বুধবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধীকে বাদ দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব হয় না

পীর হাবিবুর রহমান

প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধীকে বাদ দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব হয় না

মানবতাবাদী বিশ্বনন্দিত লেখক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইন্দিরা গান্ধীর নাম দিয়েছিলেন ‘প্রিয়দর্শিনী’। ১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর তাঁর জন্ম। ’৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর বিশ্বাসঘাতক শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন। পিতামহ মতিলাল নেহেরু ছিলেন প্রথম কাতারের কংগ্রেস নেতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী। পিতা পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু ছিলেন কারাভোগকারী ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। পারিবারিক রাজনীতির আবহ ও পিতার স্নেহ-সান্নিধ্য তাঁকে রাজনীতিতে এনেছিল। ভারতের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিশ্ব রাজনীতিতে তিনি ছিলেন মহাকাব্য যুগের এক অমর নায়িকা। ইন্দিরা গান্ধীর ঐতিহাসিক অবদান, সহযোগিতা, ভূমিকা ছাড়া যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা যায় না, তেমনি তাঁকে বাদ দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের রক্তে লেখা বন্ধুত্বের মহাকাব্য রচিত হয় না। যতবার দিল্লি যাই ইন্দিরা মেমোরিয়ালে গিয়ে হৃদয় দিয়ে তাঁর ব্যক্তিত্বময় স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। শোবার ঘর থেকে অফিস-লাইব্রেরি দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হওয়ার জায়গাটি হৃদয়ের গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে অবলোকন করি।

গতকাল ছিল বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ভারতের গণতন্ত্রের মহান নেত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিন। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন দীর্ঘ স্বাধিকার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গোটা জাতিকে এক মোহনায় মিলিত করে গণরায়ে বিশাল বিজয় অর্জন করে একচ্ছত্র নেতায় পরিণত হন, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি এবং করবে না, আগাম জেনেই তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন যে মহীয়সী নারীর সহযোগিতা নিয়ে, তিনিই ইন্দিরা গান্ধী। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে গোটা জাতি যখন ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর/বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ/বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা/শেখ মুজিব শেখ মুজিব’ স্লোগানে স্লোগানে গোটা পূর্ব বাংলাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে স্বাধীনতাকামী সব রাজনৈতিক সংগঠন একাত্ম হয়ে এসেছিল, তখন সাধারণ মানুষও সেই গণযুদ্ধের মিছিলে শরিক হয়েছিল। পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনী যখন ২৫ মার্চের কালরাতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ঢাকাকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়েছিল মহান স্বাধীনতার ডাক দেওয়া নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করে নিয়ে গিয়েছিল, তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সামরিক-বেসামরিক মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধ যোদ্ধারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রস্তুত করে রাখা পথে তাঁর নির্দিষ্ট ঠিকানায় আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে সব পরিকল্পনাই গ্রহণ করেননি, বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামানসহ জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মুজিবনগর থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা ও শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন।

আর এদিকে জল্লাদ ইয়াহিয়া খানের পাঠানো বেলুচিস্তানের কসাই খ্যাত টিক্কা খান গভর্নর নিযুক্ত হয়ে এসে ব্যাপক গণহত্যা, গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ চালিয়েছিলেন। পোড়া মাটি নীতি অবলম্বন করে বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিলেন। সেই সময় ভিটেমাটি-সম্পদ সব ফেলে দিয়ে শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষেরাই শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর ভারতে আশ্রয় নেননি, এক কোটি শরণার্থী উদ্বাস্তুর মতো ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দারিদ্র্যপীড়িত ভারতের জনগণকে খাবার দিতে গিয়ে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী যেখানে হিমশিম খাচ্ছিলেন, নকশালবাড়ীর আন্দোলনসহ নানা বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করছিলেন, ঠিক সেই সময় বিশ্ব রাজনীতির মানবতাবাদী এই অমিতসাহসী নেত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেওয়া পূর্বের অঙ্গীকার অনুযায়ী আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনে কার্পণ্য করেননি। তিনি শরণার্থী শিবির ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। তাদের মনোবল চাঙ্গা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছেন। আমাদের জাতীয় বীর যোদ্ধাদের অস্ত্র, অর্থ ও ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যখন বিশ্ব পরাশক্তিসহ পূর্বের চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে পাকিস্তানের পক্ষে, সেখানেও শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বিচলিত হননি, দমে যাননি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সব ষড়যন্ত্র আর নিক্সন প্রশাসনের রক্তচক্ষু হুমকিকে কঠোর ভাষায় জবাব দিতেও কার্পণ্য করেননি। তারা যেখানে বলেছে এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়, তিনি সেখানে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, এটা বর্বর গণহত্যা, তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি বসে থাকবেন না। সোভিয়েত রাশিয়া, মার্কিন নৌবহর ঠেকাতে এক দিনে অসংখ্যবার ভেটোই দেয়নি, পাল্টা ব্যবস্থাও নিয়েছিল।

আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর সৃষ্টি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের নানা বাঁকে উঠে আসা চার নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, যিনি ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট নিহত হন; মরহুম আবদুর রাজ্জাক, যিনি আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথে ভারতের বন্ধুত্বকে হৃদয়ে লালন করে অকালে চলে গেছেন; সিরাজুল আলম খান যিনি, রাজনীতির রহস্যপুরুষ হিসেবে স্বাধীনতার পর হঠকারী পথে নির্বাসিত হয়েছেন রাজনীতি থেকে; ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের নায়ক তোফায়েল আহমেদ, যিনি এখনো বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল। রাজনীতির জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে পথ হাঁটছেন। তাঁদের চারজনকে মুজিব বাহিনীর অন্যতম চার প্রধান করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুরই পরামর্শে। ’৭০ সালে বরিশাল অঞ্চল থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য চিত্তরঞ্জন সুতার ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারাজীবন ভোগ করেছেন। ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু জানতেন, স্বাধীনতা সংগ্রামই তাঁর শেষ পথ। তাই চিত্তরঞ্জন সুতারকে আগেই কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। উত্তাল মার্চে বঙ্গবন্ধু বাঙালির ইতিহাসের ঠিকানা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে এই চার নেতাকে ডেকে নিয়ে চিত্ত সুতারের কলকাতার বাসভবনের ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের পর বঙ্গবন্ধুর মহান স্বাধীনতার ডাকে তাঁরা সেখানেই উঠেছিলেন। আর তাঁর পাশেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ নেতারা থাকতেন।

মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সেনাশাসক ইয়াহিয়া খান সামরিক আদালতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সামরিক আদালতে ফাঁসির দ- দিয়ে কবর খুঁড়েছিলেন। সেখানে গোটা জাতির আবেগের জায়গায় ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নামেই মুক্তিযুদ্ধ, তাঁর নামেই স্লোগান। আর একেকটি অপারেশনের পর বীর যোদ্ধারা স্লোগান তুলতেন জাতির গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া ‘জয় বাংলা’। সবার চাওয়া ছিল, স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জীবন্ত ফিরে পাওয়া। ইন্দিরা গান্ধীও মরিয়া ছিলেন জীবিত বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পেতে। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘শেখ সাহেব’ ফিরে না এলে স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে।

জিন্নাহ, ইসলাম, পাকিস্তান নীতিতে জন্মের সময় থেকেই শেখ মুজিব পাকিস্তানকে মেনে নিতে পারেননি। তাই স্বাধীনতার লক্ষ্যে ’৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। জিন্নাহর রাষ্ট্রভাষা উর্দুর প্রতিবাদ করেন। বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ’৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্র ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিয়ে কারাবরণ করেন। ’৪৯ সালের ২৩ জুন রোজ গার্ডেনে ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কারাগারে বসে যুগ্মসাধারণ সম্পাদক হন। তিনি গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হাকের স্নেহধন্য একজন অমিতসাহসী অনন্যসাধারণ সংগঠক ও কর্মীবান্ধব সৎ রাজনীতিক ছিলেন। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তা বলতেন এবং তা-ই করতেন। তিনি তাঁর লক্ষ্য অর্জনের পথে অবিচল থাকতে গিয়ে বারবার দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় হাসতে হাসতে বছরের পর বছর কারাদহন ভোগ করেছেন। ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও তিনি তাঁর আদর্শ ও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি। ’৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে তিনি যখন দলের সাধারণ সম্পাদক, তখন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী ন্যাপ গঠন করে সমাজতন্ত্রের পথে হাঁটা দিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিকূল পরিবেশে আওয়ামী লীগে নাবিকের হাল ছাড়েননি। জেল-জুলুম-নির্যাতন সয়ে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করেন। তিনি যেখানে সভাপতি হতে পারতেন, সেখানে সাধারণ সম্পাদক পদে থেকেই ধর্মের নামে চলমান রাজনীতির মুখে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে সভাপতি করেছিলেন। দলের ভাঙা-গড়া বারবার এসেছে। সোহরাওয়ার্দীর আকস্মিক মৃত্যু তাঁকে বিষাদগ্রস্ত করেছে। ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, যিনি তাঁর স্বাধীনতার স্বপ্নের সংগ্রামকে ছায়া দিয়েছেন, সমর্থন দিয়েছেন ক্ষুরধার লেখনীতে। মানুষকে স্বাধীনতার নবজাগরণে শামিল করতে অসাধারণ ও ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন। তিনিও দীর্ঘ জেল খাটার পর অকালে মৃত্যুবরণ করেন। এসব সহযাত্রী অগ্রজ হারানোর বেদনা একদিকে সয়েছেন, আরেকদিকে সহযাত্রীদের সরে যাওয়াও মেনে নিয়ে বিরোধিতাকে মোকাবিলা করে একক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর দলকে নিয়ে জনগণকে জাগিয়েছেন। স্বায়ত্তশাসনের নামে ছয় দফা দিয়ে দূরদর্শী শেখ মুজিব পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাতে যেমন বিচ্ছেদের কাবিননামা বা স্বাধীনতার দলিল তুলে দিয়েছেন, তেমনি দেশের জনগণকে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো টেনেছেন তাঁর বক্তৃতায়। দলের তরুণদের মধ্যে নির্বাচন না সশস্ত্র যুদ্ধ নানা মতপার্থক্য ধারণ ও লালন করে তিনি সামরিক শাসকদের অধীনে এক ব্যক্তি এক ভোট সিদ্ধান্তের ওপর জনগণের ওপর প্রবল আস্থায় ’৭০ সালের নির্বাচনের বিশাল বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে গোটা জাতির একক নির্বাচিত নেতৃত্বের আসনে অভিষিক্ত হয়েছেন। ’৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ১০ লাখ লোকের সমাবেশে ঐতিহাসিক ১৮ মিনিটের মহাকাব্যের বক্তৃতায় স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। সেই থেকে গোটা জাতি তাঁর নিয়ন্ত্রণে স্বাধীনতার পক্ষে কাতারবন্দী। পশ্চিমা মিডিয়া সেদিন তাঁকে রাজনীতির কবি বলেছিল।

১৯৬২ সালে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় উপহাইকমিশনের পলিটিক্যাল অফিসার ছিলেন শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি। শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির সঙ্গে কিছুদিন আগে লন্ডনে গিয়ে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছেন এবং লড়াই করে তিনি তাঁর জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। তিনি জীবনের দুঃসাহসিক ভূমিকা নিয়েছেন। তিনি তখন পুরান ঢাকার চক্রবর্তী ভিলায় থাকেন। তার দেয়ালঘেরা বাসাটির পাশেই ছিল দৈনিক ইত্তেফাকের অফিস। ’৬২ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাতে তিনি খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের বড়দিনের উৎসবে কূটনৈতিক নিমন্ত্রণে সস্ত্রীক গিয়েছিলেন। রাত ১২টার পরপর তিনি যখন ঘরে প্রবেশ করেছেন, তখন ২৫ ডিসেম্বর শুরু হয়েছে। তিনি তার বাসার পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করতেই সামনের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলেন। তাকে এমনিতেই নিরাপত্তার বিষয়ে দিল্লি সতর্ক থাকতে বলেছিল। তিনি নিজেও সতর্ক ছিলেন। কিন্তু সেই রাতে নিজেকে সামলে নিয়ে দরজা খুলে দিতে গিয়েই দেখলেন ১৪ বছর বয়সের এক কিশোর খুব ভদ্রভাবে তাকে আসস্ালামু আলাইকুম বলে সম্ভাষণ জানাল। তিনি কিছু বলার আগেই সন্ত্রস্তভাবে ছেলেটি তাকে জানাল, তার যদি কোনো সমস্যা না হয়, তবে ইত্তেফাক অফিসে সম্পাদক মানিক মিয়া তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। ছেলেটি যাওয়ার সময় বলল, আরেকজন ভদ্রলোক সেখানে রয়েছেন। কিন্তু ভদ্রলোকটি কে তা কিশোর তাকে জানায়নি। গোলকধাঁধার মধ্যে তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করে বললেন, আমি আসছি।

মানিক মিয়া সম্পর্কে তার পরিষ্কার ধারণা থাকলেও শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জিকে এর আগে কখনো দেখা হয়নি। তিনি প্রস্তুত না থাকলেও বুঝতে পারলেন এটি একটি রাজনৈতিক সাক্ষাৎকার হবে। খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে যখন মানিক মিয়ার অফিসে পৌঁছলেন, তখন ইত্তেফাক সম্পাদক তার চেয়ার থেকে অস্বাভাবিক সময়ে দেখা করতে আসায় ধন্যবাদ জানিয়ে স্বাগত জানালেন। তিনি তার নাম ধরে সম্বোধন করলেন এবং করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। তিনি তার পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের দিকে ফিরলেন। হাতের ইশারায় তাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। শশাঙ্ক ব্যানার্জির ভাষায়, মানুষটির ছবি তিনি পত্রিকায় দেখেছেন। ভাষণ শুনেছেন এবং চেহারার সঙ্গে অনেক পরিচিত। আনুষ্ঠানিক পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর এই প্রথম শেখ মুজিবের সঙ্গে তার দেখা হলো। তিনি তাঁর উপস্থিতি দিয়ে তাকে মুগ্ধ করেছিলেন। একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, ‘মুজিব সুপুরুষ ছিলেন এবং তাঁর ছিল দারুণ ব্যক্তিত্ব’, তিনি ঠিক কথাই বলেছিলেন। পল্টন ময়দানের গণসমাবেশে তিনি কেমন করে শক্তিশালী বক্তব্যে শ্রোতাদের বেঁধে রাখেন সেটি আগেই দেখেছেন। শেখ মুজিব সেই রাতে শক্ত হাতে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে করমর্দন করলেন এবং ব্যানার্জিকে তুমি বলেই কথা শুরু করলেন। নানা আলোচনার পর ভোররাতে শেখ মুজিব বললেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহর লাল নেহরুর হাতে তার একটি চিঠি তুলে দিতে হবে। ব্যানার্জি চিঠিটি কীভাবে কয়েক ধাপে, কার কার হাত ঘুরে যাবে তার ব্যাখ্যা তিনি দিলেন। এঁদের মধ্যে তাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য তিনি ঢাকাস্থ ভারতীয় মিশনের ডেপুটি কমিশনার সৌর্য কুমার চৌধুরী এবং পূর্ব পাকিস্তানের ভারতের গোয়েন্দা স্টেশন প্রধান কর্নেল এস সি ঘোষের নাম বললেন। সেই চিঠির মূল ভাষ্য ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষের জন্য স্বাধীন সার্র্বভৌম রাষ্ট্র তৈরির কথা। নেহেরুকে ব্যক্তিগভাবে লেখা চিঠিতে বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণার রূপরেখা দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভারতের আত্মিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও মাঠ পর্যায়ের সব ধরনের নিঃশর্ত সমর্থন আশা করেন। ব্যানার্জির ভাষায়, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কী সিদ্ধান্ত নেন, সেটি অন্য কথা হলেও এই চিঠি যেমন ছিল খাঁটি ডিনাইমাইট, তেমনি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছিল হিমালয়সম উঁচু। সব মিলিয়ে চিঠিটি ভারত সরকারকে শিকড়সহ কাঁপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা বহন করছিল।

শেখ মুজিব সেদিন শশাঙ্ক ব্যানার্জিকে দৃঢ় ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিষ্কার বলেছিলেন, আমরা তোমাদের কাছে হাত পাতছি না। সহযোগিতা চাইছি। চীনের সঙ্গে পরাজয়ের পর এখন তোমাদের কেউ পুছছে না। কিন্তু আমরা সফল হলে তোমাদের মর্যাদা বাড়বে। সকালেই তিনি রেডি হয়ে ডেপুটি হাইকমিশনারের বাসায় হন্তদন্ত হয়ে গেলেন। এবং নাস্তার টেবিলে বিস্তারিত জানিয়ে সেই চিঠিটি তুলে দিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু চীনের দখলদারিত্বের বেদনা নিয়ে তখন শোকে আচ্ছন্ন। তিনি গণতান্ত্রিকভাবে সব নিরাপত্তা উপদেষ্টা, সামরিক নেতৃত্ব ও মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠক ডেকে পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে বিলম্ব করলেন। তবে শেখ মুজিবকে জানিয়ে দেওয়া হলো, তিনি চিঠি পেয়েছেন। সিদ্ধান্ত জানাতে বিলম্ব হওয়ায় তিনি দুঃখিত, খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত জানাবেন।

এদিকে স্বাধীনতার জন্য অস্থির ব্যাকুল শেখ মুজিবুর রহমান মনে করছিলেন, কূটনৈতিক আমলাতন্ত্রিক জটিলতায় দেরি হচ্ছে। তিনি ধৈর্য ধারণ না করে পাসপোর্ট ছাড়া গোপনে আগরতলা চলে গেলেন। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন সিংয়ের সঙ্গে দেখা করে তাঁর পরিকল্পনা জানিয়ে রাজনৈতিকভাবে নেহেরুকে প্রভাবিত করার পথ নিলেন। নেহেরু তাঁকে জানিয়ে দিলেন, ঢাকাস্থ ভারতীয় মিশনই হবে যোগাযোগের মাধ্যম। এদিকে ফিরে আসার পর শেখ মুজিব গ্রেফতার হলেন। এবং রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান বা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হলো। ছাত্র-গণআন্দোলনে অভ্যুত্থানে তুমুল জনপ্রিয় বীরের বেশে মুক্ত হয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু উপাধি নিয়ে। তবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর থার্ড ডিগ্রি টর্চারের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা মুজিবকে আরও বেশি এক বিপ্লবী নেতায় পরিণত করেছিল। আইয়ুব খানের পতনের মধ্য দিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে প্রেসিডেন্ট হন।

এদিকে নেহেরু বুঝেছিলেন, মুজিব একজন জাদুকরী গণনেতা এবং তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের মতো তাঁর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ আছে। ভারত শেখ মুজিবকে আরও জানিয়ে দেয়, তাঁকে তাড়াহুড়ো করলে চলবে না। রোডম্যাপ বাস্তবায়নে গণতন্ত্রের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গণমানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের ধারা সুপ্রতিষ্ঠিত করে নেতৃত্বের সর্বোচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। যদি তাঁর সমাবেশে লাখ লাখ মানুষ জমায়েত হয়ে তাঁর কথা শুনতে আসে, তখন বিশ্ব তাঁকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সত্যিকারের জননেতা বলে মেনে নেবে। বঙ্গবন্ধু খুব দ্রুত তাঁর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে এক মোহনায় মিলিতই করেননি, ’৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে বিশ্ববাসীর সামনে নিজেকে জনপ্রিয় একক নেতায় পরিণত করেছিলেন মাত্র সাত বছর পরই।

এদিকে ’৬৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর মৃত্যু ঘটে। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হন। ইন্দিরা রাজ্যসভার সদস্য হয়ে তথ্য ও প্রচারমন্ত্রী হন। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রশ্নে নেহেরুর ডায়েরিতে গাইডলাইন তাঁর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী ঠিকমতো হাতে পেয়ে যান। তিনি সেই সযোগিতার হাত শক্তভাবে প্রসারিত করেন। শশাঙ্ক ব্যানার্জি বাগদাদ মিশনে চলে গেলেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার যোগাযোগ থেকে যায়। ইন্দিরা গান্ধীই তাকে সেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অন্যদিকে লন্ডন মিশনে ফনীন্দ্রনাথ ব্যানার্জি স্বাধীনতা সংগ্রামে সম্পৃক্ত হন। ’৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে বেরিয়ে লন্ডন গিয়ে ফনীন্দ্রনাথের সঙ্গে বৈঠক করে চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন। ’৬৫ সালে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দুই সন্তানের মধ্যে সঞ্জয় গান্ধী রাজনীতিতে জড়ালেও রাজীব গান্ধী পাইলট হিসেবে পেশাকে বেছে নেন। অক্সফোর্ড থেকে ফিরে আসার পর কিছুদিন ইন্দিরা গান্ধী শান্তিনিকেতনেও লেখাপড়া করেন। সঞ্জয় গান্ধী হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মারা গেলে রাজীব গান্ধী ইন্দিরার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ’৯১ সালে নির্বাচনী সমাবেশে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন।

ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বমানবতাকে রুখে দাঁড়াবার আহ্বানই জানাননি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন দান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য দেশে দেশে জোরালো ভূমিকা রাখেন। তিনি ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ সফর করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে কঠোর ভাষায় কথা বলতেও ছাড়েননি- চিঠিও দেন। ৩ ডিসেম্বর তিনি বেতার ভাষণে পাকিস্তানের ভারত আক্রমণের বিরুদ্ধে রেডিওতে দেওয়া বক্তৃতায় যুদ্ধের ঘোষণা দেন। আকাশ, স্থল ও নৌপথে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়। মিত্রবাহিনী যৌথভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান পরাজিত হয়ে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলে, ইন্দিরা সেদিন সংসদে বলেন, বাংলাদেশ এখন স্বাধীন, বিজয়ী।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে অস্থির ব্যথিত ইন্দিরা মুজিবকন্যা শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ’৭১-এর বীর যোদ্ধা বাঘা সিদ্দিকী খ্যাত কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তিবাহিনীর ব্যানারে গঠিত প্রতিরোধ যোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। কাদের সিদ্দিকীকে স্নেহ করে তিনি টাইগার বলে ডাকতেন। ’৭৭ সালে ইন্দিরার পরাজয় ও মোরারজি দেশাই ক্ষমতায় এলে তাদের ওপর খড়্গ নামে। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী তাঁর অতীত ব্যর্থতার জন্য ক্ষমা চেয়ে নতুন করে দলকে দ্রুত সুসংগঠিত ও জনপ্রিয় করে ’৮০ সালের নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় আসেন। ’৮৪ সালে উগ্রপন্থি শিখরা স্বর্ণ মন্দিরে আশ্রয় নিয়ে বিদ্রোহ করলে তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সেনা অভিযান পরিচালনা করেন। এতে বিক্ষুব্ধ শিখ দেহরক্ষীরা তাঁকে হত্যা করে। মহাত্মা গান্ধী ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের জাতির জনক হলেও বাপুজি বলে ভারতবাসীর শ্রদ্ধা অর্জন করলেও উগ্রপন্থি হিন্দু সংগঠন হিন্দু মহাসভার সদস্য নথুরাম গডসের গুলিতে প্রাণ হারান। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের আদর্শিক চেহারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেনাশাসক জিয়াউর রহমান পাল্টে দিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পুনর্বাসিত করে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে আনেন। তেমনি নেহেরু থেকে ইন্দিরা বিশ্ববাসীর সামনে যে ধর্মনিরপেক্ষ বহু জাতির সমন্বয়ে দাঁড়ানো ভারতকে গণতন্ত্রের ধারায় প্রস্ফুটিত করেছিলেন, সেখানে দিনে দিনে আজ ধর্মনিরপেক্ষ নীতি ধূসর বর্ণ ধারণ করে হিন্দুত্ববাদের উগ্র উত্থানে বর্ণহীন হয়েছে। বাংলাদেশও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থেকে সাম্প্রদায়িকতার থাবায় মডারেট মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। দুই বন্ধু রাষ্ট্র তার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত ঐতিহ্য থেকে হোঁচট খেয়েছে। ভারতকে আজ বুঝতে হবে ওখানে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় থাকলেও এখানে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকায় দুই দেশের বন্ধুত্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত যেমন ’৭১-এর রক্তে বাঁধা বন্ধু রাষ্ট্র, তেমনি ’৭১-এর ঋণ শোধ করার প্রশ্নে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশও বন্ধুত্বের উদার নীতি গ্রহণ করেছে। মমতা ব্যানার্জি যতই বাধা দিন তিস্তার পানি চুক্তিসহ সীমান্ত সমস্যা সমাধানে ভারতকে যেমন উদার নীতি গ্রহণ করে বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী করার ভূমিকা রাখতে হবে; তেমনি এ দেশের জনগণের হৃদয়ও জয় করতে হবে। সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ দমনের মতো উভয় দেশের নেতৃত্বকে অভিন্ন স্বার্থরক্ষায় ঐক্যবদ্ধ আন্তরিকতা নিয়েই দাঁড়াতে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ দুই দেশের বন্ধুত্বের বিশ্বস্ত উদাহরণই নয়, রক্তে লেখা আত্মার বন্ধন। আর সেই বন্ধন রচনা করেছেন ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে আমাদের সেই মহাদুঃসময়ের ভারতের জনগণ। প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরাকে বাদ দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বাদ দিয়ে দুই দেশের বন্ধুত্বের উষ্ণতা রাখা যায় না। পাকিস্তান ভারতের যেমন চিরশত্রু আমাদের তেমন জন্মের শত্রু। ’৭১-এর গণহত্যা, গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং আমাদের পাওনা পরিশোধ না করা এবং নিরন্তর ষড়যন্ত্রের যন্ত্রণা যেমন রয়েছে, তেমনি ঐতিহাসিকভাবেই কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও মানবিক হৃদয়ের ঘৃণা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণ যেন সেনাশাসকদের জমানার মতো মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার জমানায় ভারতবিদ্বেষী না হয়, সেটি বড় দেশ হিসেবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মর্যাদার দিকটি বিবেচনায় রেখে কূটনৈতিক দেনদরবার-আলোচনার মাধ্যমে অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করা জরুরি। বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব বড় দেশ ও বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে ভারতকেই নিতে হবে।

                লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর