রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

একটি হর্ন জীবনের জন্য অভিশাপ

ফাতিমা পারভীন

একটি হর্ন জীবনের জন্য অভিশাপ

আমার জীবন জন্মলগ্ন থেকেই একটু ব্যতিক্রম। আমি মা-বাবার পঞ্চম মেয়েশিশু। বয়ঃসন্ধিকালের সময় পার হতেই আমার সঙ্গে প্রহসন করা হয়েছিল। বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছিলাম আমি। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর একদম শেষ সারির মানুষ হিসেবে নিজের স্থান হয়েছিল। নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও লড়াই করে নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। ওই জীবনের নিবন্ধ লিখতে গেলে লেখার পরিসর বেড়ে যাবে; যা এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। শুধু এটুকুই বলতে পারি, চলমান জীবনে একটু একটু করে ব্রেক কষা একজন মানুষ আমি, জীবনযুদ্ধে হেরে যেতে শিখিনি বলেই স্বর্ণালি বারান্দায় আজ এক চিলতে আলো দেখেছি। ২০১২ সালে আমার স্বামী মারাত্মক অসুস্থ হন। তাকে  বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, কিন্তু যাব কীভাবে? ওই সময় বেগম খালেদা জিয়া বিরোধী দলের নেতা। দিয়েছিলেন অনির্দিষ্টকালের অবরোধ। রাস্তাঘাটে কোনো বাস চলছে না। মাথায় সবার আসমান ভেঙে পড়ল। বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মধ্যে আমাদের পাথরঘাটা ছিল অন্যতম। স্থানীয় হাসপাতালের একটি মাত্র অ্যাম্বুলেন্স যাও কিনা যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে অকেজো! সেদিন মোটরসাইকেলে অনেক কষ্ট করে অবশেষে আমরা পৌঁছলাম বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে। সেদিনের সেই দীর্ঘ পথে রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছানোর কষ্ট সারা জীবনেও ভুলতে পারব না। ভুলতে পারব না বারবার পথ আটকে দেওয়া যুবকদের আচরণ। বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে জানতে পারলাম তার সবচেয়ে বড় ব্যাধিটিই হয়েছে। ডাক্তাররা সাময়িক চিকিৎসার সঙ্গে ছয় ব্যাগ ব্লাড দিয়ে ঢাকায় রেফার করে দিলেন। কারণ এখানে চিকিৎসক সংকট। ডাক্তারের ভাষায় বুঝতে বাকি রইল না যে তার কোলন ক্যান্সার হয়েছে। তখন আমার জীবনে একটাই চাওয়া, তার টিউমারটা যেন বিনাইন হয় আর আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে কাক্সিক্ষত প্রত্যাশা হলো, একজন মানুষ হিসেবে তিনি সুস্থভাবে বেঁচে থাকবেন। ঢাকা শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে তৃষ্ণার্ত কাকের মতো দৌড়াচ্ছি। কোনো ডাক্তার যেন আশার বাণী শোনান। ওই সময় ঢাকা শহরের কিছুই চিনতাম না। ট্রাফিক পুলিশের কাছে ডায়াগনোসিসের নাম বলে ঠিকানা সংগ্রহ করেছি। নতুন নতুন ডায়াগনোসিসের শরণাপন্ন হয়েছি। নতুন আগন্তুক ভেবে সিএনজি-চালক এদিক-সেদিক ঘুরে ভাড়া দ্বিগুণ নিয়েছেন, তার পরও কোনোক্রমেই ডায়াগনোসিস কনফার্ম করা যাচ্ছিল না। অবশেষে ডায়াগনোসিস কনফার্ম হলো, ইডেন মাল্টি কেয়ার হসপিটালে অপারেশন হলো তার। কিন্তু পরবর্তীতে ৬ সাইকেল কেমো থেকে রক্ষা পেলেন না। ব্যয়ের কথাটি বাদ দিলাম কারণ প্রতিটি প্রাইভেট ডায়াগনোসিসের সেবার প্রতি আমার বড়সড় অভিযোগ থাকলেও দ্রুত সেবা পেতে তাদের কাছে যেতে হয়। প্রায় সাত বছর পর আবারও তার ক্যান্সার রিকারেন্স হলো। তিনি আবারও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এবার আমার কাছে সুপরিচিত ঢাকা বিএসএমএমইউর ডা. মামুনুর রশীদ সাহেব আমার কাছে মনে হলো একজন ফেরেশতা। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য। অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হলো। আমরা সেখানে খুব দ্রুত সেবা নিতে সক্ষম হলাম। একদিন ইচ্ছা করেই সাধারণ মানুষের লাইনে দাঁড়িয়ে দেখলাম ওই মানুষগুলো কেমন সেবা পাচ্ছে। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে বায়োপসি রিপোর্ট নিলাম। অবাক হলাম সেখানে এই প্রথম প্রিয় দেশের বুকে দেখলাম কোনো ভেদাভেদ নেই। বিএসএমএমইউর সেবায় কেউই আলাদা নয়। মনে মনে স্যালুট করলাম দেশের ওই আমূল পরিবর্তনকে। অসংখ্য মানুষের ভিড়, লাইনে দাঁড়িয়ে রিপোর্ট নিয়ে এলাম সংশ্লিষ্ট সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাহাদাত হোসেন শেখ সাহেবের কাছে। মানবতার সেবায় আরেকজন নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক। বিভিন্ন পরীক্ষা করতে করতে অনেক সময় ব্যয় হলো, রিপোর্ট অনুযায়ী ততক্ষণে রোগীর অবস্থা শোচনীয়। নিজের পরিবারের এহেন পরিস্থিতিতে না পড়লে বুঝতে পারতাম না, দেশে এখনো কত কত জায়গায় চিকিৎসক সংকট। দেশের হসপিটালে অপারেশন করতে পরিবারের কেউ রাজি হলেন না, কিন্তু আমিই জানতাম তার দ্বিতীয় পর্ব অপারেশন কতটা দ্রুত দরকার। আবার অনেক উঁচু ঝুঁকিও রয়েছে। তা জানা সত্ত্বেও অপারেশনে রাজি হলাম কারণ একটি টিউমার তার সিকামের রাস্তাটি প্রায়ই বন্ধ করে দিয়েছে। ক্লোনোজকপি টিউব দিয়ে পুরোপুরি পরীক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন ডাক্তার। এ অবস্থায় অপারেশন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শরীর থেকে দ্রুত রক্ত কমে যাচ্ছিল। ওজন কমে যেতে লাগল। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের একটি গবেষণা বলছে, শরীরের ক্যান্সার যখন স্টেজ ৪ হয়, তারপর আর স্টেজ ৫ হয় না, হয়ে যায় ৮ স্টেজ। অথচ পরিবারের সবাই বললেন চেন্নাই গিয়ে চিকিৎসা করাতে। আমার জীবন এক গোলক-ধাঁধায় বাঁধা পড়ল। হসপিটাল, ডায়াগনোস্টিক, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যেতে যেতে আমার স্যান্ডেলের তলা ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিল। ওই মুহূর্তে পরিবারের কাউকে দেশের চিকিৎসাসেবা নিতে পাশে পেলাম না। তার জীবনের দিকে তাকিয়ে আমি শক্ত হয়ে মোকাবিলা করতে লাগলাম। অনেক সাহস আর মনোবল তৈরি করে আমার বরের পাশে বসে তাকে সাহস জোগালাম। দু-তিনজন ছাড়া সবার কল রিসিভ করা বন্ধ করে দিলাম, অবশেষে  ল্যাবএইড হাসপাতালে অপারেশন সফল হলো। অবজারভেশন রুমে ডাক্তার বললেন, পেশেন্টের ঘুমের খুবই দরকার। ওই রাতে তার ঘুম ছিল আমাদের জন্য উদীয়মান সূর্য, সদ্য ফোটা ফুলের মতো। কিন্তু রাস্তায় অনাকাক্সিক্ষত প্রাইভেট কার, হোন্ডা, বাস আর পরিবহনের হর্ন তাকে ঘুমাতে দিল না। আবার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা তো আছেই। কতক্ষণ পরপর আরও বেশি হুইসেল বাজিয়ে যাচ্ছে অ্যাম্বুলেন্স রোগী থাকুক আর নাই থাকুক। রোগীর জন্য ঘুম কতটা প্রয়োজন সেদিন তা নিজ থেকেই উপলব্ধি করেছিলাম। ঘুমের অভাব জীবনে কতটা ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে যদি ওই চালকরা বুঝতে পারতেন তবে হসপিটালের পাশে অন্তত হর্ন বাজাতেন না। সেদিন তার ছটফটানি মনে এক ক্ষত তৈরি হলো। দেশের চালকদের সচেতন করা খুবই জরুরি। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এমনকি ভারত সফরকালে অনাকাক্সিক্ষত হর্ন কিংবা বেপরোয়া গতির দেখা পাইনি। দেখিনি ঢাকার মতো যানজট। যা দেখেছি তা হলো সংকেতবাতি আর আধা কিমি পরপর লেখা ‘গো স্লো’।

লেখক : নারী ও শিশু অধিকার কর্মী।

[email protected]

সর্বশেষ খবর