করোনাকালে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব মানুষ যখন মানসিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত, এ দুঃসময়ে বাংলাদেশে ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলো সংবাদমাধ্যমে বড় শিরোনামে প্রচার পেয়েছে। সিলেট সরকারি এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে গণধর্ষণ ও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে স্বামীর সামনে স্ত্রীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় গোটা বাংলাদেশ গর্জে উঠেছে। ছাত্রছাত্রী ও তরুণ সমাজ এসব অমানুষিক এবং জঘন্য পশুবৃত্তির বিরুদ্ধে অবিরাম ক্ষোভ প্রকাশ করছে। তারা অপরাধীর শাস্তি দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশ-মশালমিছিল, মানববন্ধন, সড়ক অবরোধ, গণস্বাক্ষর, স্মারকলিপি প্রদান, লংমার্চসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। এসব প্রতিবাদ কর্মসূচির সময় বিভিন্ন স্থানে পুলিশ বাধা দেয়, লাঠিচার্জের মাধ্যমে সমাবেশ ও লংমার্চ ছত্রভঙ্গ করে দেয়। প্রতিবাদী অনেকে পুলিশের আক্রমণে মারাত্মক আহত হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন সারা দেশে ধর্ষণ ও নারী-শিশু নির্যাতনের প্রতিবাদে রাজপথে সোচ্চার হয়। দেশের বিশিষ্টজন ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে জনবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী। পুলিশ ৬ হাজার ৯১২টি এলাকায় একযোগে ধর্ষণ ও নির্যাতনবিরোধী ব্যতিক্রমধর্মী সমাবেশ অনুষ্ঠান করে।
সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রবাসে সংঘটিত পৈশাচিক ঘটনা সম্পর্কে পত্রিকার খবরে জানা যায়, ২৫ সেপ্টেম্বর এমসি কলেজের প্রধান ফটকের সামনে নিজেদের গাড়িতে বসে গল্প করছিলেন স্বামী-স্ত্রী। এ সময় পাঁচজন ছাত্র তাদের গাড়িটি ঘিরে ধরে এবং তিনজনে তরুণীকে টেনে গাড়ি থেকে বের করে আনে। দুজন স্বামীকে গাড়িতে আটকে রাখে। তরুণীকে ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের একটি কক্ষে নিয়ে গণধর্ষণ করে। রাত ১০টায় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে স্বামী-স্ত্রীকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়। এ জঘন্য ও অমানবিক ঘটনায় জড়িত ছয় ছাত্রলীগ ক্যাডার (নেতা)সহ নয়জনকে অভিযুক্ত করা হয়। পুলিশ এদিনই মধ্যরাতে ছাত্রাবাসে অভিযান চালিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রসহ বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করে। এ ঘটনার পর কলেজের অধ্যক্ষ বলেছেন, ‘শুনেছি নেতারা (ছাত্রলীগ) সেখানে ছিল। এর বাইরে আর কিছু জানি না।’
করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি নির্দেশে কলেজ ও ছাত্রাবাস বন্ধ ছিল। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ছাত্রাবাসে কীভাবে অবস্থান করছিল সে ব্যাপারে অধ্যক্ষসহ কলেজ কর্তৃপক্ষ সদুত্তর দিতে পারেননি। সিলেট এমসি কলেজের ঘটনার পর প্রতিদিন পত্রিকায় অজস্র ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের খবর প্রকাশ হতে থাকে। এমনি এক পর্যায়ে ৪ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার এখলাসপুরে (২ সেপ্টেম্বর সংঘটিত) এক নারীকে (৩২) বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও প্রকাশিত হয়। ঘটনার ৩২ দিন পর ৪ অক্টোবর নির্যাতনের ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়লে সমগ্র দেশের মানুষ তীব্র ক্ষোভ ও বেদনায় ফুঁসে ওঠে। পত্রিকার সংবাদে জানা যায়, একই গ্রামের দেলোয়ার হোসেন সঙ্গীদের নিয়ে এ জঘন্য কান্ড ঘটিয়েছে। দেলোয়ার একজন অটোরিকশা চালক ছিল। সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে সে সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান হয়ে এখলাসপুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি হয়েও সে বীরদর্পে এলাকায় বিচরণ করত। প্রায় এক বছর আগে এই নারীকেই সে দুবার ধর্ষণ করেছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে শিমরাইল চেকপোস্টে র্যাব ধর্ষক দেলোয়ারকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে। চলমান ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলনে বেগমগঞ্জের ঘটনাসহ অন্যসব লোমহর্ষক ঘটনার প্রতিবাদে সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে।
ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৩ অক্টোবর ধর্ষণের অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড সংযোজন করে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ’ আইনের সংশোধনী জারি করে সরকার। কিন্তু লজ্জাজনক হলেও সত্যি, ধর্ষণের কঠিন শাস্তি ঘোষণার পরও নারী এবং শিশু ধর্ষণের ঘটনা হ্রাস পায়নি। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনে পত্রিকায় বড় শিরোনাম অব্যাহত থাকে। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে দেখা যায়, ধর্ষণের অপরাধে মৃত্যুদন্ডের শাস্তি জারির আগে এবং পরে দেশে ধর্ষণ ও নারী-শিশু নির্যাতনের মাত্রা কমেনি। দেশে গণতন্ত্রহীনতা ও বিচারহীনতার ফলে সমাজে নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয় মূল্যবোধের চরম অবনতি হয়েছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। করোনাকালে এ ধরনের সামাজিক অবক্ষয় দেশ ও জাতির জন্য চরম উদ্বেগের। এসব অনৈতিক, পাশবিক ও বিকৃত মানসিকতার প্রতিবাদে রাজধানীসহ সারা দেশে মানুষ বিক্ষুব্ধ ও ফুঁসে উঠেছে। মূলত আন্দোলনকে সাময়িকভাবে প্রশমিত করার লক্ষ্যে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড ঘোষণা দিয়ে আইন সংশোধনের অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মৃত্যুদন্ডসহ নতুন সংযোজন নিয়ে বিভিন্ন মহলে শঙ্কা ও বাস্তবায়নের বিষয়ে হতাশা নিরসন হয়নি। ২০০৩ সাল পর্যন্ত সংশোধিত আইনে একক ব্যক্তির ধর্ষণের পর নারী বা মেয়েশিশুর মৃত্যু ঘটলে এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ফলে কেউ নিহত বা আহত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড বিদ্যমান ছিল। এক হিসাবে দেখা যায়, আইনের বর্তমান সংশোধনীর আগে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে ৩৬৫ জন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। তথ্যমতে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে প্রায় পৌনে ১ লাখ মামলা বিচারাধীন। অতএব আইনে মৃত্যুদন্ড আগেও ছিল। কিন্তু সব ক্ষেত্রে সামাজিক অবক্ষয় ও বিচারহীনতার কারণে ধর্ষণকারী অপ্রতিরোধ্য ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আইন সংশোধনের পরও নারী ও শিশু ধর্ষণের প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। যা মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। ধর্ষণের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলে তা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়। ২০০৩ সালে সংশোধিত ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইনের ৯ ধারার ১ উপধারায় শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছিল- ‘যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হইবেন’। সংশোধনীতে ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডে’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হয়েছে। অতএব আইনে মৃত্যুদন্ড আগেও ছিল। সংশোধনের মাধ্যমে ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করা হয়েছে মাত্র। সচেতন মহলের ধারণা, মৃত্যুদন্ডের আইন সংশোধন করাই যথেষ্ট নয়, নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ধর্ষণ, নারীর শ্লীলতাহানি, নারী ও শিশু নির্যাতন, নারীদেহের প্রতি লালসা, নারীর সঙ্গে বৈষম্য ও নারীকে ভোগের বস্তু মনে করছে একশ্রেণির মানুষ। এমন পৈশাচিক ব্যাধি থেকে কোনো দেশ বা সমাজ মুক্ত নয়। তাই তো ইতালির প্রধানমন্ত্রী, ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট, আইএমএফের প্রেসিডেন্ট অনৈতিক যৌন সম্পর্কের কারণে কারাভোগ করেন। একই কারণে যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের মুখোমুখি হতে হয়। যুক্তরাজ্যে এক মন্ত্রী ও ক্রিস্টেন কিলার কেলেঙ্কারিতে পদত্যাগ করতে হয়েছে সরকারকে। বাংলাদেশও ওই ধরনের অনৈতিক ও অমানবিক মানবসৃষ্ট ব্যাধিতে আক্রান্ত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, করোনাকালে মানুষ যখন চরম বিপর্যয়ে তখন বাংলাদেশে গণধর্ষণ ও শিশু ধর্ষণ ঘটছে। পত্রপত্রিকায় এসব খবর ফলাওভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এতে জাতি এক চরম লজ্জাজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির পারদ অনেক নিচে নেমে গেছে। বাংলাদেশে নারীদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা নিয়ে জাতিসংঘ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এসব ঘটনাকে গুরুতর অপরাধ ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন বলেও বর্ণনা করেছে সংস্থাটি। জাতিসংঘের ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, ‘নোয়াখালীতে ঘটে যাওয়া নারী সহিংসতার ঘটনাটি সামাজিক আচরণ এবং কাঠামোগত বিদ্যমান নারীবিদ্বেষ ফুটিয়ে তুলেছে’। দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’-এর হিসাবে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর করোনাকালের নয় মাসে দেশে ধর্ষণের ঘটনা ৯৭৫টি, আর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ২০৮টি। ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ৪৩টি এবং ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে ১২ জন। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে এ তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে অনেকেরই ধারণা, নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং নির্যাতন আরও বেশি।
এমন এক সময় ছিল যে, সামাজিক এসব অনাচারকে শুধু নারী ও শিশু নির্যাতন বলতে বা লিখতে মানুষ স্বচ্ছন্দবোধ করত। ধর্ষণ বা বলাৎকার শব্দটি সহজে কেউ উচ্চারণ করতে চাইত না। কিন্তু বর্তমানে এ ধরনের অনৈতিক কর্মকান্ড এতটাই জঘন্য ও অমানবিক পর্যায়ে পৌঁছেছে, এখন ধর্ষণ ও বলাৎকার সম্পর্কে বলতে বা লিখতে কেউ কোনো রাখঢাক করে না। ধর্ষণ বা বলাৎকার শব্দটির মধ্যেই বল বা শক্তি প্রয়োগের সম্পর্ক রয়েছে। এ বল বা শক্তি অর্জনের মূল উৎস হচ্ছে ক্ষমতা। একজন মানুষ (বিশেষ করে পুরুষ) সে ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক আধিপত্যের কারণে। ১৯৭৫ সালে নারীবাদী লেখক সুসান ব্রাউন মিলারের মতে, ‘ধর্ষণের কারণ যৌন কামনা নয়, সব পুরুষেরই কামনা আছে, কিন্তু সব পুরুষ ধর্ষণ করে না। একেকজন ধর্ষণকারী একেক কারণে এ ঘৃণ্য অপরাধ করে।’
ধর্ষণের কারণসমূহ নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হলো-
১. পারিবারিক : অপরাধী বা দুর্ধর্ষ হয়ে একজন শিশু জন্মগ্রহণ করে না। তার প্রাথমিক নৈতিক ও সামাজিক জীবন শুরু হয় পরিবারে। তাই একজন শিশুর মানসিক বিকাশে পরিবারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাড়ির ছোট্ট ছেলেটাকে ছোটবেলা থেকেই নারীকে সম্মান করতে শেখাতে হবে। পরিবারের শিশু ছেলে ও মেয়ের মধ্যে বৈষম্য, অসম্মান ও সহিংস আচরণ করা যাবে না। শিশুকে পরিবার থেকেই কোনটি ভালো, কোনটি মন্দ, কোনটি নৈতিক, অনৈতিক, সত্য ও মিথ্যা সে শিক্ষা অর্জন করতে হয়। তাই শিশুর মানসিক বিকাশে পরিবারের সদস্যদের অধিক যত্নবান ও আন্তরিক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
২. ধর্মীয় শিক্ষা : বিশ্বের সব ধর্মে একজন মানুষকে ন্যায়, সত্য ও সুন্দরকে গ্রহণ করতে হয়। তাই মন্দ, অশ্লীল, অসত্য, ব্যভিচার ও কুৎসিত পথ পরিহার করতে ধর্মে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে সুরা আনয়ামের ১৫১ নম্বর আয়াতের এক অংশে আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন, ‘অশ্লীলতার কাছেও যাবে না; তা প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে।’ পবিত্র কোরআন হচ্ছে একজন মুসলমানের পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। ছোটবেলা থেকেই পিতা-মাতা ও অভিভাবকরা যদি শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা ও রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখান, পথ প্রদর্শন করেন তাহলে পরিণত বয়সে সে শিশু ছেলেটি কখনো অনৈতিক, অশ্লীল ও পঙ্কিল পথে হাঁটতে পারে না। তাই ধর্ষণসহ সমাজের সকল প্রকার অনাচার থেকে বাঁচাতে ধর্মীয় শিক্ষা ও রীতিনীতি বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে।
৩. রাজনৈতিক ক্ষমতা : বলপ্রয়োগ, শক্তি প্রদর্শন, আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সহিংসতাসহ বেপরোয়া অপরাধের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের সদস্য বা ছত্রচ্ছায়ায় থাকা ব্যক্তিরা আইনের বাইরে থাকছে। তাই তারা সমাজে জঘন্য অপরাধ করতে সাহস পাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে দীর্ঘ ১২ বছর গণতন্ত্রহীনতা ও বিচারহীনতার কারণে ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত বা ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়ে ব্যক্তিরা নানামুখী অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ধর্ষণ, নারী-শিশু নির্যাতন, গুম ও খুনের মতো জঘন্য অপরাধ সংঘটনে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাই করোনাভাইরাসের মহাদুর্যোগেও দেশে এসব বর্বরোচিত ও ঘৃণ্য অপরাধের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মন্তব্য করেন, ‘রাজনৈতিক প্রভাবে অপরাধীরা মনে করে তাদের কিচ্ছু হবে না।’
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেছেন, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া ছাড়া এ ধরনের ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘বর্তমান ঘটনাবলি হচ্ছে- ভঙ্গুর রাষ্ট্রব্যবস্থা নামক রোগের সিম্পটম। যেখানে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার জেঁকে বসেছে।’ আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও গবেষক রুচিতা তাবাসসুমের মতে, ‘ক্ষমতার আশ্রয়ে ধর্ষকরা বেশি বেপরোয়া।’ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ এবং মানবিক রাষ্ট্রের দাবিতে এক মানববন্ধনে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) নেতৃবৃন্দ বলেছেন, ‘সরকার ধর্ষকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে।’ করোনাকালে সিলেট এমসি কলেজের ঘটনার পর শুধু অক্টোবরে যেসব নারী ও শিশু ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হয়েছে তার প্রায় সবই ঘটিয়েছে ক্ষমতাসীন (আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠন) দলের নেতা-কর্মীরা। এসব অমানবিক ও জঘন্য ঘটনায় যারা গ্রেফতার হয়েছে তারাও প্রায় সবাই ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাষ্ট্রের ক্ষমতা যাদের হাতে আমানত হিসেবে ন্যস্ত, অনেকের মধ্যে তা খেয়ানত করার প্রবণতা লক্ষণীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ঘটনায় রাষ্ট্র ও সমাজের সকল পর্যায়ে বিপজ্জনক পচন দৃশ্যমান প্রতিফলন ঘটেছে।
৪. সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় : সমাজে অর্থ, পেশিশক্তি, রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব এবং নৈতিক শিক্ষার অভাবে সব ক্ষেত্রে সামাজিক অবক্ষয় ঘটছে। বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, ছোটদের প্রতি ¯েœহ-ভালোবাসা, ভালো-মন্দের পার্থক্য ও সামাজিক বিচার বর্তমান সমাজ থেকে বিদায় নিয়েছে। অতীতে পাড়া-মহল্লা ও গ্রামে দুর্বলের প্রতি সবলের নির্যাতন, মেয়েদের প্রতি ছেলেদের অসদাচরণ ও নারীর ওপর পুরুষের অত্যাচারসহ নানা অপকর্মকে ঘৃণা করা হতো। এসব অপরাধ সামাজিক বিচারের আওতায় শাস্তির ফয়সালা করত। বর্তমান সমাজে সে চিত্র অনুপস্থিত। ফলে ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ বেড়েই চলছে। রাষ্ট্র কঠোর আইন প্রণয়নের পরও অপরাধপ্রবণতা নির্মূল হওয়া দূরের কথা, তা হ্রাসও পাচ্ছে না।
৫. ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ : বর্ণিত পর্যালোচনা থেকে এ কথা পরিষ্কার যে গণতন্ত্রহীনতা, বিচারহীনতা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে সমাজে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ অপ্রতিরোধ্যভাবে বেড়ে চলছে। ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনসহ অপরাধসমূহ রুখতে হলে এ মুহূর্তে দেশে সর্বাত্মক সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন প্রয়োজন। এ আন্দোলন ঘরে বাইরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, হাট-বাজার, রাস্তায় এবং জীবনের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে। সমাজে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। ধর্মীয় আচার-আচরণ ও সংস্কৃতি পুনরুদ্ধার করতে হবে। নারী স্বাধীনতার নামে উগ্রবাদ পরিহার করতে হবে। সর্বোপরি পরিবারের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা, সম্মান, ভালো-মন্দ শিক্ষাদানের বিষয়ে অধিকতর মনোযোগী হতে হবে। একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে শতকরা ৭৭ ভাগ নারী নির্যাতন ঘটে পরিবারের মধ্যে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, নারীদের অবলা, অসহায় ও দুর্বল মনে করার প্রবণতা সমূলে উৎপাটন করতে পরিবারকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সমাজে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন ও বাকস্বাধীনতার সংগ্রামকে আরও জোরদার এবং সুসংহত করতে হবে। সামাজিক ও রাজনৈতিক সমন্বিত আন্দোলনই আমাদের এ ঘোর অন্ধকার থেকে টেনে এনে আলোর মুখ দেখাতে পারে। নারী যখন মা, তখন সে জান্নাত; নারী যখন কন্যা, তখন সে রহমত; নারী যখন বোন, তখন সে নিয়ামত এবং নারী যখন স্ত্রী, তখন সে আমানত। এ বিশ্বাস ও শিক্ষা যেদিন সমাজের সর্বস্তরে সুদৃঢ় হবে সেদিন সমাজ এ ধরনের জঘন্য অপরাধ ও অনাচার থেকে মুক্তি পাবে।
লেখক : সদস্য, বিএনপি স্থায়ী কমিটি।