দেখতে দেখতে আরেকটি বছর চলে গেল! যানজটে স্থবির, পরিবেশ দূষণে বিষাক্ত জরাগ্রস্ত এ নগরীতে স্বপ্নভঙ্গের অন্তহীন বেদনা ও দহন নিয়ে প্রতারিত জীবন বয়ে বেড়াই জীবিকার টানে। দেশজুড়ে এত উন্নয়ন কর্মকান্ড, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এত বাড়া সত্ত্বেও আনন্দহীন জীবনে যেন সুখ নির্বাসিত। অস্থির, অশান্ত মূল্যবোধহীন, অবক্ষয়ে পতিত গোটা সমাজ। রাজদুর্নীতির জমানায় রাতারাতি অর্থবিত্ত, ক্ষমতা ও সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে আত্মমর্যাদাহীন, আদর্শহীন, চরিত্রহীন, দলকানা, দলদাস ও দলদাসীদের দৌড়ঝাঁপ অবলোকন করি। ব্যক্তিত্ব ও রুচিবোধের এ সংকটকালে দুর্নীতিবাজ, অসৎ ও ছেঁচড়া চাটুকারদের দাপট দেখি। সৎ, আদর্শিক, মর্যাদাসম্পন্ন রুচিশীল মানুষেরা যেন অসহায়ত্ব নিয়ে বেঁচে আছে। লোভের আগ্রাসীপনা কালনাগ-কালনাগিনীর মতো বিষাক্ত করে তুলেছে মানুষের মন ও জগৎ সংসার। ক্ষমতা ও বিত্তের প্রাচুর্য যতই দৃশ্যমান তার বিপরীতে চিত্তের সুখ ততই নিষ্প্রভ।
আওয়ামী লীগের সম্মেলনে যোগদান করতে আসা তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা প্রতিবারই তাদের প্রিয় নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। এবারও সম্মেলনের পর তাই করেছেন। তাদের সঙ্গে আলোচনাকালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্ব নিয়ে দেশে ফিরে আসার পর আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে দলের ভাঙন নিয়ে বেদনার কথা বলেছেন। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশের বাইরে থাকায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা যে গভীর বেদনা, দহন, কষ্ট, যন্ত্রণা ও শূন্যতা অনুভব করেছেন তা বোঝানোর ক্ষমতা কিংবা উপলব্ধি করার শক্তি কেবল তাদেরই রয়েছে। মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেখানে সারাটি জীবন জাতির স্বাধীন আবাসভূমি এবং জনগণের অধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রাম করেছেন। জীবনের ১৩টি বছর কারাগারের যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। প্রতিকূল পরিবেশে আদর্শিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের এ-দেশীয় প্রতাপশালী দালালদের শক্তিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে জাতিকে তাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছেন। সেই মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা বন্দী করে নির্জন কারাগারের অন্ধকারে রেখে কবর খুুুুুুুুঁড়ে ফাঁসির রায় দিয়েও হত্যা করতে পারেনি। অথচ স্বাধীন দেশের মাটিতে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক বঙ্গবন্ধুকে এ দেশের বিশ্বাসঘাতকরা হত্যাই করেনি, তাঁর স্ত্রী, শিশু সন্তান থেকে পুত্রবধূসহ গোটা পরিবারকেও নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। বুলেটে ঝাঁজরা করে দিয়েছে। এমন রাষ্ট্রীয় হত্যাকান্ড মানবসভ্যতার ইতিহাসে কোথাও ঘটেনি। এমন বেদনা কোনো জাতীয় বীরের সন্তানদের বহন করে বেড়াতে হয়নি। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা দেখেছেন, সেদিন সামরিক নেতৃত্ব হত্যাকান্ড প্রতিরোধে ব্যর্থই হয়নি, খুনিদের প্রতি নির্লজ্জ আনুগত্য প্রকাশ করেছে। জাতির পিতার রক্তাক্ত দেহ ধানমন্ডির বাসভবনে ফেলে রেখে অস্ত্রের মুখে অবৈধ বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর ও এ দেশের রাজনীতির নিকৃষ্ট, কলঙ্কিত নাম খন্দকার মোশতাক আহমদের অবৈধ সরকারের মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা অস্ত্রের মুখেই হোক আর স্বেচ্ছায় হোক শপথ গ্রহণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গেলেও সেদিন নিরপরাধ শিশুসহ জাতির পিতার রক্তে রঞ্জিত খুনি সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পর রাজনৈতিক নেতৃত্বে থাকা চার নেতা কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ডাক না দিয়ে কারাগারে খুনিদের বুলেটে জীবন দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের আগেই তাঁর ভাগ্নে যুবলীগ চেয়ারম্যান, মুজিববাহিনীর অন্যতম প্রধান শেখ ফজলুল হক মণিকে তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীসহ নির্মমভাবে হত্যা করেছে খুনিরা। রাজনৈতিক নেতৃত্বও সেদিন ব্যর্থ হয়েছেন। সেদিন খুনি মোশতাক থেকে সেনাশাসক জিয়ার কঠোর নির্যাতন-অত্যাচার সহ্য করে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা কারাদহন ভোগ করেছেন। এমন ভয়ঙ্কর দুঃশাসনের মুখে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়ালেও সারা দেশের নেতা-কর্মীদের অনেকেই ছিলেন দেশের সব কারাগারে। অনেকে ছিলেন নির্বাসিত ও সেনাশাসক জিয়ার নির্যাতনে ক্ষতবিক্ষত। ’৭১-এর বাঘা সিদ্দিকী খ্যাত বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম সেদিন দলের কোনো পর্যায়ের নেতৃত্বে ছিলেন না। কিন্তু নিজের আবেগ-অনুভূতি ও বিশ্বাস থেকে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে প্রতিরোধযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। জাতীয় মুক্তিবাহিনীর ব্যানারে সেই যুদ্ধে মুজিব-অন্তঃপ্রাণ তরুণরা অনিশ্চিত জীবনকে আরেকবার আলিঙ্গন করে যুক্ত হয়েছিলেন।
এদিকে ’৭৫-এর শহীদজায়া সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়ালেও সাংগঠনিক যোগ্যতায় কর্মীবান্ধব নেতা আবদুর রাজ্জাক কারাগারে বসেই দলের মধ্যমণি হয়ে উঠেছিলেন। কারামুক্ত হয়েই ’৭৮-এর কাউন্সিলে আবদুল মালেক উকিলকে সভাপতি করে তিনি হয়েছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক। অন্যদিকে অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ষাটের দশকের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা ছাত্র পরিষদের নেতা নূরে আলম সিদ্দিকীরা সেই কঠিন দুঃসময়ে দলে প্রথম ভাঙন সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁদের অনেকে পরবর্তীতে সেনাশাসকদের মন্ত্রী হয়েছিলেন। আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর তাঁকে মধ্যমণি করেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির পথে দল সুসংগঠিত হয়েছিল।একদিকে সেনাশাসকদের অত্যাচার, আরেকদিকে অতিবাম ও উগ্রপন্থিদের মুজিববিদ্বেষী আওয়ামী লীগবিরোধী সশস্ত্র রাজনীতির মুখে মহান নেতার আদর্শকে ছড়িয়ে দেশের শিক্ষাঙ্গনে মেধাবী, সৃজনশীল সংগঠকদের পক্ষে নিতে সফল হয়েছিলেন। কারাগারে বসে তোফায়েল আহমেদ হয়েছিলেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক। তেমনি ওবায়দুল কাদের হয়েছিলেন ছাত্রলীগের সভাপতি। বাইরে বাহালুল মজনুন চুন্নু হন সাধারণ সম্পাদক। দলীয় রাজনীতিতে আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে দুটি ধারায় দলীয় নেতৃত্ব বিভক্ত হয়ে নেতৃত্বের লড়াইয়ে ভাঙনের মুখোমুখি হলে ’৮১-এর ইডেন কাউন্সিল সামনে রেখে দলের একটি অংশ দিল্লি নির্বাসিত মুজিবকন্যা শেখ হাসিনাকে দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে নেতৃত্বে নিয়ে আসার জন্য তৎপর হয়েছিলেন।
সেবার দলের অনেক প্রবীণ নেতা আবদুর রাজ্জাকের ওপর ভর করে সভাপতি হতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত দলের সভাপতি পদে সর্বসম্মতভাবে শেখ হাসিনাকে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে নির্বাচিত করে ভাঙন থেকে দলকে রক্ষা করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা আসার পর সে বছর অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের সম্মেলনে নেতৃত্বের লড়াইয়ে ছাত্রলীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়। সাবজেক্ট কমিটির মধ্য থেকে দুই পক্ষের পাঁচজন করে ১০ নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হলে এক পক্ষের নেতা খ ম জাহাঙ্গীর ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে সভাপতি ও নিজেকে সাধারণ সম্পাদক করে তিনি যে অংশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, তাঁদের বিশ্বাসকে ভঙ্গ করেন। এতে তিন চতুর্থাংশ জেলা নেতৃত্ব ফজলুর রহমানকে সভাপতি ও বাহালুল মজনুন চুন্নকে আরেক দফা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে ছাত্রলীগের পাল্টা কমিটি ঘোষণা করে। এ অংশটি সারা দেশে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং আবদুর রাজ্জাকের নেপথ্যে সমর্থন লাভ করে। ছাত্রলীগ প্রশ্নে সেদিন আওয়ামী লীগ সমঝোতার সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেন বিলম্ব করেছিল তা এখনো আমার কাছে গভীর রহস্যের। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার জন্য সেই কঠিন সময়ে দলের নেতৃত্বে এসে গণতন্ত্রের সংগ্রাম শুরুর প্রাক্কালে এমন পরিস্থিতি অবশ্যই বেদনার ছিল। কিন্তু ছাত্রলীগ প্রশ্নে ’৮৩ সালে যখন জালাল-জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বাধীন অংশকে বৈধতা দেওয়া হলো তখনই আওয়ামী লীগে ভাঙন সৃষ্টি হয়। দলের কেন্দ্রীয় অনেক নেতাসহ আওয়ামী লীগের জেলা নেতাদের বিরাট অংশও সেদিন ফজলু-চুন্নু নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগকে সমর্থন দিয়ে এসেছিলেন। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা একে একে সবাই সরে দাঁড়ান। আবদুর রাজ্জাক ও তাঁর সমর্থন দেওয়া ছাত্রলীগের ফজলু-চুন্নুর সঙ্গে সারা দেশের অনেক আওয়ামী লীগ নেতার সন্তানরাও জড়িয়ে পড়েছিলেন। পরবর্তীতে তাঁরা আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন বাকশালে যুক্ত হয়েছিলেন। সেদিন ছাত্রলীগের দুই গ্রুপকে নিয়ে যত দূর জানি মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা সমঝোতার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁর পাশে থেকে আওয়ামী লীগের যেসব নেতা এই সুযোগে আবদুর রাজ্জাককে দলের বাইরে ঠেলে দিতে চেয়েছিলেন, তাঁরা সমঝোতা হতে দেননি। তাঁরাও পরবর্তীতে নিজেদের জীবনের করুণ সময় দেখেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাসহ সেই সময় সক্রিয় দলের নেতারাই বলতে পারবেন, ছাত্রলীগের দুই অংশকে নিয়ে কেন ঐক্য হয়নি এবং আবদুর রাজ্জাককে দল ভেঙে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল?
আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, স্বাধীনতা-উত্তর জাসদ গঠন থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড সহ অনেক ঘটনাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে ঘটেছে, যার লক্ষ্য ছিল এ দেশের দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তি ও নেতৃত্বকে দুর্বল ও শেষ করে দেওয়া, যেটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছিল। দেশপ্রেমিক শক্তিকে দুর্বল ও স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে ভঙ্গুর করে দিতে সেই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ’৮৩ সালের ভাঙন ঘটেছিল। আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে বাকশাল গঠন ও আওয়ামী লীগের ভাঙনের মধ্য দিয়ে ’৭৫-উত্তর বঙ্গবন্ধুর আদর্শে তৈরি হওয়া মূলধারার তারুণ্যের শক্তিটিকেও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। সেদিন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার দিকে দলের কর্মী-সমর্থক ও মানুষের আবেগ-অনুভূতির স্রোত বইলেও দলটি রক্তশূন্য হয়ে পড়েছিল।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পেছনে দলের এ ভাঙনই যে প্রধান কারণ তা দৃশ্যমান হয়। এরপর আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন বাকশাল ফিরে এলেও কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে অনেক সম্ভাবনাময় গণমুখী আদর্শিক নেতৃত্ব আর উঠে আসতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছেন, সেদিন আবদুর রাজ্জাকের ভাঙন ঠেকাতে ন্যাপ থেকে আসা মতিয়া চৌধুরী ও আবদুল জলিল তাঁর পায়ে ধরেছিলেন। যতটা জেনেছি শেখ হাসিনাকে আমির হোসেন আমুসহ যারা দলের সভানেত্রী করে নিয়ে আসার উদ্যোগী ছিলেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম, বর্তমান চিফ হুইপ লিটন চৌধুরীর পিতা মুজিববাহিনীর কোষাধ্যক্ষ ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী, ঢাকার মোহাম্মদ হানিফ, পঞ্চগড়ের সিরাজুল হক, চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন চৌধুরী, নড়াইলের এখলাছ উদ্দিন টুকু, মোস্তফা মহসীন মন্টুসহ অনেকেই। অনেকের মতে, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর প্রয়াত স্বামী আকবর চৌধুরীর কাছ থেকেই এ ধারণার সৃষ্টি। আর আবদুর রাজ্জাককে ম্যানেজ করেছিলেন আমির হোসেন আমু। শেখ ফজলুল করিম সেলিম একবার আমাকে বলেছিলেন, তুমুল করতালিতে যখন দলের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনার নাম আনন্দমুখর নেতা-কর্মীদের সমর্থন পায় তখন মতিয়া চৌধুরীর মুখ ছিল বিষাদের ছায়ায় ঢাকা। আবদুর রাজ্জাকের কাছ থেকে সরে যাওয়া মরহুম আবদুস সামাদ আজাদ ভাঙনের পর রসিকতা করে বলেছিলেন, রাজ্জাককে ফরিদপুরের ট্রেনে তুলে দিয়ে এলাম। এমনও বলেছিলেন, সবাই বলে রাজ্জাক গ্রুপ, তোফায়েল গ্রুপ আর আমরা বলি, আমরাই এখন শেখ হাসিনা গ্রুপ। সর্বশেষ আবদুর রাজ্জাকের কাছ থেকে সরে আওয়ামী লীগে থেকে গিয়ে মরহুম আবদুল মালেক উকিল বলেছিলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলের প্রয়াত ও জীবিত অনেক নেতার প্রতি মনে দুঃখ-বেদনা-ক্ষোভ না রেখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে সবার ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা করে দিতে পারেন। মানুষ হিসেবে পৃথিবীর তাবৎ রাজনীতিবিদের জীবনে ভুল-ত্রুটি রয়েছে। কিন্তু সাফল্যই তাঁদের অমরত্ব দিয়েছে। আওয়ামী লীগের জীবিত ও প্রয়াত নেতাদের সবাই জীবন ও ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে যে অবদান রেখেছেন, যে নেতা-কর্মী তৈরি করেছেন, তা আওয়ামী লীগকেই শক্তিশালী করেনি, দেশের রাজনীতিকেই আলোকিত করেনি, ইতিহাসকেও সমৃদ্ধ করেছে।
২৪ ডিসেম্বর ছিল মরহুম আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যুবার্ষিকী। টিএসসির আলোচনা সভায় কয়েক বছর আগে একবার গিয়েছিলাম। সেদিনও গিয়ে দেখলাম ছাত্রলীগ করার কারণেই হয়তো এবারও আমাকে এবং একাত্তর টিভির বন্ধু মোজাম্মেল বাবুকেও আলোচনায় রাখা হয়েছে। বর্ষীয়ান নেতা আমির হোসেন আমু, রাজনীতির জীবন্ত কিংবদন্তি তোফায়েল আহমেদসহ অনেক নেতাই এসেছিলেন। মোজাম্মেল বাবু আলোচনায় বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর বাকশাল বা দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যই আবদুর রাজ্জাকের আশীর্বাদ নিয়ে ’৮১ সালে আমরা ছাত্রলীগ ভেঙেছিলাম। মোজাম্মেল বাবুর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে বলেছি, ইতিহাসের সত্যের সঙ্গে তাঁর এ বক্তব্য সাংঘর্ষিক। মোজাম্মেল বাবু এখনো একদলীয় বাকশাল-ব্যবস্থায় বিশ্বাস করলেও আমি তা করি না। আমার বিশ্বাস জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ আজন্ম সংসদীয় গণতন্ত্রের বাতিঘর। ’৭৫-এর বাকশাল ছিল বিশ্বরাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতি তথা সদ্যস্বাধীন দেশের অস্থির অশান্ত সময়ের এক সাময়িক পদক্ষেপ, যা বঙ্গবন্ধুর ভাষণেই নির্দেশনা রয়েছে।
বাকশাল প্রবর্তন সঠিক না ভুল ছিল, তা নিয়ে ইতিহাসের বিচার-বিশ্লেষণ এখনো চলছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একজন মহান নেতা, গণতন্ত্র ও জাতিসত্তার ঐক্যের প্রতীক এবং বিশ্বের শোষিত মানুষের পক্ষে অবস্থান নেওয়া, সাহসী বিশ্ববরেণ্য রাজনীতিবিদ। দিন যত যাচ্ছে, আপন মহিমায় তিনি ততটাই উজ্জ্বলতর হয়ে উপমহাদেশেই নয়, বিশ্বরাজনীতিতে মহানায়কের বেশেই আভির্র্ভূত হচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ পরিপূরক শব্দ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানকে বাদ দিয়ে যেমন এ দেশের ইতিহাস রচনার শুরু ও শেষ হয় না, তেমনি হিমালয়সম উচ্চতার অধিকারী মহানায়কের ছায়ায় তৈরি হওয়া রাজনীতির নায়কদের ও বীর যোদ্ধাদের বাদ দিয়েও এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং আওয়ামী লীগের ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়।
মাঝে মাঝে আমি কিছু প্রশ্নের উত্তর পাই না। বঙ্গবন্ধুর খুনি বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণকারী নেতারা আওয়ামী লীগ করে মৃত্যুবরণ করলেও সেদিনের প্রতিরোধযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমসহ তাঁর সতীর্থরা কেন আওয়ামী লীগ করতে পারলেন না? যাঁরা বঙ্গবন্ধুকন্যাকে দলের নেতৃত্বে ও স্বদেশে ফিরিয়ে এনে তাঁর হাতকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখলেন, তাঁদের অনেকেই কেন আওয়ামী লীগে অথবা দল ও সরকারে অবহেলিত? আজকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকের অভাব নেই। গোটা দেশ ক্ষমতানির্ভর আওয়ামী লীগের বন্দনায় যে তুমুল প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সেখানে ’৭৫-উত্তর দুঃসময়ে যারা দলটি ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাতি জ্বালাতে অদম্য সাহস রেখেছিলেন তাঁরা কেন অন্তহীন দহনে দগ্ধ ও উপেক্ষিত? এককালের স্বাধীনতাবিরোধী, মুজিববিদ্বেষী, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা-বিরোধীরা ক্ষমতার ১১ বছরে রাতারাতি যেভাবে আওয়ামী লীগ হয়ে গেছেন তাতে প্রশ্ন আসেÑ দলটি বিরোধী দলে গেলে এঁরা পাশে থাকবেন তো? মুজিববর্ষ উদ্যাপন কমিটিতে যেখানে দেশের চিহ্নিত রাজাকার-সন্তানরা ঠাঁই পান, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা কপালে জোটে, তখন মনে সংশয় জাগে দলটি ভুল করছে না তো?
একটা অস্থির, অশান্ত সময় আমরা অতিক্রম করছি। সিলেট ও সুনামগঞ্জে গিয়েছিলাম দুটি বিয়ের অনুষ্ঠানে। আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তানদের বিয়েতে অনেকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, কথাবার্তা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রতি গভীর আবেগ-অনুভূতি ও আনুগত্য রাখা বিভিন্ন পেশার মানুষ বলেছেন সত্য লিখতে ও বলতে। গণমাধ্যমের যাঁরা সর্বত্র ছুটে বেড়ান, মুজিবকন্যার ক্ষমতার ছায়ায় যেসব আমলা দাপুটে ক্ষমতা ভোগ করেন, যেসব রাজনীতিবিদ-মন্ত্রী-এমপি-নেতা আছেন মানুষের অন্তরের কথা শুনতে পান কিনা জানি না। তবে মানুষের ভাষা শুনে মনে হয়েছে, ক্ষমতা তাঁদের অনেককেই কাচের দেয়ালে বন্দী করেছে। চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে ক্ষমতার দম্ভে এতটাই মোহাচ্ছন্ন যে, মানুষের ভাষা শুনতে পাচ্ছেন না। অনেকের প্রশ্ন ছিল, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান কি বন্ধ হয়ে গেছে? আমি কোনো জবাব দিতে পারিনি। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান নিজের অতীত ভুলে না যাওয়া আপাদমস্তক গণমুখী, সৎ, সজ্জন মানুষ হিসেবে যেখানে সব এমপিকে নিয়ে সিলেট-সুনামগঞ্জের উন্নয়নে আন্তরিকতার সঙ্গে কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন, মানুষের হৃদয় জয় করে পথ হাঁটছেন, সেখানে তাঁর নিজ জেলার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বই নাকি উন্নয়ন হচ্ছে না বলে বিভিন্ন মহলকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। মন্ত্রী-এমপিরা যেখানে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ডের চিত্র তুলে ধরে বলছেন, এগুলো জনগণের প্রতি শেখ হাসিনার উন্নয়নের অঙ্গীকার পূরণ, সেখানে এমপি হতে না পারা গণবিচ্ছিন্ন দলের স্থানীয় নেতৃত্ব সমালোচনায় মুখর! বিষয়টি অবাক করেছে।
যাক, এ লেখা যখন জমা দিচ্ছি, তখন বিদায়ী বছরের শেষ সূর্য অস্তমিত হয়েছে। এ লেখা যখন পাঠকের হাতে যাবে তখন ২০২০ সালের ইংরেজি নববর্ষের নতুন সূর্য উদিত হবে। ইংরেজি নববর্ষের ৩০ জানুয়ারি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হতে যাচ্ছে। নানান বিতর্কের মুখে দক্ষিণে অশ্রুজলে আওয়ামী লীগের অবিভক্ত ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফপুত্র সাঈদ খোকন মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন। সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন মুজিববাহিনীর অন্যতম প্রধান যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণির পুত্র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। সাঈদ খোকনের কান্না নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাঁরা উল্লাস করছেন তাঁরা মানসিক বিকৃতির পরিচয় দিচ্ছেন। মানুষের জীবনে ভুল-ত্রুটি, উত্থান-পতন থাকে। মানুষের সুসময়ে স্তাবক, দুঃসময়ের সমালোচক কখনো উত্তম নন। অকালপ্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ও রুবানা হক দম্পতির কন্যার বিয়েতে সাঈদ খোকন কুশল বিনিময়কালে বলেছিলেন, একবার মেয়র হওয়ার ইচ্ছা ছিল, হয়ে গেছি। কিছুটা অবাক হয়েছিলাম, তাঁর মরহুম পিতা মোহাম্মদ হানিফ একজন ক্যারিশমাটিক নেতা ছিলেন। বাগ্মিতা, আচরণে মানুষকে সম্মোহন করার অসাধারণ ক্ষমতা রাখতেন। গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা নিয়ে বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে বিশাল ভোটে জয়লাভই করেননি, জনতার মঞ্চের নায়ক হয়ে বিএনপি সরকারবিরোধী অভ্যুত্থানে অনন্যসাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর ভিতরেও অনেক বেদনা ছিল। মৃত্যুর আগে দলের ওয়ার্কিং কমিটিতে জীবনের শেষ বক্তৃতায় কিছুটা বলে গেছেন। মেয়র থাকাকাল আমি যখন মাঠের রিপোর্টার, তখন প্রায় রাতে টেলিফোন করে কখনো বা ডেকে নিয়ে পরামর্শ করতেন। সাঈদ খোকনের বয়স পড়ে আছে। হয়তো স্তাবকের ভিড়ে মানুষের ভাষা, দলের কর্মীদের আবেগ-অনুভূতির ভাষা শুনতে পাচ্ছিলেন না। রাজনীতি ধৈর্যের পরীক্ষা, এখান থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে আগামী দিনে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ রয়েছে। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন তাঁদেরও মনে রাখা উচিত মানুষের ভাষা না শুনে কাচের দেয়ালে বন্দী থাকলে ভুলের চোরাবালিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোই রাজনীতির পাঠ।
আওয়ামী লীগ প্রার্থী ব্যারিস্টার তাপসের বিপরীতে বিএনপিদলীয় সাবেক মেয়র মরহুম সাদেক হোসেন খোকার পুত্র ইশরাক হোসেন প্রার্থী হয়েছেন। রাজনীতিতে একদম নবাগত হলেও তাঁর পিতা ও দলের ভোটব্যাংক রয়েছে। তেমনি তাপসের তিনবারের সংসদ সদস্য ও একজন খ্যাতিমান আইনজীবী হিসেবে আছে ক্লিন ইমেজ।
উত্তরে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতৃত্ব থেকে প্রার্থী দেয়নি। আবারও অকালপ্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুতে উপনির্বাচনে বিজয়ী গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আতিকুল ইসলামকে প্রার্থী করেছে। আনিসুল হকের কাজের নিদর্শন সামনে নিয়ে এক বছরে আতিক চমক দেখাতে না পারলেও নিজেকে বিতর্কের বাইরে রাখতে পেরেছেন। অন্যদিকে আবার বিএনপি প্রার্থী হয়েছেন তরুণ ব্যবসায়ী ও ক্রীড়া সংগঠক এফবিসিসিআইর সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল আউয়াল মিন্টুর পুত্র তাবিথ আউয়াল।
বিগত বছর জাতীয় নির্বাচন থেকে অনেক নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের দিনটিকে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের বিজয় দিবস ও বিএনপি কালো দিবস হিসেবে পালন করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো যে যাই বলুক, মানুষের বিবেকের আয়নায় যা লেখার তা লেখা হয়ে আছে। মহাকালের ইতিহাসে বাকিটা লেখা হবে। এ নির্বাচনে কে জিতল, কে হারল এ নিয়ে কে সরকারে থাকবে, না থাকবে তার কিছু যায় আসে না। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কাছে অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতায় নববর্ষের শুরুতে কিছু আশা করা ভুল। কিন্তু এক কথায় বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে আশা করা যেতেই পারে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দল মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত (নারী) কাউন্সিলর আসনে প্রার্থী দিয়ে যেভাবে ভোটযুদ্ধে নেমেছে তাতে ইংরেজি নববর্ষের শুরুটা অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে শুরু হতে পারে। অনেকের অভিযোগ কত দিন ভোট দিতে পারেনি। ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনে ব্যালটের লড়াইয়ে গণতন্ত্রের দুয়ার খুলে যাক। নির্বাচন হোক উৎসবমুখর। নগরবাসীর রায়ের প্রতিফলন ঘটুক। নগরবাসী যেন অবাধে ভোট দিয়ে বলতে পারে, আমার ভোট আমি দিলাম, যাকে খুশি তাকে দিলাম। নতুন বছরে অবাধ, নিরপেক্ষ সিটি নির্বাচন হতে পারে রাজনীতিতে বড় উপহার।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।