শিরোনাম
সোমবার, ১৩ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

ধৈর্য ধারণই কেবল চীন-ভারত যুদ্ধ ঠেকাতে পারে

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

ধৈর্য ধারণই কেবল চীন-ভারত যুদ্ধ ঠেকাতে পারে

আজকের লেখাটি আমার গত পাক্ষিকের, অর্থাৎ ২৯ জুন সোমবারের লেখার ধারাবাহিকতায় একই বিষয়ের ওপর দ্বিতীয় কিস্তি। চলমান আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে চীন-ভারত সম্পর্কের ওঠা-নামার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমার লেখা যারা নিয়মিত পড়েন তাদের কয়েকজন ২৯ জুনের লেখা পড়ার পর বলেছেন, সীমান্তে ১৫ জুনে সংঘটিত ঘটনার প্রেক্ষাপটে দুই পক্ষের তরফ থেকেই যে রকম প্রপাগান্ডা ও মানসতান্ত্রিক ক্যাম্পেইন চলছে সেটা কি সহসাই থেমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, নাকি তার জের ধরে ১৯৬২ সালের মতো আরেকটি যুদ্ধ ঘটতে পারে তার ওপর আরও বিশ্লেষণমূলক মন্তব্য প্রয়োজন। তাদের অনুরোধ রাখতেই আজকের লেখা। গত লেখায় মূলত সাম্প্রতিক সংঘর্ষের প্রধান প্রধান কারণ উল্লেখপূর্বক একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরেছি। পাঁচটি সুনির্দিষ্ট কারণের মধ্যে তিব্বত নিয়ে আগামী দিনে আমেরিকা কেন এবং কী সমস্যা চীনের জন্য সৃষ্টি করতে পারে তার একটা বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম। আমেরিকা যদি গত শতকের পঞ্চাশের শেষ ও ষাটের দশকের মতো তিব্বতে গোপন অপারেশন চালাতে চায় তাহলে ভারতের সহযোগিতা অপরিহার্য। ১৯৬২ সালে সংঘটিত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকিয়ে কেউ যদি বর্তমান পরিস্থিতির দিকে নজর দেন তাহলে অনেক কিছুর মধ্যেই মিল খুঁজে পাবেন। শঙ্কাটি সে কারণেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৫৭ সালে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ কর্তৃক তিব্বতে গোপন অপারেশন শুরুর আগ পর্যন্ত চীন-ভারত সম্পর্ক যে পর্যায়ে ছিল তাতে কেউ কখনো চিন্তাই করতে পারেনি দুই দেশের মধ্যে এমন একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ বেধে যেতে পারে। তখন তিব্বত অপারেশনের সঙ্গে জড়িত সিআইএ কর্মকর্তা জন কেনেথ কেনাউস ১৯৯৯ সালে একটি বই লিখেছেন যার নাম অরফানস অব কোল্ড ওয়ার। তাতে উল্লেখ করেছেন, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকাতে কুর্মিটোলায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিত্যক্ত বিমান ঘাঁটির রানওয়ে ব্যবহার করে ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত সিআইএ সি-১১৮ ও সি-১৩০ পরিবহন বিমানের মাধ্যমে প্রায় ৩০ বার তিব্বতের অভ্যন্তরে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদসহ সব যুদ্ধ সরঞ্জামাদি ড্রপ করে। মাও সেতুংয়ের ধারণা হয় এর সঙ্গে ভারতের যোগসাজশ রয়েছে। যদিও ১৯৫০ সালে চীন কর্তৃক তিব্বত দখল করা প্রসঙ্গে দিল্লির দক্ষিণ ব্লকের একটা অংশ এবং মিডিয়া এটিকে ভারতের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি বলে বিশাল হৈচৈ শুরু করলেও প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরু তার সঙ্গে সায় দেননি, বরং চীনের সঙ্গে সুসম্পর্কের গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীতে নেহরু সে জায়গায় থাকতে পারেননি। এসব কথায় একটু পরে আসছি। তার আগে আরও কিছু ঘটনার দিকে তাকানো দরকার। ১৯৫৬ সালের আগ পর্যন্ত দুই দেশের সম্পর্ক ছিল চীন-ভারত ভাই-ভাই। মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট চায়না, অর্থাৎ পিপলস রিপাবলিক অব চায়নাকে যে স্বল্প স্বল্প কয়েকটি দেশ প্রথম দিকে স্বীকৃতি দেয় তার মধ্যে ভারত ছিল অন্যতম। ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে জওহরলাল নেহরু আমেরিকায় রাষ্ট্রীয় সফরের সময় প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ারের কাছে জোর দাবি জানান, যাতে ন্যাশনালিস্ট চায়নার পরিবর্তে কমিউনিস্ট চায়নাকে ভেটো ক্ষমতাসহ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য করা হয়। কিন্তু চীন সম্পর্কে কোরিয়ান যুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতায় আইসেন হাওয়ার নেহরুর প্রস্তাবকে গ্রহণ করেন না। ১৯৫১ সালের ২৬ জানুয়ারি বেইজিংয়ে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস কর্তৃক আয়োজিত প্রথম রিপাবলিক দিবসের অনুষ্ঠানে মাও সেতুং সশরীরে স্ত্রীসহ উপস্থিত হন, যা ছিল একদম অনন্য ঘটনা। কারণ, মাও সেতুং তার জীবদ্দশায় কখনো অন্য কোনো অনুষ্ঠানে যাননি। সেই অনুষ্ঠানে মাও সেতুং ঘোষণা দেন, চীন-ভারতের বন্ধুত্ব হাজার হাজার বছর টিকে থাকবে। ১৯৫৪ সালে পাঁচটি প্রধান নীতির ওপর ভিত্তি করে চীন-ভারতের মধ্যে আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা হিন্দি ভাষায় পঞ্চশীলা নামে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯১৪ সালের সীমান্ত চুক্তির ব্যত্যয় ঘটিয়ে আকসাই চীন ও পূর্ব প্রান্তের অরুনাচল প্রদেশ চীনের মানচিত্রে দেখানোর বিষয়টি ১৯৫৪ সালে বেইজিং সফরকালে নেহরু চৌ-এন লাইয়ের কাছে উত্থাপন করেন। চৌ-এন লাই বলেন, ওই মানচিত্র পুরনো, নতুন মানচিত্র এখনো ছাপা হয়নি। তাতে নেহরু সন্তুষ্ট হতে পেরেছিলেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ভারতের অগোচরে আকসাই চীনের ওপর দিয়ে ১৯৫৬ সালের শেষের দিকে চীন তিব্বতের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের রাস্তা নির্মাণ সম্পন্ন করে ফেলে। আমেরিকাই ১৯৫৭ সালে ভারতকে রাস্তা নির্মাণের বিষয়টি জানিয়ে দেয়। তারপর থেকেই চীন-ভারত, দুজনার চলার পথ দুই দিকে ঘুরে যায়। চৌ-এন লাই নেহরুকে জানায়, তিব্বতের ওপর সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যেই এই রাস্তার জায়গাটুকু চীনের জন্য অপরিহার্য, এর কোনো বিকল্প নেই। এই দুশ্চিন্তার পেছনে ভারত নয়, আমেরিকার কাছ থেকেই বিপদের আশঙ্কা কাজ করেছে, যা পরবর্তীতে সঠিক প্রমাণিত হয়। চৌ-এন লাই প্রস্তাব করেন, আকসাই চীনের ওই অংশটি চীনের মধ্যে থাকবে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত যদি এটা মেনে নেয় তাহলে পূর্ব প্রান্তের অরুনাচলসহ সব জায়গার দাবি চীন ছেড়ে দেবে এবং ১৯১৪ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তিকে স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু তত সময়ে নেহরুর জন্য উভয় সংকট সৃষ্টি হয়ে গেছে। ভারতের অভ্যন্তরে বিরোধী দল, মিডিয়া এবং জনগণের মধ্যে ব্যাপক হৈচৈ সৃষ্টি হয় এবং সবাই নেহরুর ওপর প্রচন্ড চাপ দিতে থাকে, কোনোভাবেই চীনের এই অঘোষিত আগ্রাসনকে মেনে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, বরং এটিকে বিনা জবাবে ছেড়ে দেওয়া যাবে না, যে কোনো মূল্যে সম্পূর্ণ আকসাই চীন ভারতের মধ্যে থাকতে হবে। নেহরু নিজেও জানতেন এবং সেনাপ্রধান জেনারেল থিমাইয়া স্পষ্ট করে বলে দেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সার্বিক সক্ষমতার বিবেচনায় এ সময়ে যুদ্ধ করে চীনের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। ফলে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এবং সিদ্ধান্তহীনতায় একটা সময় পেরিয়ে যায়। ইতিমধ্যে আমেরিকা তিব্বতের অভ্যন্তরে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের দ্বারা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করিয়ে দেয়। তাতে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। সেনাপ্রধান জেনারেল থিমাইয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণ মেননের প্রচন্ড দ্বন্দ্ব শুরু হয়। একপর্যায়ে থিমাইয়া পদত্যাগ করেন। নতুন সেনাপ্রধান হন পি এন থাপার। মাও সেতুং ও চৌ-এন লাইয়ের আপসরফার প্রস্তাব ভারতের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় বলে ১৯৬২ সালের মাঝামাঝিতে নেহরু স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী ফরোয়ার্ড পলিসি গ্রহণ করে। সীমান্তের কাছাকাছি তারা প্রায় ৬০টির মতো নতুন অগ্রবর্তী সেনা পোস্ট স্থাপন করে। ১৯১৪ সালে মানচিত্রের ওপর সীমান্ত রেখা টানা হলেও জনমানবশূন্য দুর্গম এলাকায় গ্রাউন্ডে প্রকৃতপক্ষে তার সঠিক নিশানা কোনো পক্ষেরই জন্য ছিল না, এখনো নেই। নতুন সেনা পোস্টকে চীন আগ্রাসন মনে করে এবং ধরে নেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী চীনের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। সীমান্তে দুই সেনাবাহিনীর মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে, যে রকম বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে। ১৯৬২ সালের অক্টোবরের প্রথম দিকে নেহরু শ্রীলঙ্কায় যাত্রার প্রাক্কালে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, আমি সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছি ভারতের ভূমি উদ্ধার করার জন্য। পরের দিন নিউইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকা প্রধান শিরোনাম করে, নেহরু চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ১৯৬২ সালের ২০ অক্টোবর চীন পুরো সীমান্তজুড়ে একসঙ্গে ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়। মাও সেতুং প্রধানত দুটি বার্তা দেওয়ার জন্য সরাসরি যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমত, আকসাই চীনের রাস্তার ওই অংশটি কখনোই চীন ছেড়ে দেবে না এবং তিব্বতের অভ্যন্তরে আমেরিকার গোপন অপারেশনের সঙ্গে ভারত যুক্ত হলে তার পরিণতি ভারতকে বহন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমেরিকাকে বার্তা দেওয়া যে, এশিয়ায় চীনই সর্ব বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। মাঝখানে কয়েক দিন বিরতিসহ ২০ নভেম্বর চায়না কর্তৃক একতরফাভাবে পরিপূর্ণ যুদ্ধ বিরতি ঘোষণার আগ পর্যন্ত, প্রায় এক মাসের যুদ্ধ পূর্বপ্রান্তের পুরো অরুণাচল দখল করে চীনা সেনাবাহিনী প্রায় আসামের সীমান্ত পর্যন্ত চলে আসে। পশ্চিমে আকসাই অঞ্চলে প্রায় ১৪৩৮০ বর্গ মাইল এলাকা চীনের দখলে চলে যায়। যুদ্ধ বিরতি ঘোষণার পর চীন পূর্ব প্রান্তের সম্পূর্ণ এলাকা ছেড়ে দিয়ে পেছনে যুদ্ধ শুরুর পূর্ববর্তী জায়গায় চলে যায়। তবে আকসাই চীনের সম্পূর্ণ এলাকা দখলে রেখে দেয়। যা এখনো চীনের দখলে আছে। চীন কর্তৃক একতরফা যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা, পূর্ব প্রান্তের সব দখলকৃত এলাকা ছেড়ে দেওয়ার পেছনে মাও সেতুংয়ের স্ট্র্যাটেজিক কারণ ছিল। প্রথমত বিশ্বব্যাপী বার্তা দেওয়া যে, বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে চীন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের আচরণ করতে জানে। সুতরাং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তার ন্যায্য সদস্য পদ পাওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, ভারতসহ সারা বিশ্বকে বার্তা দেওয়া, চীনের সম্প্রসারণবাদী চিন্তা নেই, শুধু তিব্বতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে জরুরি আকসাই চীনের দুই অংশটুকু পেলে বাকি সব দাবি ছেড়ে দিয়ে চীন ১৯১৪ সালের চুক্তি মেনে নেবে। যুদ্ধের পর এ ব্যাপারে নাকি চৌ-এন লাই নেহরুকে চিঠিও দিয়েছিলেন। কিন্তু এটা নেহরুর জন্য আরও কঠিন দ্বন্দ্ব ও সমস্যার সৃষ্টি করে। কারণ একই প্রস্তাব চীন যুদ্ধের আগে দিয়েছিল, তাহলে যুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয়ের পর ওই একই প্রস্তাব মেনে নেওয়ার কী যুক্তি আছে। তারপর আজ প্রায় ৫৮ বছর পেরিয়ে গেলেও পরিস্থিতি ঠিক ওই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে চীন-ভারতের অভ্যন্তরে এবং বিশ্ব ব্যবস্থাসহ বৈশ্বিক ক্ষমতা বলয়ের সমীকরণ ও মেরুকরণে বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে। চীন-ভারতের সীমান্তে যা ঘটে চলেছে তা মোটেই দুই দেশের সীমান্ত রেখা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে নয়, বরং পুরো অঞ্চল ও বৈশ্বিক জায়গায় যা ঘটে চলেছে এবং সেখানে দুই দেশের মধ্যে যে বিশাল দূরত্ব পারস্পরিক সন্দেহের সৃষ্টি হচ্ছে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সীমান্তে। চীন ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের এক নম্বর ক্ষমতাশালী রাষ্ট্র হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ভারতও উদীয়মান শক্তি। ভারতের সেনাবাহিনী ১৯৬২ সালের অবস্থায় নেই। তারাও সুসংঘটিত ও শক্তিশালী। ১৯৬২ সালের গ্লানিমুক্ত হওয়ার একটা আকাক্সক্ষা ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ২০১৭ সালে প্রায় আড়াই মাস দুই দেশের সেনাবাহিনী ভুটানের পাশে দোকলাম এলাকায় মুখোমুখি অবস্থায় থাকার পর যেভাবে আবার সহাবস্থানের জায়গায় ফিরে গেল এবং ২০১৮ ও ২০১৯ সালে শি জিন পিং ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে সম্পর্কের একটা উষ্ণ আলিঙ্গন দেখার পর মনে হয়েছিল দুই পক্ষই বোধ হয় বুঝতে পেরেছে, যুদ্ধের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে না, বরং আরও জটিলতার সৃষ্টি করবে, যেটা ১৯৬২ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক কারণে তাইওয়ান মূল ভূখন্ডের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার আগ পর্যন্ত চীন অন্য যে কোনো যুদ্ধ এড়িয়ে চলতে চাইবে, বিশ্লেষণে সে কথাই আসে। অন্যদিকে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার স্বার্থে এবং নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য পদ প্রাপ্তি ও সম্মানজনক নিউক্লিয়ার সাপ্লাই গ্রুপে প্রবেশের আগ পর্যন্ত ভারতও যুদ্ধ এড়িয়ে চলতে চাইবে, সে কথাও বিশ্লেষণে আসে। কিন্তু মে মাসের মাঝামাঝিতে হঠাৎ করে নাটকীয়ভাবে অবস্থার পরিবর্তনের পেছনে অত্র অঞ্চলকে ঘিরে বৈশ্বিক সমীকরণের যোগ-বিয়োগের হিসাবে বড় কোনো গরমিল কাজ করে থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। এখন পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ঠিক ১৯৬২ সালের মতোই একটা প্রেক্ষাপট যেন তৈরি হচ্ছে। দুই পক্ষের মানসতান্ত্রিক যুদ্ধ ও প্রপাগান্ডা ক্যাম্পেইন বলছে এগুলো যুদ্ধ শুরুর পূর্ব লক্ষণ। ১৯৬২ সালে আকসাই চীন অঞ্চলে চীনের রাস্তা নির্মাণ ধরা পড়ার পর ভারতের অভ্যন্তরে নেহরু সরকারের ওপর যেমন প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, এবারও মোদি সরকারের ওপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। গত ৬ জুলাই দুই দেশ আপাতত একটা সহাবস্থানের জায়গায় থাকতে একমত হলেও ৭ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন মতে ভারতের বিরোধী দল, মিডিয়া এবং সাবেক সেনা কর্মকর্তারা বলছেন, চীন আসলে ১৮ কি.মি. ভারতের ভিতর ঢুকে পড়েছে এবং সেখান থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার পেছনে যেতে সম্মত হয়েছে, যা পারতপক্ষে ভারতের ভূখন্ড অবৈধভাবে দখল করে রাখার শামিল। দুই দেশই সীমান্তে ব্যাপকভাবে সেনা সমাবেশসহ সেনা স্থাপনা তৈরি করছে এবং যুদ্ধের মহড়া চলছে। সুতরাং পরিস্থিতি উত্তপ্ত অবস্থায়ই আছে। ১৯৬২ সালের মতো সামনে অক্টোবর-নভেম্বর মাস। ১৯৬২ সালে তিব্বত অন্যতম কারণ ছিল। এবার ডোনাল্ড ট্রাম্প নভেম্বরে পরাজয়ের লক্ষণ দেখলে নির্বাচনের আগে চীনের বিরুদ্ধে যদি বড় কিছু করে বসে, যার আশঙ্কা আছে তাহলে চীন আমেরিকাকে বার্তা দেওয়ার জন্য ১৯৬২ সালের মতো একটা ঝটিকা অভিযানে যেতে পারে। অন্যদিকে মোদি সরকার যদি অভ্যন্তরীণ চাপ উপেক্ষা না করতে পারে তাহলেও পরিস্থিতি যুদ্ধের দিকে মোড় নিতে পারে। আমেরিকার ভিতর এবং বাইরে থেকে বেশির ভাগ মানুষ বলছেন, নভেম্বরে ওয়াশিংটন প্রশাসনে পরিবর্তন হবে এবং সে পথ ধরে বিশ্ব পরিস্থিতিরও একটা পরিবর্তন আসবে। সে পর্যন্ত চীন-ভারত, উভয়পক্ষ যদি ধৈর্য ধারণ করতে পারে তাহলে সেটি গণ্য হবে স্ট্র্যাটেজিক পেশন্স হিসেবে। আসলেই স্ট্র্যাটেজিক ধৈর্যই এই সময়ে যুদ্ধ ঠেকিয়ে রাখতে পারে।

পুনশ্চ : সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা ব্রুস রিডলের লিখিত তিব্বত, দ্য সিআইএ অ্যান্ড দ্য সিনো ইন্ডিয়ান ওয়াব গ্রন্থ থেকে প্রবন্ধের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

               

                লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর