মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

তাজউদ্দীন আহমদ : জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

শারমিন আহমদ

তাজউদ্দীন আহমদ : জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

আমি যখন স্কুলে ক্লাস ফাইভের ছাত্রী তখন আমাদের একটি পাঠ্যবইয়ের নাম ছিল ‘এ নহে কাহিনী’। যত দূর মনে পড়ে বইটি ছিল বাংলা দ্রুত পঠনের। ওই বইটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল নানা বরেণ্য ও আলোকিত ব্যক্তির গল্প। যেমন বাঙালি মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া হাজারো প্রতিকূলতার মাঝে শুধু নিজে শিক্ষা লাভ করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি সেই জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন পশ্চাৎপদ নারীসমাজের সামনে এগিয়ে চলার দিশারিরূপে; জেরুজালেমে ক্রুসেডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী সেনাপতি সালাহউদ্দিন আইয়ুবি চিকিৎসকের বেশে প্রবল প্রতাপান্বিত ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড দ্য সেকেন্ডকে সেবা করে সুস্থ করে তুলেছিলেন। বিজিতদের প্রতি তার মানবিক আচরণের জন্য তিনি ইউরোপে খ্যাতি লাভ করেছিলেন ‘সালাদিন দ্য গ্রেট’রূপে; বাঙালি রেনেসাঁর অন্যতম পথিকৃৎ জ্ঞানতাপস ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অসুস্থ মাকে দেখতে ঝড়-বাদলের মধ্যে নৌকা না পেয়ে সাঁতার দিয়ে উত্তাল দামোদর নদ পার হয়েছিলেন; এমনি ধরনের মহানুভবতা-ভরা অনুকরণীয় ও অনুপ্রেরণাময় গল্পগুলো আমাদের বাল্যকালের ঊষালগ্নের দিনগুলোকে সমৃদ্ধ করেছিল ও ভবিষ্যতের পাথেয় হয়েছিল। শিশু-কিশোরদের চরিত্র গঠনের জন্য এবং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশক হিসেবে এ ধরনের জীবনগাথার গুরুত্ব অপরিসীম। এ ধরনের গল্প, জীবনী ও স্মৃতিচারণা হলো ইতিহাসের মণিমুক্তাসম উপাদান; জাতির পথ-নির্দেশক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘ইতিহাস সত্য প্রকাশের জন্য’। সে কারণে ঐতিহাসিক সত্যকে লুকানো ইতিহাস বিকৃতিরই নামান্তর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সফল কা-ারি মুক্তিযুদ্ধকালীন ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের জন্মভূমি কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে এ বছরের শুরুতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য পাঠ্যবই বিতরণ অনুষ্ঠানে যখন যোগদান করি, তখন আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ে চোখ বুলাই। বইগুলোয় তার জীবনী চোখে পড়েনি, তাকে উল্লেখ করা হয়েছে অতিসংক্ষেপে। উদাহরণস্বরূপ ষষ্ঠ শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের মাত্র অর্ধ প্যারার একটি লাইনে যুক্ত হয়েছে শুধু তার নাম ও পদবিটি। ওই ন্যূনতম উল্লেখ থেকে আজকের শিশু-কিশোর তরুণ প্রজন্ম জানবে না বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে তার অসামান্য অবদান ও সাফল্যের কথা। তারা জানবে না যে, তাজউদ্দীন আহমদের সৎ, সাহসী, দূরদর্শী ও স্বাধীনতার প্রতি আপসহীন নেতৃত্ব ছাড়া আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন কখনই সম্ভবপর হতো না। স্বাধীন দেশের মাটিতে পাকিস্তান কারাগারে বন্দী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও সসম্মানে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতো না, যদি সেদিন বঙ্গতাজ মুক্তিযুদ্ধের হাল না ধরতেন। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গতাজ একে অন্যের পরিপূরক। একজনকে বাদ দিয়ে অন্যজনের ইতিহাস অসম্পূর্ণ। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতার প্রেরণা, বঙ্গবন্ধুর মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিল। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বঙ্গতাজ তার সুদক্ষ নেতৃত্বের গুণে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশেও ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনধারাকে সমুন্নত রেখে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে গড়ে তোলার জন্য তিনি আপ্রাণ সংগ্রাম করেছিলেন। তিনি ছিলেন স্বাধীনতার বাস্তবায়ক, স্বাধীনচেতা, নির্লোভ, নির্ভেজাল ও দুর্দান্ত রকমের এক সৎ রাজনীতিবিদ। কোনো কৃতিত্বের দাবি না করে তিনি পরিণত হয়েছিলেন এক মহৎপ্রাণ আদর্শ রাষ্ট্রনায়কে।

ইতিহাস নির্মাণকারী এই অনন্য নেতা সম্পর্কে উল্লিখিত কথাগুলো ইতিহাসে নেই। স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতে নেই বা রাষ্ট্রীয় আলোচনায়, প্রতিফলনে ও উদ্যাপনে উল্লিখিত হয় না সেই কিংবদন্তিতুল্য ইতিহাস যখন একটি সেতুর নিচে আত্মগোপনরত অবস্থায় বঙ্গতাজ স্বদেশমুক্তির জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা প্রথম চিন্তা করেন অথবা যখন তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন, ‘এই যুদ্ধ বাংলাদেশের গণমানুষের যুদ্ধ। বাংলাদেশ চায় না যে ভারত তার সামরিক বল দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিক। এই স্বাধীনতার যুদ্ধটি করতে হবে বাংলাদেশের মানুষকেই। ভারত বাংলাদেশকে গণ্য করবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে।’ উহ্য রয়ে যায় সেই ইতিহাসও যখন নিজ দলের ভিতরের স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ সরকারবিরোধীরা স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য অপপ্রচারণা ছড়িয়েছিল। ‘বঙ্গবন্ধুকে চাও নাকি স্বাধীনতা চাও? বঙ্গবন্ধুকে পেতে হলে স্বাধীনতাকে পাবে না, আর স্বাধীনতাকে পেতে হলে বঙ্গবন্ধুকে পাবে না। যে কোনো একটিকে বেছে নিতে হবে।’ তাজউদ্দীন আহমদ তাদের এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেন তার আত্মপ্রত্যয়ে ভরা অঙ্গীকারকে বাস্তবে পরিণত করে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধুকেও চাই এবং স্বাধীনতাকেও চাই। স্বাধীনতা এলেই আমরা বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পাব।’

স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা আজকের তরুণরা পাঠ্যবই  থেকে এ কথাগুলো জানবে না। জাতীয় নীতি, কর্মসূচি ও আলোচনা থেকেও তারা কখনই খুঁজে পাবে না বঙ্গতাজকে। এর কারণ কী? কেন অনালোকিত আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতাযুদ্ধের পর্বটি? যার নেতৃত্বে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। এর কারণ খুঁজতে হবে নতুন প্রজন্মকেই। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই এবং তার নিজস্ব প্রয়োজনেই একদিন খুঁজে নেবে বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদকে। স্বাধীনতার ইতিহাস সেদিনই মুক্তি লাভ করবে। পাঠ্যপুস্তকে উল্লিখিত দু-একটি শব্দের ঘের ও রাষ্ট্রে তার অতি ক্ষুদ্র পরিসরে অবস্থানের গন্ডি পেরিয়ে কেউ যদি তার বিশালত্বকে খুঁজতে চান, তারা তাকে খুঁজে পাবেন বাংলাদেশের মানচিত্রে, পতাকায়, নদী-অরণ্যে, নিষ্পেষিত জনতার অটল বিদ্রোহে, শ্রান্ত মজুরের ক্লান্তি উপশমে, আর ওই বিপন্ন বালিকার ভরসার স্থলে। তাকে খুঁজতে গেলেই বাংলাদেশ খুঁজে পাবে নিজেকে।

 

লেখক : তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা।

 

সর্বশেষ খবর