বৃহস্পতিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

প্রয়াণে সাংবাদিক ও তাত্ত্বিক রাজনীতিক ফেরদৌস আহমদ কোরেশী

সৈকত রুশদী

প্রয়াণে সাংবাদিক ও তাত্ত্বিক রাজনীতিক ফেরদৌস আহমদ কোরেশী

চলে গেলেন একসময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা, তাত্ত্বিক রাজনীতিক, সাংবাদিক ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী। পরিণত, ৭৯ বছর বয়সে। তিনি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে বাকরুদ্ধ ও শয্যাগত ছিলেন জীবনের শেষ পাঁচ বছর। ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, ডাকসুর সাবেক ভিপি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা যুগ্মমহাসচিব হিসেবে নন্দিত। আবার ২০০৭-০৮ সালের সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন সরকারের সময়ে সেই সরকার সমর্থনে ‘প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল’ নামে একটি দল গঠন করে নিন্দিত হন। ১৯৬০-এর দশকেই রাজনীতির পাশাপাশি পেশা হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা।

স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি ভারতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন এবং দৈনিক ‘দেশবাংলা’ পত্রিকার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধিতে অবদান রাখেন।

তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় সাংবাদিকতাসূত্রে। ব্রিটেনে। ১৯৮৩ সালে। লন্ডনের বুশ হাউসে বিবিসির বাংলা বিভাগে। সেখানে আমি দুই দফায় প্রায় দুই বছর (১৯৮৩-৮৫ ও ’৮৬) খ-কালীন ব্রডকাস্টার হিসেবে কাজ করতে গিয়ে বিবিসির নিয়মিত প্রযোজক, সাংবাদিক ও স্থায়ী কর্মী ছাড়াও অতিথি কর্মী হিসেবে কাজ করতে আসা অনেক স্বনামধন্য সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত হই।

সে সময় বিবিসির স্থায়ী বাঙালি প্রযোজক ছিলেন সিরাজুর রহমান, শ্যামল লোধ, নিমাই চট্টোপাধ্যায় ও দীপঙ্কর ঘোষ। আর পূর্ণ সময়ের জন্য চুক্তিভিত্তিক প্রযোজক ছিলেন ড. গোলাম মুরশিদ, গোলাম কাদের, ঊর্মি রহমান ও দীপায়ন চট্টোপাধ্যায়।

তারা ছাড়াও যাদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি এবং সহকর্মী হিসেবে কাজ করেছি তার মধ্যে এ মুহূর্তে মনে পড়ছে নাজির আহমেদ, কাজী নূরুস সোবহান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, শফিক রেহমান, তালেয়া রেহমান, ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, আফতাব আহমাদ, নরেশ চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, আশিস রায়, শামীম চৌধুরী, মানসী বড়–য়া, চন্দন মিত্র, ফজলে রাব্বী মাহমুদ হাসান ও ড. শামীম আহমেদের কথা। সে সময় ফেরদৌস আহমদ কোরেশী মূলত লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পিএইচডি সন্দর্ভ নিয়ে গবেষণারত ছিলেন।

সাবেক সাংবাদিক ও পরে শিক্ষক আফতাব আহমাদ এবং ভারতীয় শিক্ষক, সাংবাদিক, বিজেপি সংসদ সদস্য ও বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেস তাত্ত্বিক চন্দন মিত্রও তখন ব্রিটেনে পিএইচডি গবেষণারত। তারা বিবিসিতে অতিথি কর্মী হিসেবে কাজ করতেন মাঝেমধ্যে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ও স্নেহভাজন হয়েছিলাম শামীম চৌধুরী ও ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর।

সপ্তাহে দু-তিন দিন বিবিসিতে কাজ করতে আসতেন ফেরদৌস কোরেশী। ঘণ্টা তিনেকের জন্য একসঙ্গে কাজ, বিবিসির স্টুডিও থেকে লাইভ সম্প্র্রচার ও পরে বুশ হাউসের ভূগর্ভস্থ ক্যাফেতে মধ্যাহ্নভোজন বা চা-কফির আড্ডা।

তখনই ফেরদৌস কোরেশীর অসাধারণ মেধা, অগ্রগামী ও স্বতন্ত্র চিন্তাধারা এবং উদ্ভাবনী কর্মতৎপরতার সঙ্গে পরিচিত হই। আগে থেকে তৈরি ইংরেজি প্রতিবেদন একটানে ঝরঝরে বাংলায় দ্রুত অনুবাদ এবং নোয়াখালী-চট্টগ্রামের মানুষ হয়েও বিশুদ্ধ উচ্চারণে তাঁর উপস্থাপন আমাকে বিস্মিত করেছিল।

১৯৬০-এর দশকে তিনি মেধাবী ছাত্রনেতা হিসেবে দেশজুড়ে সুপরিচিত ছিলেন। ১৯৬৭-৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছয় দফা আন্দোলন, ১১ দফা ভিত্তিক ছাত্র ও গণআন্দোলন এবং ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

ব্রিটেনে একদিন একান্ত আড্ডায় আমি প্রশ্ন করেছিলাম ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েও তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেননি কেন- শেখ ফজলুল হক মণি ও অন্য নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সংঘাত, নাকি আদর্শের কারণে?

তিনি সংক্ষিপ্ত উত্তরে জানিয়েছিলেন, ‘আদর্শের কারণে’।

ফেরদৌস কোরেশী ১৯৮৪-৮৫ সালে বাংলা ভাষার প্রথম ইলেকট্রনিক টাইপরাইটার উদ্ভাবন করেন। ’৮৬ সালে বাংলা একাডেমিতে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’য় একটি স্টল দিয়ে তিনি এ টাইপরাইটার বাজারজাত শুরু করেন। এ টাইপরাইটারের ফন্ট তৈরিতে তিনি ’৮৪ সালে মাহবুবুর রশীদ নামে সম্প্রতি প্রয়াত ব্রিটেনপ্রবাসী এক চারুশিল্পীর সহযোগিতা নিয়েছিলেন। সেই যোগাযোগটি ঘটিয়েছিলাম আমি। বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘নকশা’র স্বত্বাধিকারী মাহবুবুর রশীদ সম্পর্কে আমার এক ফুফুর স্বামী।

পার্সোনাল কম্পিউটার ও ল্যাপটপ প্রবর্তনের ফলে মেমোরিসমৃদ্ধ তার এ ইলেকট্রনিক টাইপরাইটার কার্যকারিতা ও বাজার হারায়।

ফেরদৌস কোরেশীর আদি বাড়ি নোয়াখালী হলেও জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। শিক্ষার্থী হিসেবে বিদ্যালয় পর্যায়ে অসাধারণ মেধার পরিচয় দিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৬০ দশকে। অনেক পরে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন তিনি ২০০০ দশকে।

তার আগে পিএইচডি অভিসন্দর্ভ উপস্থাপনের জন্য ব্রিটেন যাওয়ার লক্ষ্যে ভিসা পাওয়ার ব্যাপারে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তিনি। সম্ভবত ২০০১ সালে। তখন আমি বাংলাদেশে ব্রিটিশ হাইকমিশনে জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। ২০০৩ সালে আমি কানাডায় অভিবাসী হওয়ার পরে তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি।

টরন্টো

৩১ আগস্ট, ২০২০।

 

সর্বশেষ খবর