বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিক্রম নেই?

তসলিমা নাসরিন

বিক্রম নেই?

পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব ৩৮৪,৪০০ কিলোমিটার। ভারতের চন্দ্রযান ২ প্রকল্প চাঁদে পৌঁছোনোর ২.১ কিলোমিটার আগে বিকল হয়ে যায়। তাহলে ইসরো যা বলছে, যে, এই প্রকল্প ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ সফল, এটা কি ঠিক? তাহলে কি মাত্র ৫ বা ১০ শতাংশ বাকি ছিল চূড়ান্ত সফল হওয়ার? শেষ ২.১ কিলোমিটার বিক্রমের সমগ্র যাত্রাপথের মাত্র ০.০০০৬ শতাংশ। সেটিই বাকি ছিল, সুতরাং ব্যর্থতার অনুপাতও কি ০.০০০৬ শতাংশ? ধরা যাক, তোমাকে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে গিয়ে একটি জায়গায় ১৪ দিন থেকে অত্যন্ত জরুরি কিছু কাজ করার দায়িত্ব দেওয়া হল। এখন তুমি যদি ময়মনসিংহে পৌঁছার আগে ত্রিশালের কাছে এসে পা ভেঙে বসে থাকো, ময়মনসিংহে যদি যেতেই না পারো, যে জায়গায় গিয়ে কাজ করার কথা, সে জায়গায় যেতেই না পারো, কাজটাই করতে না পারো, তাহলে তোমার প্রকল্প ৯০-৯৫ শতাংশ কী করে সফল হয়? তোমাকে যদি পাঠানো হতো ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে শুধু ভ্রমণ করতে, তাহলে ত্রিশাল পর্যন্ত গিয়ে থেমে পড়লে বলা যেতে পারতো তুমি ৯০ বা ৯৫ ভাগ সফল। কিন্তু তোমাকে তো একটা কাজের জন্য পাঠানো হয়েছে, যে কাজটি তুমি করতেই পারোনি, সেই কাজ শুধু অনেকটা যাত্রা সম্পন্ন করেছো বলে ৯৫ ভাগ সফল এটা বলা মানুষকে বোকা বানানো ছাড়া আর কিছু নয়।

বিক্রম গেল কোথায়? খোঁজ চলছে। কেউ কেউ অনুমান করেছে বিক্রম হয়তো মুখ থুবড়ে পড়েছে চাঁদের মাটিতে, এন্টেনা মাটিতে গেঁথে গেছে। অথবা মুখ থুবড়ে পড়েনি, কিন্তু এন্টেনা নষ্ট হয়ে গেছে কোনও কারণে, তাই অরবিটারকে কিছু জানাতে পারছে না। হয়তো সোলার প্যানেল নষ্ট হয়ে গেছে, শক্তি নেই যোগাযোগের। কত কিছুই হতে পারে। চাঁদ থেকে মাত্র ৩৩৫ মিটার দূরে থাকার সময়ই ইসরোর সঙ্গে বিক্রমের সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর কারণ যা অনুমান করা হচ্ছে, তা হলো, আলতো করে মাটিতে পড়ার বদলে বিক্রম পড়েছে জোরে। জোরে পড়লে যা হয় ভেঙে যায়, ও নষ্ট হয়ে যায়। সম্ভবত তাই হয়েছে। তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের মাধ্যমে এখন চেষ্টা চলছে বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ করার, অরবিটার থেকে ডাকা হচ্ছে বিক্রমকে, কিন্তু বিক্রম সাড়া দিচ্ছে না। বিক্রমের আয়ু মাত্র ১৪ দিন। ৩ দিন পার হয়ে গেছে। বাকি দিনগুলোয় যে সাড়া দেবে, এমন মনে হচ্ছে না। তাহলে মানতে কষ্ট হলেও এ কথা সত্য যে, দ্বিতীয় চন্দ্রযান প্রকল্প বিফলে গিয়েছে। ৯৭৮ কোটি টাকা মহাকাশে গেল। মহাসমুদ্রে যাওয়া আর মহাকাশে যাওয়া একই কথা।

এটা ঠিক, এই উপমহাদেশ থেকে একমাত্র ভারতেরই ক্ষমতা আছে মহাকাশে যান পাঠানোর। প্রতিবেশী কোনও দেশই এই যোগ্যতা অর্জন করেনি। ভারত আজ না পারলেও কাল পারবে। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, যদি বিশ্বাসই করি মহাকাশে কোনও দেশভেদ নেই, তাহলে কেন মহাকাশের প্রকল্পগুলো সব দেশ মিলে করে না? আমেরিকার নাসা, রাশিয়ার রসকসমস, কানাডার সিএসএ, জাপানের জেএএক্সএ, ইউরোপের ইএসএ, চীনের সিএনএসএ, ভারতের ইসরো, সক্কলের তো পরস্পরকে সহযোগিতা করা উচিত, অথবা বিভিন্ন দেশের মহাকাশ বিজ্ঞানী একত্র হয়ে মহাকাশে যা আবিষ্কার করার করুন। জাতীয়তার অহংকার মহাকাশে যত কম খাটানো যায়, ততই মঙ্গল।

চন্দ্রযান ২ পৃথিবী ছাড়ার পর একটি কার্টুন ছাপা হয়েছিল ভারতের এক পত্রিকায়। ভারতের অনেক মানুষ ভুগছে খাবার জলের অভাবে। মাইলের পর মাইল পেরোতে হয় শুধু এক কলস জল আনার জন্য। জলের কোনও চিহ্ন নেই কিছু এলাকায়। সেই জলহীন খাঁ খাঁ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে এক লোক বলছে ‘চাঁদে জল আছে কিনা দেখতে গেছে, তার চেয়ে এই জায়গাটায় দেখতে পারতো জল আছে কিনা’। গায়ে চাবুক পড়া মন্তব্য। তোমার দেশেই যখন মানুষ ভুগছে জলের অভাবে, তুমি চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে জল খুঁজতে গেছ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা খরচ করে। এই টাকায় তো জলের অভাবে যারা ভুগছে তাদের জলের অভাব ঘুচতো। ভারতে বাহান্নো কোটির চেয়ে বেশি লোক খোলা মাঠে মলত্যাগ করে। প্রচুর রোগ বালাই অপরিষ্কার জল থেকে, আর অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ থেকে আসে। সবার জন্য টয়লেটও বানিয়ে দেওয়া যেত ওই টাকায়।

দারিদ্র্য আছে বলে বিজ্ঞানের আবিষ্কার পিছিয়ে থাকবে কেন? কিন্তু আবিষ্কারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে না নিয়ে অন্য সবার সঙ্গে ভাগ করাই কি শ্রেয় নয়? রাশিয়ার ইউরি গ্যাগারিন প্রথম মহাকাশে ঘুরে আসার পর মহাকাশ জয় করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল আমেরিকা। সেই অহংকারের প্রতিযোগিতায় এক এক করে আমেরিকার কত যে প্রতিভাবান নভোচারীকে দুর্ঘটনায় প্রাণ দিতে হয়েছে। রাশিয়া মহাকাশ ভ্রমণ করেছে, আমেরিকা না করলে অহংকার কোথায় থাকে! এই ‘ন্যাশনাল প্রাইড’ই এখন বড় সমস্যা। অন্য দেশে পারমাণবিক অস্ত্র আছে, আমারও চাই। অন্য দেশ চাঁদের মাটি পরীক্ষা করে চাঁদে জল আছে কিনা দেখতে গেছে, আমিও যাবো। এই শিশুতোষ অহংকার দিন দিন বাড়ছে। চীনে গণতন্ত্র নেই, মানুষের বাকস্বাধীনতা নেই, কিন্তু চীন বিজ্ঞানে বিশাল অগ্রগতি দেখাবে। ভারতইবা পিছিয়ে থাকবে কেন। ভারতে সবার অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, বাসস্থান নেই, সবার শিক্ষা নেই, স্বাস্থ্য নেই। এগুলো ঘরের ব্যাপার, বাইরে থেকে দেখা যায় না। কিন্তু মহাকাশে ঘুড়ি ওড়ালে সকলে দেখতে পাবে। সকলকে দেখানোই কি মূল কথা? সকলে যেন হাততালি দেয়। হাততালি দিলেই কি গণতন্ত্র না থাকা, বাকস্বাধীনতা না থাকা, দারিদ্র্য থাকা, গৃহহীনতা, খাদ্যহীনতা, বস্ত্রহীনতা থাকার সব দোষ মানুষ ক্ষমা করে দেয়?

আমি বিজ্ঞানের পক্ষে। বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের পক্ষে। মানুষ প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে এই সৌর জগতের বাইরে কোনও গ্রহে মানুষকে চলে যেতে হবে। সৌর জগতের ভিতরে অন্য কোনও গ্রহে কী করে পাড়ি দেওয়া যায়, সে গবেষণা চলছে। সেই গবেষণা যেন দেশভিত্তিক না হয়। সব দেশ মিলে সেই গবেষণা করুক। সব দেশ মিলে রকেট ছাড়ুক। সব দেশ মিলেই সৌর জগতের বাইরে কোনও সৌর জগৎ আবিষ্কার করুক। সেই নতুন সৌর জগতে কী করে পাড়ি দেওয়া যায়, তা নিয়ে গবেষণা করুক। সায়েন্স ফিকশানকে সায়েন্স ফ্যাক্ট করার চেষ্টা চলুক। একা করলে যতটুকু সাফল্যের সম্ভাবনা, সবাই মিলে করলে সাফল্যের সম্ভাবনা তার চেয়ে নিশ্চয়ই বেশি। বিক্রম বা বীরত্ব একার মেধায় যত, তার চেয়ে বেশি সম্মিলিত মেধায়। কিন্তু মানুষ যদি হিংসে দ্বেষ অন্যায় অত্যাচার মারামারি খুনোখুনিতে ব্যস্ত, যদি দারিদ্র্য, হতাশা, লোভ, লালসা আর কুৎসিত করুণ মানবেতর জীবনকে সুখ-শান্তি, স্বাধীনতা, স্বাচ্ছন্দ্য, ভালোবাসা-মমতাময় জীবনে উত্তীর্ণ না করতে পারে, তবে কী প্রয়োজন এই প্রজাতিকে অন্য গ্রহে বা উপগ্রহে স্থানাস্তরিত করে টিকিয়ে রাখার? এই অক্ষম অপদার্থ অযোগ্য প্রজাতির তো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়াই ভালো।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর