বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

গ্রামই হোক কর্মস্থল

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার

গ্রামই হোক কর্মস্থল

বাংলাদেশে করোনার তান্ডব দেখা দেওয়ার পরই এর মোকাবিলায় সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে। দফায় দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত কলকারখানা বন্ধ করে দেওয়া, পরে আবার কিছু কিছু অফিস-আদালত সীমিত আকারে খুলে দেওয়া, যানবাহন চলাচলের অনুমতি, বিভিন্ন গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক তথ্য প্রচার ও প্রকাশ, মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস ইত্যাদি পরা বাধ্যতামূলকসহ নানা গণমুখী উদ্যোগ চলছে এবং অব্যাহত আছে। সাধারণ ও নিম্ন আয়ের মানুষ কাজকর্ম হারিয়ে নিজ নিজ গ্রামে ফিরে গেছে। এখনো অনেকেই গ্রামে আছে এবং করোনার পরিস্থিতি একটু উন্নত হলেই আবার শহরে চলে আসার অপেক্ষায় আছে। এ অবস্থায় গ্রামে ফিরে যাওয়া লোকগুলো যদি গ্রামেই কাজকর্ম করতে পারে কিংবা সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গ্রামেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে একদিকে যেমন গ্রামের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে, অন্যদিকে শহরে আসার প্রবণতা কমবে এবং সর্বোপরি করোনা মোকাবিলা অনেক সহজ হবে। তাহলে প্রশ্ন আসে- কীভাবে গ্রামে এ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়? গত কয়েক বছরে শিক্ষিতের হার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শহরে বসবাসকারী ছোটখাটো ব্যবসায়ী, পোশাক কারখানায় কর্মরত যুবক-যুবতী সবাই এখন ভালো শিক্ষিত। এ ছাড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত কর্মী ও তাদের স্ত্রী-স্বামী আরও উচ্চশিক্ষিত। অথচ কর্ম হারিয়ে এখন তারা গ্রামেই আছেন। মানবসম্পদ উন্নয়নে এবং শিক্ষিতের হার আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে প্রি-প্রাইমারি স্কুলের সূচনা করেছে। অর্থাৎ ঘরের তিন-চার বছরের ছোট্ট সোনামণি প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার আগে দুই বছর প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার। এখনো সারা বাংলাদেশে এটি কার্যকর হয়নি তবে প্রক্রিয়াটি চলমান। এসব প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য বিপুলসংখ্যক শিক্ষক প্রয়োজন হবে। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে গ্রামে ফিরে যাওয়া শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে আইওটি (IoT-Internet of Things)। অর্থাৎ আগামীতে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করা হবে ইন্টারনেট ও স্মার্ট ডিভাইস দিয়ে। গ্রামে-গঞ্জে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা, কাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদির দিকে এখনই নজর দেওয়ার উপযুক্ত সময়। কর্মসংস্থানের জন্য এটি একটি বিশাল সম্ভাবনা। গ্রামে অবস্থানরত শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা এ ব্যবসার সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে নিজ উদ্যোগে কিংবা সরকার থেকে লোন নিয়ে। সরকারকে এ ব্যাপারে সহজ শর্তে ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ঘরে বসেই এসব শিক্ষিত লোকজন আইওটির মাধ্যমে মাছ চাষ, বাগান পরিচর্যা, শস্য পরিচর্যা ইত্যাদি পরিচালনা করতে পারবে। এমনকি আউটসোর্সিং করে বিদেশ থেকে কাজের অর্ডার এনে আয় করতে পারবে বিপুলসংখ্যক বৈদেশিক মুদ্রা। সমৃদ্ধ করতে পারবে গ্রামীণ অর্থনীতি। এসব কাজের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে উপযুক্ত কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে তারা আর কখনো শহরমুখী হবে না; গ্রামেই ব্যবসা-বাণিজ্য ও বাসস্থানের ভিত স্থাপন করবে। এ করোনায় সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও সব ব্যবসা-বাণিজ্য, কাজকর্মে ধস নেমেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের অর্থনীতি। কিন্তু এত কিছুর পরও বাংলাদেশের মানুষ না খেয়ে থাকেনি। ভাত, মাছ, সবজি, তরি-তরকারি অর্থাৎ সব কৃষিপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল এবং আছে। তাহলে প্রশ্ন আসে- এ অবদান কার? কৃতজ্ঞচিত্তে বলতেই হবে, এ অবদান বাংলাদেশের মেহনতি ও অবহেলিত কৃষকসমাজের। এরাই হচ্ছে গ্রামের খুঁটি বা ভিত। এ দুর্দিনে এরাই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে খাইয়ে-পরিয়ে। সচল রেখেছে গ্রামীণ অর্থনীতি। অথচ এরা বোঝে না অর্থনীতি, সমাজনীতি কিংবা রাজনীতি। এরা বোঝে শুধু কাজ আর কাজ। এরা গ্রামে ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। শহরমুখী হওয়ার ইচ্ছা তাদের তেমন একটা নেই। এ নীরব ও অবহেলিত কৃষককে আর অবহেলা নয়, এখনই নজর দিতে হবে তাদের কল্যাণের দিকে। কীভাবে? প্রকৃত কৃষকের তালিকা করে প্রণোদনা কিংবা মাসিক হারে ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ঘরে অবস্থানরত বৃদ্ধ মা-চাচি, দাদা-দাদি সবাই বাড়ির আঙিনার আশপাশে শাকসবজি, ফলমূল চাষ করতে পারেন এবং এখানেও সরকার তাদের প্রণোদনা দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে।

গ্রামে ফিরে আসা স্বল্পশিক্ষিত যুবকদের কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। উন্নত বীজ ও আধুনিক পদ্ধতিতে জমি চাষ ও ফসল ফলানোর গুরুদায়িত্ব তাদের দেওয়া যেতে পারে। গ্রামে অবস্থানরত বয়োবৃদ্ধ কৃষকের সঙ্গে পরামর্শ করে তারা এ কাজে সম্পৃক্ত হবে। জমিতে সময়মতো সার প্রয়োগ, সেচ দেওয়া, আবহাওয়া সম্পর্কে অবহিত করা ইত্যাদি কল্যাণমুখী কাজে কৃষককে পরামর্শ দিতে পারে। এরা ফসল বেচাকেনায় ও বাজারজাতকরণে ভূমিকা রাখবে যাতে মেহনতি কৃষক তার ফসলের প্রকৃত মূল্য পায়। গ্রামের যোগাযোগব্যবস্থা এখন খুবই উন্নত। কৃষকের কাছ থেকে প্রকৃত মূল্যে ফসল কিনে সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ এবং সরবরাহের কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারে। বর্তমানে মাছ চাষ ও হাঁস-মুরগি পালন খুবই লাভজনক ব্যবসা। সামান্য পুঁজি নিয়ে শুরু করা যায় এ কাজ। একটু পরিশ্রমী হলে এ কাজে নিজে তো বটেই, আশপাশের অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়। এ ক্ষেত্রেও সরকার প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতা করতে পারে। বর্ণিত খাতগুলো অর্থাৎ প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি, ইন্টারনেট ব্যবসা, কৃষি কাজে সহায়তা, মাছ চাষ ও হাঁস-মুরগি পালনে উদ্বুদ্ধ হওয়া ইত্যাদি কাজে গ্রামে ফিরে যাওয়া লোকদের সম্পৃক্ত করার জন্য যথাযথ পরিকল্পনা এখনই নেওয়া উচিত। আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করলে গ্রামে ফিরে আসা সবার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। এভাবে চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে গ্রামে ফিরে যাওয়া লোকগুলো যদি তাদের আত্মসম্মানবোধ রক্ষা করে চলতে পারে; তাহলে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামেই থাকবে এবং তারাই একদিন একেকটি গ্রামকে একটি শহরে পরিণত করবে।

লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, অধ্যাপক ও পরিচালক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর