সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

মুফতি হেলাল উদ্দীন হাবিবী

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

মানুষের মৌলিক অধিকার সমূহকেই মানবাধিকার বলে। আল্লাহ তায়ালা মানব-জাতিকে সর্বোচ্চ সম্মান, শ্রেষ্ঠত্ব ও পূর্ণ অধিকার দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাদের মর্যাদা ও অধিকার বাস্তবায়নে অসংখ্য নবী-রসুলকে এই ধরাপৃষ্ঠে পাঠিয়েছেন। ইসলামই সর্বপ্রথম মানবাধিকারের সুনির্দিষ্ট ধারণা মানবমস্তিষ্কে জন্ম দিয়েছে এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধকে ‘কবিরা গুনাহ’ বা ‘মহাপাপ’ বলে ঘোষণা করেছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা ও সংস্কৃতিনির্বিশেষে সব মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার ও জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদান করেছে। সর্বোপরি ইসলাম নারী-পুরুষ, শিশু ও সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা ও আইনের শাসন বাস্তবায়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। পক্ষান্তরে হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, রাহাজানিসহ সব অপরাধকে চিরতরে নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহ এ সম্পর্কে আল কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কাউকে হত্যা করল সে যেন মানবজাতিকেই হত্যা করল।’ সূরা মায়েদা, আয়াত ৩২। তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘তোমরা পরস্পরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না।’ সূরা বাকারা, আয়াত ১২৮।

মানবাধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আল্লাহ মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা কর তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে।’ সূরা নিসা, আয়াত ৫৮। নারী অধিকারের বিষয়ে রব্বুল আলামিন বলেন, ‘নারীদের তেমনি ন্যায়সংগত অধিকার আছে পুরুষদের ওপর, যেমন পুরুষদের আছে তাদের (নারীদের) ওপর।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ২২৮।

এ ছাড়া আরও অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ মানবাধিকার বাস্তবায়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছোটবেলা থেকেই মানুষের অধিকারের প্রতি অত্যন্ত যতœবান ছিলেন। এমনকি তাঁর ধাত্রীমা হালিমা সাদিয়া (রা.)-এর কাছে থাকাকালে স্বীয় দুধভাই আবদুল্লাহর অধিকারের প্রতি লক্ষ্য রেখে কখনো তার ধাত্রীমায়ের বাঁ স্তন থেকে দুধ পান করেননি। শুধু তাই নয়, তিনি মাত্র ২৫ বছর বয়সে মক্কা মুকাররমার বাসিন্দা ও আগত মেহমানদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান এবং মানবাধিকার বাস্তবায়নের  লক্ষ্যে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক একটি সেবামূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। আইয়ামে জাহেলিয়ায় দাস -প্রথা ব্যাপক প্রচলিত ছিল। সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা অর্থের বিনিময়ে একশ্রেণির মানুষকে দাসরূপে কিনত এবং তাদের প্রতি যারপরনাই জুলুম-অত্যাচার করত। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাসদের ওপর এহেন নির্যাতন-নিপীড়নের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক ও সচেতন করে বিদায় হজের ভাষণে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, ‘হে মানবজাতি! নিশ্চয় তোমাদের প্রভু এক। তোমাদের পিতা হজরত আদম (আ.) এক। অতএব সাবধান! অনারবের ওপর আরবের কিংবা আরবের ওপর অনারবের, শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের কিংবা কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’

দাসদের মর্যাদার ব্যাপারে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কোনো দাস যদি যোগ্যতার কারণে নেতৃত্ব পায়, তবে তোমরা তাকে মেনে চলবে।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘যে দাসদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’

আরবীয় জাহেলিয়া যুগে নারী জাতি ছিল চরম নির্যাতিত। তাদের মানবীয় ন্যায্য অধিকার ছিল ভূলুণ্ঠিত। অর্থ-সম্পদকে পুরুষ নিজেদের মালিকানা-স্বত্ব মনে করত। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর ছিল না কোনো নির্ধারিত অংশ। স্বামীর মৃত্যু বা তালাকপ্রাপ্তা হওয়ার পর ছিল না দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি। আরবীয় সমাজে নারীজন্মকে চরম অবমাননা, লাঞ্ছনা ও ঘৃণার কারণ মনে করা হতো। নারীজন্মের প্রতি তাদের ঘৃণা এতই প্রবল ছিল যে, নিষ্ঠুর পিতা নির্দয়ভাবে নিজ কন্যাকে জীবন্ত প্রোথিত করত। নারীর প্রতি এহেন অবহেলার ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সেই ব্যক্তি ভাগ্যবান যার প্রথম সন্তান হচ্ছে কন্যা।’ হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘জনৈক ব্যক্তি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলÑ হে আল্লাহ্র রসুল! আমার কাছে কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিক হকদার? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বলল তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল তারপর কে? তিনি বললেন তোমার মা। সে বলল তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার পিতা।’ বুখারি। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’

ইসলাম সংখ্যালঘুদের নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার এবং তাদের সম্পদ ও ধর্মীয় উপাসনালয়ের পূর্ণ নিরাপত্তার বিধান অক্ষুণœ রেখেছে। সংখ্যালঘুদের প্রতি কোনো প্রকার অমানবিক আচরণ ইসলাম সমর্থন করে না। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সম্পর্কে ইরশাদ করেন, ‘সাবধান! যে ব্যক্তি কোনো অমুসলিম নাগরিক বা সংখ্যালঘুকে অত্যাচার করে, তাদের অধিকার খর্ব করে, তাদের ওপর সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দেয় কিংবা জোরপূর্বক তাদের সম্পদ আত্মসাৎ করে, কিয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ দায়ের করব।’ আবু দাউদ। অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবাকে ইসলাম মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে গণ্য করেছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবতার বার্তা নিয়ে এ ধরাধামে আগমন করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তা কাল থেকে কালান্তর মানবেতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

লেখক : খতিব, মাসজিদুল কোরআন জামে মসজিদ, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর