বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

তসলিমার ক্রন্দন, শেয়ারবাজারে কবরের নিস্তব্ধতা

পীর হাবিবুর রহমান

তসলিমার ক্রন্দন, শেয়ারবাজারে কবরের নিস্তব্ধতা

১. মন কারও ভালো নেই আজ দেশে। একদিকে বন্যাকবলিত পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ, আরেকদিকে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপে ঘরে ঘরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, মৃত্যুর মিছিলে একজন সিভিল সার্জনসহ  ২৬ জনের নাম উঠেছে। মশা মারতে ব্যর্থ নগরপিতারা বড় বড় কথা বলেন, মানুষের স্বজন হারানোর বেদনা তাদের স্পর্শ করে না। লিখতে গেলে ভাঙা হৃদয়ে বেদনাবিধুর চিত্তে বিষাদগ্রস্ত হয়ে আরেকটি কথা ভাবী। কি অসভ্য এক সমাজে আমরা বাস করছি। বিবেক আমাদের নির্বাসিত। ন্যূনতম চিন্তাশক্তি লুপ্তপ্রায়। বিকৃত প্রতিহিংসা ও পাশবিক মনোবৃত্তি মনুষ্যত্বকে বিদায় দিয়ে ভিতরে পশুত্বের জায়গা দিয়েছে। সিরিজ ধর্ষণের ঘটনা গোটা সমাজকে অশান্ত, অস্থির ও আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলতে না তুলতেই পদ্মা সেতুতে মানুষের জবাই করা মাথার প্রয়োজন বলে একদল মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষ গোটা দেশে গুজব ছড়িয়ে দিয়েছে। একুশ শতকে বিজ্ঞানমনস্ক তথ্যপ্রযুক্তির চূড়ান্ত বিকাশলগ্নে মধ্যযুগীয় কাপালিকদের মতো এমন গুজবের জবাব দিতে হয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষকে। সামাজিক অপরাধ সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বাড্ডায় সাড়ে তিন বছরের কন্যাসন্তান তুবাকে স্কুলে ভর্তি করাতে খবর নিতে গিয়েছিলেন তাসলিমা বেগম রেণু। দুটো সন্তানকে নিয়ে একা জীবনের লড়াই তাকে থামিয়ে দিতে পারেনি। কিন্তু সেদিন একদল অসভ্য জানোয়ার সংঘবদ্ধভাবে স্কুল থেকে তাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে গণপিটুনি দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ঠান্ডা মাথার খুনিরা মানুষ হত্যার এমন বীভৎস চিত্র ভিডিও করে ভাইরাল করেছে। মানুষের কলজে ছিঁড়ে কান্না এসেছে। জানুয়ারিতেই মহিলার সন্তানদের নিয়ে আমেরিকা চলে যাওয়ার কথা ছিল। ছেলেধরার গুজবে আরও হত্যা ও পিটিয়ে আহত করার ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্র মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। সমাজ এখন আর আগের মতো মানবিক মূল্যবোধ ও মায়া-মমতা লালন করে না। নষ্ট সমাজ নষ্ট হতে হতে এমন জায়গায় থেমেছে যেখানে সংঘবদ্ধভাবে মানুষ হত্যার বিকৃত উৎসবে মহাবীরের মতো যোগ দিতে পারে। কিন্তু চোখের সামনে সংঘটিত কোনো অপরাধ বা হত্যাকা- প্রতিরোধে এগিয়ে যেতে পারে না। গোটা সমাজ আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। মানুষ এখন আতঙ্কগ্রস্ত। শুধু প্রশাসন নয়, মানুষেরও সামাজিক নাগরিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। উসকানিমূলক গুজব কেউ ছড়ালে তার সম্পর্কে পাশের থানায় পুলিশের কাছে খবর দেওয়া যায়। কেউ চোখের সামনে অপরাধ করলে পুলিশকে খবর দেওয়া দায়িত্ব। এমনকি কাউকে ছেলেধরা সন্দেহ হলে আইন হাতে তুলে না নিয়ে পুলিশকে জানানো প্রয়োজন। সভ্য সমাজের এটাই রীতি। আইন হাতে তুলে নিয়ে মানুষ হত্যা জঘন্য অপরাধ। যারা হত্যাকা- ঘটাচ্ছে তারা খুনি। সংঘবদ্ধ খুনিদের সন্ধান এখন পুলিশের কাছে দেওয়া জরুরি।

বরগুনায় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত নয়ন বন্ডের নেতৃত্বে যে সন্ত্রাসী ও মাদকবাহিনী গড়ে উঠেছিল তার সঙ্গে যে স্থানীয় এমপিপুত্রের গভীর স্বার্থের সম্পর্ক তা এখন খোলাসা হয়ে গেছে। পুলিশ সুপার মারুফ হোসেনের সোর্স ছিল নয়ন বন্ড। মাদক নিয়ে ধরা পড়ার পরও তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রকাশ্য দিবালোকে রিফাতকে যেভাবে মধ্যযুগীয় কায়দায় হত্যা করা হয়েছে সেই দৃশ্য গোটা দেশ দেখেছে। তার স্ত্রী মিন্নি চেষ্টা করেও স্বামীকে বাঁচাতে পারেননি। ফেনীর ঘটনার পর একদল পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা নষ্ট হয়। বরগুনার ঘটনাপ্রবাহকে নাটকের পর্ব বলেই মনে করছে অনেকে। কারণ, সাক্ষী মিন্নি হয়ে গেলেন আসামি! পাঁচ দিনের রিমান্ড তার আগে ১২ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদ সব মিলিয়ে চরম মানসিক নির্যাতন। মিন্নির শ্বশুর হঠাৎ তার বিরুদ্ধে চলে গেলেন। এমপিপুত্র মিন্নি গ্রেফতারের আগের দিন মানববন্ধন করে তাকে আটক করার দাবি জানালেন। এমনকি অর্থ ও ক্ষমতার কাছে নত আইনজীবীরা মিন্নির পাশে দাঁড়ালেন না। বরগুনার ভয়াবহ হত্যাকান্ড  ঘিরে দেশজুড়ে এখন ন্যায়বিচার নিয়ে রহস্য আর কৌতূহল। প্রশ্ন আর প্রশ্ন। সব মিলিয়ে দেশের মানুষ শান্তিতে নেই। এমনি অবস্থায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক একসময়ের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী, এনজিও সংগঠক, প্রিয়া সাহা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে গিয়ে বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ সংখ্যালঘু গুম ও তার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া এবং দখল করার নির্জলা মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, বিদ্যমান সম্প্রীতির বন্ধনকে আঘাত করে সরকার, সমাজ ও জনগণের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দুঃসাহস দেখিয়েছেন চলমান ঘটনাবলির সঙ্গে যোগ করলে বলতে হয় এক গভীর ষড়যন্ত্রের জাল কোথাও না কোথাও বিস্তার হচ্ছে। আলামত ভালো নয়। দেখে রীতিমতো ভয় লাগছে।

২. দেশের শেয়ারবাজারে এখন রীতিমতো কবরের নিস্তব্ধতা বিরাজমান। সেই ৩২ লাখ বিনিয়োগকারীর পর এবার ২৬-২৭ লাখ বিনিয়োগকারী রিক্ত-নিঃস্ব। ব্রোকার হাউসগুলো এখন বন্ধ হওয়ার পথে। এর আগে অনেক ছাঁটাই ও বন্ধ করার ঘটনা ঘটেছে। এবারের মতো শেয়ারবাজারের পতন ইতিহাসে আর কখনো হয়নি। প্লেসমেন্ট শেয়ারের কারসাজি করে গত তিন বছরে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা একটি চক্র লুটে নিয়ে গেছে। রবিবার এক দিনে ৫ হাজার কোটি টাকা পুঁজি হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. খায়রুল হোসেন দায়িত্ব গ্রহণকালে বলেছিলেন, ‘তিন মাসের মধ্যে আমরা শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাব।’ কিন্তু তার দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় ১০ বছর হয়ে গেছে। তার ভাগ্য বদলেছে। কমিশনাররা আরাম-আয়েশে আছেন। মাঝেমধ্যে সেমিনার আর নানা সম্মেলনে মঞ্চে বরমাল্য নিয়ে বসেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে শান্তির ঘুম ঘুমান। বিদেশ ভ্রমণ করেন। আল্লাহর করুণালাভে হজেও যাচ্ছেন। কিন্তু অসংখ্য বাজে কোম্পানির শেয়ার যে মূল্যে বাজারে এনেছিলেন তার সাত ভাগের এক ভাগ কমও অনেকটির মিলছে না। অনেকটির মূল্য অস্তিত্বহীন। এদের বিরুদ্ধে যেমন সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন রহস্যজনক কারণে এমন পতনের পরও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না তেমনি সরকারও এ ধরনের ব্যর্থ কমিশনকে বদলে দিচ্ছে না। শেয়ারবাজারে চরম তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশন এখন নামসর্বস্ব সংগঠনে পরিণত। পুঁজিবাজার চাঙ্গা করতে ভূমিকা গ্রহণে চরম ব্যর্থ। ব্রোকার হাউসগুলোর মালিকরা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন। ব্যবসা কীভাবে গুটিয়ে আনবেন সেই চিন্তা অনেকে করছেন। প্লেসমেন্ট কারসাজির ভাগ যারা পেয়েছেন তারা কিছুটা ভালো আছেন। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের রাস্তায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিঃস্ব হতে হতে তারা শেষ। দেশের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে শেয়ারবাজার। সেই শেয়ারবাজার কবরে শায়িত করে দেশের অর্থনীতিকে নিয়ে গৌরব করার মতো কী আছে তা নিয়ে সবাই সন্দিহান। পুঁজিবাজারের মাধ্যমে অর্থনীতির রক্ত সঞ্চালনের চিত্রপট উঠে আসে। ব্যবসা-বাণিজ্য কতটা ভালো, বিনিয়োগকারীরা কতটা সুখে সেই চিত্র পাওয়া যায়। দেশের ব্যাংকগুলোয় যে হরিলুট হয়ে গেছে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী বার বার বলার পরও সুদের হার ব্যাংকগুলো এখনো সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনেনি। ঋণখেলাপিরা জীবিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। আর যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি দিয়ে যুদ্ধ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা রেখেছেন, দেশের উন্নয়নে অনবদ্য ভূমিকা রাখছেন তাদের কপালে কী জুটছে এই প্রশ্ন রয়েছে। আমাদের প্রবৃদ্ধি সাড়ে সাতে। ২০২১ সালের মধ্যে দুই ডিজিটে নিতে হলে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা, লুটপাট চিরতরে বন্ধ, সিঙ্গেল ডিজিট বাধ্যতামূলক এবং প্রকৃত ব্যবসায়ীদের নানা প্রণোদনাসহ সহজশর্তে ঋণদান ও শেয়ারবাজারকে যে কোনো মূল্যে অবিলম্বে চাঙ্গা করা জরুরি। বিনিয়োগকারীদের হতাশার গভীর থেকে বের করে এনে অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দিতে না পারলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। শেয়ারবাজারে মনিটরিং বডিকে দক্ষ সৎ লোক দিয়ে নতুন করে যেমন সাজানো প্রয়োজন তেমনি যারা কারসাজির সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় এনে বাজে কোম্পানির শেয়ার প্রবেশ বন্ধ করে দিতে হবে। বাজে কোম্পানির শেয়ার থাকলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগেও কোনো দিন পুঁজি ফিরে আসবে না, লাভ দূরে থাক।

৩. নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভাঙার ও নারীর সমঅধিকারের লেখার সঙ্গে আমি একমত থাকলেও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা লেখার সঙ্গে কখনো একমত নই। বিভিন্ন সময় বহুল আলোচিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের লেখার সমালোচনাও করেছি। পারিবারিকভাবে জম্মের পর থেকে মা-বাবার কোরআন তিলাওয়াতে আমাদের ঘুম ভেঙেছে। মাগরিবের নামাজ পড়ে পড়তে বসা ছেলেবেলার অভ্যাস ছিল। মহান আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস ও আনুগত্যে কখনো আমার মনে দ্বিধা আসেনি। জম্মসূত্রেই নয়, বিশ্বাসেও আমি একজন মুসলমান। কিন্তু শৈশব থেকে পরিবার, সমাজ আমাকে সব ধর্মের বন্ধু-বান্ধব প্রিয়জনদের সঙ্গে আত্মিক বন্ধনে বেড়ে উঠতে শিখিয়েছে। আমাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত বাংলাদেশের চেতনা ও স্বপ্ন লালনে আমার কখনো বিচ্যুতি ঘটেনি। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধ, কুসংস্কার ও বর্ণবাদ এবং ধর্মের নামে, বর্ণের নামে জাতপাতের নামে মানুষকে শোষণ-নিপীড়ন বা হত্যার আমি বিরোধী। জীবনে কখনো ধর্মীয় কারণে কারও সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ, মনোমালিন্য বা বিরোধ যেমন হয়নি তেমনি হবেও না। বরং আত্মীয়স্বজন থেকে নিজ ধর্মের অনেকের সঙ্গে নানা কারণে নানা সময়ে বিরোধ হয়েছে। মনোমালিন্য হয়েছে। আমি ধর্মে বিশ্বাসী মুসলমান হলেও কোনো দিন কোনো ধর্মের প্রতি কটাক্ষ যেমন করিনি, তেমনি কোনো ধর্মের প্রতি অসম্মানও করিনি। কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার হীনমন্যতায় কখনো ভুগিনি। বরং ধর্মান্ধ অনেক আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। একটি গণতান্ত্রিক উদার রাষ্ট্র হিসেবে ব্রিটেন ও আমেরিকা আমার ভীষণ পছন্দের। সেখানে বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীর পাশাপাশি বিভিন্ন মত-পথের মানুষ নিরাপদে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারে। তেমনি ধর্মের প্রতি যাদের বিশ্বাস নেই তারাও শান্তিতে বসবাস করে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে ধর্মে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী নানা মত-পথের মানুষ বসবাস করবে। মানুষ মানুষের কাছে মানুষ হিসেবেই মূল্যায়িত হবে, সমাদৃত হবে, সম্পর্ক হবে মানুষে মানুষে চিন্তা ও মনের মিলে। কেউ কারও বিশ্বাস নিয়ে কটাক্ষ করলে, কারও মনে আঘাত দিলে সেখানে সম্পর্কে ফাটল ধরে। দূরত্ব বাড়ে। গণতান্ত্রিক সমাজে সব মত-পথের মানুষ ধর্মবিশ্বাসী থেকে ধর্মে অবিশ্বাসীরাও বসবাস করবে, এটা তার নাগরিক অধিকার। কয়েকদিন আগে ভারতে নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন একটি লেখা লিখেছেন। বিভিন্ন সময় তিনি লিখেন এবং তার ফেসবুকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে স্ট্যাটাস দেন। তার লেখা নিয়মিত পড়লেও ফেসবুক স্ট্যাটাস মাঝেমধ্যে দেখা হয়। রাজনীতি, সমাজ ও নারীর অধিকার নিয়ে লেখাগুলো আমাদের আকর্ষণ করে। কিন্তু ধর্মীয় সমালোচনামূলক লেখা থেকে আমি নিজেকে দূরে রাখি। তবে তসলিমা নাসরিনের যে গভীর বেদনাবোধ আমাকে তাড়িত করে, আমাকে আবেগাপ্লুত করে এবং আমার বিবেককে নাড়া দেয় সেটি হচ্ছে তার জš§ভূমিতে ফিরে আসতে না পারার ক্রন্দন। আমরা দেশের বাইরে সাত দিনের জন্য গেলে অস্থির হয়ে উঠি দেশে ফেরার জন্য। সেখানে বাধ্যতামূলকভাবে একজন স্বাধীনচেতা মানুষ অন্য দেশে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন, এটা যে কত কষ্টের তা অবর্ণনীয়। কারাগারে থাকলেও দেশের মাটির স্পর্শ পাওয়া যায়। দেশের আকাশ দেখা যায়। দেশের স্বজনকে কাছে পাওয়া যায়। জেল গেটে প্রিয়জনরা দেখা করতে পারেন। কিন্তু নির্বাসিত জীবন দুঃসহ যন্ত্রণার। তসলিমা নাসরিন লেখালেখির জন্য আলেম-ওলামাদের আক্রোশের শিকার হয়েছিলেন। ধর্মীয় নেতারা তার মাথার দাম ঘোষণা করেছিলেন। বিএনপির সেই শাসনামলে আদালত থেকে জামিন নিয়ে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। তারপর তার মা-বাবাসহ অনেকের মৃত্যু হয়েছে। তিনি তাদের পাশে থাকতে পারেননি। তসলিমাকে দেশছাড়া করে তাকে খ্যাতির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে দিয়ে দুনিয়াব্যাপী পরিচিতি এনে দিলেও তার বুকের ভিতরে অন্তহীন বেদনা ও ক্রন্দন রয়েছে দেশের জন্য। তার লেখা বিতর্কিত হলেও তার দেশপ্রেম প্রশ্নের ঊর্ধ্বে ছিল। সংবিধান তাকে লেখার স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা কতটা দিয়েছে আমি সেই আলোচনায় যাচ্ছি না। আমি মানবিক জায়গা থেকে প্রশ্ন রাখছি- ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীরা যদি এ দেশে নাগরিকত্ব নিয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারেন, স্বাধীনতাবিরোধীরা যদি এ দেশে সুখের জীবন কাটিয়ে মরতে পারেন একজন লেখিকা তসলিমা নাসরিন কেন আমৃত্যু নির্বাসিত জীবন কাটাবেন? তার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি। কিন্তু যার পূর্বপুরুষের ভিটামাটি বাংলায়, যার জম্ম ও বেড়ে ওঠা ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে, যার সংগ্রাম মানুষের অধিকারের জন্য তিনি কেন প্রায় ২৫ বছর নির্বাসিত জীবন কাটানোর পরও স্বদেশে ফিরে আসতে পারবেন না? একজন খুনিও এত দিনে জেল খেটে মুক্ত বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেন। সেখানে তসলিমা নাসরিনের অপরাধের সাজা কবে শেষ হবে? এরও তো একটা সীমা থাকা উচিত। স্বয়ং আল্লাহ যেখানে অসীম দয়াময় ও ক্ষমাশীল সেখানে আমরা দেশের মানুষ কেন এত হৃদয়হীন? তসলিমা নাসরিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যে খোলা চিঠি লিখেছেন তার শব্দে শব্দে আবেগ, যুক্তি ও বেদনার অশ্রু জড়িয়ে আছে। আমি বুঝতে পারি না তসলিমা নাসরিন যাদের অগ্রজ মনে করে সম্মান করে স্নেহ-সান্নিধ্যে থাকতেন, যাদের বন্ধু মনে করে কত সময় কাটিয়েছেন তাদের অনেককে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে বিভিন্ন মন্ত্রীর সামনে নানা সময় বসে থাকতে দেখি। কিন্তু অবাক হই বিবেকের দায় থেকে তারা কেউ তসলিমার জন্য একটি বার কিছু বলেন না। কেন বলেন না? আমি উত্তর খুঁজে পাই না। তসলিমা নাসরিনের শুধু দেশে ফেরার ওপরই নিষেধাজ্ঞা রাখা হচ্ছে না, তাকে তার ঢাকার শান্তিবাগের ফ্ল্যাটটি বিক্রি করার জন্য তার বোনকে যে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেবেন সেই সুযোগও বাংলাদেশ মিশন দিচ্ছে না। কেন দিচ্ছে না? এর জবাবও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিচ্ছে না। তিনি বলেছেন, তার ছোট বোনকে এই অধিকার দিতে যেসব নথিপত্র চাওয়া হয় তা নিউইয়র্কের ডেপুটি কনস্যুলার জেনারেল শহিদুল ইসলামের হাতে দেওয়ার পরও তিনি তা প্রত্যয়ন করেননি। দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনও একই অবস্থা করেছে। আমি বুঝতে পারি না দিল্লিতে হাইকমিশনার ছাড়াও প্রেস মিনিস্টার এএফপির ঢাকা ব্যুরোর চিফ হিসেবে কাজ করে অবসরে যাওয়া আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া সাংবাদিক ফরিদ হোসেন থাকার পরও এ কাজটি করে দিচ্ছেন না। দূতাবাসে দূতাবাসে ঘুরেও তিনি কেন সম্পত্তি সম্পর্কিত অধিকার পাবেন না? তিনি কি কোনো রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধী হিসেবে দন্ডিত ফেরারি বা তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছে? না হলে কেন একটি ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য দূতাবাস তার সামান্য অধিকারটুকু দেবে না? সরকারসহ সবার প্রতি মানবিক অনুরোধÑ পরিবারের অনেক স্বজনকে নির্বাসনে থেকে হারানোর বেদনা সয়ে তসলিমা নাসরিন অনেক শাস্তি পেয়েছেন। শোনা যায়, শরীরে এখন তার রোগশোকও বাসা বেঁধেছে। আল্লাহর ওয়াস্তে সবাই তাকে তার মাতৃভূমিতে ফিরে আসাসহ তার সব নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিন।

 

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর