বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

শিক্ষার্থীদের প্রতি মানবিক হতে হবে

ফাতিমা পারভীন

শিক্ষার্থীদের প্রতি মানবিক হতে হবে

পৃথিবীর মহাক্রান্তি লগ্নে লকডাউনের আগের পৃথিবী আজ স্বপ্নের পৃথিবী হয়ে আছে।

আবার সেই স্বপ্নের পৃথিবী হয়তো ফিরে আসবে, তবে সময় লাগবে। তাই এখন থেকেই আমাদের বর্তমান পৃথিবীর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েই বসবাস করতে হবে, হয়তো এটাই হবে আমাদের বাসযোগ্য নতুন পৃথিবী। কেননা এ মুহূর্তে কেউই আমাদের পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য সুরক্ষা সুবিধা নিশ্চিত করতে পারবে না। যদ্দুর সম্ভব নিজের প্রচেষ্টায় সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে। অন্তত ভ্যাকসিন না পাওয়া পর্যন্ত করোনাকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। করোনা আতঙ্ক নয়, সচেতনতা বাড়িয়ে জয় করতে হবে। অতীতে ফিরলে দেখা যায়, কলেরা, ডায়রিয়া ও জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে মারা পড়েছিল অসংখ্য মানুষ। চিকিৎসা ছিল না। ওই মহামারী থেকে বাঁচতে মানুষের গ্রাম থেকে মাইগ্রেশনের কথা বলতে গেলে বড়সড় ফিরিস্তি হবে। তখনো মানুষ একসঙ্গে বাঁচার স্বপ্নে এভাবেই বিভোর ছিল। একসময় আবিষ্কার হলো ওইসব রোগ সংক্রামক, ছোঁয়াচে নয়। চিকিৎসা বের হলো। তখন কিন্তু একসঙ্গে পুরো পৃথিবী সংক্রমিত হয়নি। যা এখন হয়েছে। মানব ইতিহাসের অন্যতম ভয়ঙ্কর শত্রুরূপে করোনাভাইরাস বর্তমানে সারা বিশ্বে ত্রাসের আধার হয়ে ইতোমধ্যে ৪ লাখের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আশার আলো হলো, চিকিৎসাবিজ্ঞানের এত আবিষ্কারের প্রতিযোগিতা আগে ছিল না। ছিল না সরকার তথা সামাজিক কোনো উদ্যোগ। জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রচারে ছিল না তেমন কোনো মাধ্যম। এখন রাষ্ট্রের সঙ্গে কিছু মহৎ মানুষ যেমন জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, ডাক্তার, নার্স আর পুলিশ সদস্যদের অসহায় মানুষের পাশে থাকা মানবতাকে জাগ্রত করে। বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনার সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়া  বিশ্বে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তারা যেভাবে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন, অসহায়, মানসিক প্রতিবন্ধী ও কুকুর খুঁজে খুঁজে খাবার, পোশাক বিতরণসহ সবাইকে সুরক্ষিত রাখতে নিঃস্বার্থভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তা সত্যিকারের দেশপ্রেমের বাস্তব চিত্র। করোনাভাইরাস আতঙ্কে আজ থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শত শত মানুষ আক্রান্ত হয়ে কাতরাচ্ছে। কভিড-১৯-এর কাছে হেরে গিয়ে মৃত্যুবরণ করছে অসংখ্য মানুষ। অন্যদিকে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে দিনমজুরদের জীবন, তাদের মধ্যে লুকিয়ে আছে করোনার চেয়েও ভয়াবহ ক্ষুধা। ওই ক্ষুধা সচেতনতা, মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব জানে না, কিংবা জানে না স্বাস্থ্যবিধি। ওই শব্দগুলো ক্ষুধার কাছে হাস্যকর। নিয়তির নির্মমতার কাছে পরাজিত। তাই দারিদ্র্য ক্ষমা করছে না মহামারী, ছুটছে যে যেভাবে পারে কর্মস্থলে। অন্যদিকে মনুষ্যত্ব ঘুমিয়ে আছে আত্মসাতের কাছে। করোনাভাইরাসে সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। পাশাপাশি নেতাগুলো ব্যস্ত গরিবের চাল ও ত্রাণ চুরিতে। অর্ধশতাধিক জনপ্রতিনিধির বেহায়া আচরণ সুশীল সমাজের রাতের ঘুম হরণ করেছে। কী রকম আহাম্মক আর মূর্খ জনপ্রতিনিধি, পয়সার জন্য যা ইচ্ছা তাই করতে পারে, এদের কাছে ধর্ম, রাজনীতি, কৃষ্টি, সভ্যতা আর জনগণের ভবিষ্যৎ চিন্তার কোনো মানে নেই। অর্থের সীমিত গ-ির মধ্যেই তাদের আনাগোনা। তাদের আত্মার ওপর অন্ধত্বের পট্টি বেঁধে বর্তমান, ভবিষ্যৎ এবং অতীতকে বিসর্জন দিয়ে লোভী কুকুরের মতো অর্থের বেদিতে আত্মাহুতি দিয়েছে তারা। তাদের আত্মার পরিশুদ্ধতা হয়তো আসবে না কোনো দিন। হতভাগা ওইসব জনপ্রতিনিধি জনগণের ভোট পেয়েও আবার সেই জনগণের ক্ষুধার্ত পেটের মধ্যস্থল থেকে আহার টেনেহিঁচড়ে বের করে খায়। তদন্তপূর্বক ওইসব অযোগ্য জনপ্রতিনিধিকে দোষী সাব্যস্ত করে দ্রুত দ-ের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কেননা তাদের ওইসব কুকীর্তির জন্য অধিকাংশ সৎ আর মানবিক জনপ্রতিনিধির জনসেবা আজ বিলুপ্তির পথে। ১৮ মার্চের পর শিশুসহ সব শিক্ষার্থী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক অনলাইনে ক্লাস পরিচালিত হচ্ছে তাই দীর্ঘ বিরতির এই সময়ে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ, কিন্তু আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া উচিত। ক্লাসরুমে যে শিক্ষার্থী ব্র্যান্ডের শার্ট-প্যান্ট পরে আসে তার পাশাপাশি যার একটা শার্টের একটা বোতাম থাকে না তার কথাও ভাবা উচিত। আমার ভাবনায় এ দুই-ই সমান, দুজনেই সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে। সবার সাধ থাকলেও সাধ্য থাকবে- এমনটা না-ও হতে পারে। যদি সবাইকে যথাযথ সুবিধার আওতায় নিয়ে এসে ক্লাস নেওয়া যায়, তার থেকে ভালো আর কীইবা হতে পারে? যদিও এটি সুদূরপরাহত, তবু অতিমানবিক হতে গিয়ে যেন কারও প্রতি একটুও অমানবিক না হই। সবার কথা ভেবেই পরিশুদ্ধ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটুক।

অবিলম্বে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের মোবাইল ও টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানিগুলোর উচিত লেখাপড়ার স্বার্থে অন্তত দেশের ছাত্র ও শিক্ষকদের জন্য মোবাইল ও ইন্টারনেট ডাটায় বিশেষ ছাড় দেওয়া। নয় তো পিছিয়ে পড়বে শিক্ষাব্যবস্থা। আসুন সবাই মিলে সচেতন হই, মনে রাখবেন, রাষ্ট্রের কাছে আপনি একটি সংখ্যা মাত্র, কিন্তু পরিবারের কাছে আপনি পুরো পৃথিবী। বর্তমানে ক্রমবর্ধমান হারে আমাদের দেশে কভিডে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হওয়া হাসপাতালে আইসিইউ বেড ও উচ্চগতির অক্সিজেন সংকট বড়ই চিন্তার বিষয়। এ ভয়ঙ্কর বাস্তবতার মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আগেই যদ্দুর সম্ভব ঘরে থাকা, মাস্ক পরিধান, জনসমাগম এড়িয়ে চলা, সাবানপানি দিয়ে বারবার হাত ধোয়ার মতো প্র্যাকটিসগুলো চালিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : শিশু ও নারী অধিকার কর্মী।

[email protected]

সর্বশেষ খবর