতো। সড়ক দুর্ঘটনায় দৈনিক বিশ জন মানুষ মরলেও কর্তৃপক্ষ যেহেতু শোকাতুর বোধ করছে না কাজেই তাদের শোকবাণী লেখার ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে না কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ সড়কে নরহত্যার সংখ্যা দেখে আতঙ্কে কুঁকড়ে মরছি। বাস মালিক ও ড্রাইভার-হেলপাররা দেশের আইন-আদালতের চেয়ে অনেক বেশি শক্তির অধিকারী। চলন্ত বাসে ড্রাইভার গলা ছেড়ে হুকুম দেয়, হেলপার যাত্রীকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে পিষে দিয়ে হাসতে হাসতে চলে যায়। এমন ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলে মেনে নিতে না চাইলে মোটরযান মালিক ও শ্রমিক সবাই একাট্টা হয়ে তেড়ে জনগণকে মারতে আসে। বলে এটি নরহত্যা নয়। অবহেলাজনিত নরহত্যার ধারায় মামলা না দিলে মোটরযান শ্রমিকরা ধর্মঘট ডেকে দেশকে অচল করে দেয়। সরকারের ক্ষমতাসীন লোকেরা মোটরযান শ্রমিকদের জন্য যেভাবে প্রকাশ্যে সাফাই গায় তা দেখে জনমনে হতাশা দানা বাঁধে। উচ্ছৃঙ্খল, ধর্ষক, নরহত্যাকারী, দুর্বৃত্ত মোটরযান শ্রমিকদের নেতা কত রঙে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে যাচ্ছে কিন্তু তাকে থামানোর দুঃসাহস কারও নেই। সড়ক দুর্ঘটনার পাশাপাশি সম্প্রতি চলন্ত বাসে নারী ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলছে। পরপর দুটি ঘটনা রুপা হত্যা ও নার্স সোনিয়া হত্যার বর্ণনা সুস্থ চিন্তার মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। ভেবে দেখুন, একটি বাসে একজন ড্রাইভার এবং তার দু-তিন জন হেলপার তারা প্রত্যেকে ধর্ষক ও নরহত্যাকারী। অর্থাৎ এখন আমরা যেসব বাসে প্রতিদিন যাত্রী হিসেবে চলাচল করছি তারা ভাবতে বাধ্য হচ্ছি সেই বাসের চালক এবং হেলপার এরা প্রত্যেকে ধর্ষক ও নরহত্যাকারী কিনা। রুপা ধর্ষণ ও হত্যার পরে নিম্ন আদালতে অপরাধীদের বিচার হলেও উচ্চ আদালতে বিচার কোথায় কী পর্যায়ে আছে জনগণ তা জানে না। রুপা হত্যার বিচার যদি পরিণামে পৌঁছাত, জনগণ যদি ধর্ষক ও হত্যাকারীদের রায় কার্যকর হতে দেখত তাহলে সোনিয়াকে হত্যা করার আগে অপরাধীরা একবার ভেবে দেখার কথা ভাবত। ধর্ষক ও হত্যাকারীদের রায় কার্যকরের খবর আমরা জানি না, কাজেই অপরাধীরা ভাবছে মাকড় মারলে ধোকড় হয়। মেয়ে মানুষকে ধর্ষণ করে হত্যা করলে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। ওসব আসলে কাগুজে বিষয়। আসলে হয়তো ওদের শাস্তি কখনো কার্যকর হয় না। বাস্তবে হয়তো ভিন্ন কিছু ঘটে, পাঁচ-দশ বছর পরে হয়তো ওদের কারও ফাঁসিও হয়; কিন্তু জনমনের ধারণাকে আমি তুলে ধরছি।

প্রতিদিন এত বেশি নরহত্যা ও ধর্ষণের খবর আমাদের অসুস্থ করে তুলছে। সরকার বলবে, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সামাজিক মূলবোধের অবক্ষয় হওয়ায় মানুষ বিকৃত স্বভাবের পিশাচে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ এমন মূল্যবান ফতোয়ায় শান্ত থাকতে চাচ্ছে না। তারা ভাবছে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে এত মানুষকে মেরে ফেলার নিশ্চয়ই প্রতিকার আছে। সরকার আন্তরিক হলে সড়কে নরহত্যা কমিয়ে আনতে পারে। সরকার উদ্যোগী হলে বাসের ড্রাইভার, হেলপাররা মানুষরূপী পশুর পরিচয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। সরকার বিশ্বাস করুক না করুক, দেশের মানুষ অসহায় ক্রোধ নিয়ে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু সরকার কার্যকর কিছু করছে বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। সরকারের উদাসীনতা দেখে মনে হয় বাংলাদেশের উন্নয়ন যেন রড-ইট-সিমেন্টের গায়ে আটকে গেছে। চারদিকে রাস্তা-সেতু-দালানের ভিড়ে মানবতা আর প্রকৃতি একযোগে দম বন্ধ হয়ে মরছে। ইট-রড-সিমেন্টের উন্নয়নের সঙ্গে মানবতার মিশেল না হলে অবস্থার উন্নতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সুশাসন সুদূরপরাহত। দেশে একদিন সুশাসন আসবেÑ এ আশ্বাস নিয়ে মানুষ আর বাঁচতে পারছে না। সুশাসনের প্রত্যাশা করতে গিয়ে ভাবছি, দেশের বর্তমান মুক্তকচ্ছ - ভবিষ্যৎ হোঁচটে ভরা। বাঙালিকে বোধহয় আরও অনেক দিন উত্তাল সাগরে নৌকা বাইতে হবে। কূলের দিশা ‘দিল্লি হনুজ দুরস্ত’।               

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর