রবিবার, ৩ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

কাছ থেকে দেখা জননেতা মোহাম্মদ নাসিম

মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু

কাছ থেকে দেখা জননেতা মোহাম্মদ নাসিম

বেশ কয়েক দিন থেকে তাগিদ অনুভব করছিলাম প্রয়াত নাসিম ভাইয়ের রাজনীতি, উত্থান, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, মূল্যবোধ ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিছু না জানা তথ্য দেশবাসীর কাছে তুলে ধরার। গত ২২ নভেম্বর স্বাধীনতা চত্বরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পাবনা গিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল স্মরণে পৌর মিলনায়তন অর্থাৎ টাউন হলের পুনঃসংস্কার করে স্বাধীনতা চত্বর হিসেবে নামকরণ করে শুভ উদ্বোধন করেন। বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তা স্বনামধন্য স্কয়ার গ্রুপের অন্যতম পুরোধা বীর মুক্তিযোদ্ধা অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু এ সংস্কারকাজের পৃষ্ঠপোষক, অর্থায়ন ও বাস্তবায়নের অগ্রনায়ক। পাবনা পৌরসভার এ সম্পত্তিটি পুনঃসংস্কার ও নামকরণ বিষয়ে সব কমিশনার ও মেয়র মিন্টুর সার্বিক সহযোগিতা ও সম্মতি আছে মর্মে জানতে পারলাম।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে বকুলের স্মৃতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা বকুল প্রথমে আওয়ামী লীগ ও পরে বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কোন পরিপ্রেক্ষিতে বা কেন বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন, তা উল্লেখ করে তাঁর দীর্ঘকাল আওয়ামী লীগে থাকার সময় কীভাবে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা এবং স্বয়ং জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সহযোগিতা করেছেন, তার একটি বিবরণ তুলে ধরেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সর্বশেষ বিএনপির একজন নেতা হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর অকপটে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিদানের বিষয়টি পাবনার আপামর জনগণকে মুগ্ধ করেছে।

মোহাম্মদ নাসিমের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বর্ণিত কথাগুলো উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে নাসিম ভাইয়ের পাবনার রাজনীতির বিষয়টিও উল্লেখ করেছিলেন। মোহাম্মদ নাসিমের জন্ম সিরাজগঞ্জ শহরে নানাবাড়িতে ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে। নানার কর্মস্থল শহরে হওয়ার সুবাদে বেগম আমেনা মনসুর বাবার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। বাবা দেশবরেণ্য নেতা এম মনসুর আলীর বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার কুড়িপাড়া গ্রামে। এম মনসুর আলী পেশাগত কারণে ছেলে সেলিম ও নাসিমকে নিয়ে সপরিবার পাবনা সদরে চলে আসেন এবং মোক্তারপাড়ায় বশির কটেজ নামক এক ভাড়া বাসায় ওঠেন। তার আগে থেকে তিনি পাবনা অ্যাডভোকেট বার সমিতিতে তালিকাভুক্ত হয়ে আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিস করতেন। মনসুর আলী আট-দশ বার পাবনা বারের কখনো সাধারণ সম্পাদক আবার কখনো সভাপতি পদে জয়ী হয়েছিলেন। স্বনামধন্য আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত হয়ে তিনি স্নাতকোত্তর ও আইনে ডিগ্রিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত এই সঙ্গী ’৭৫-এর ৩ নভেম্বর ঘাতক মোশতাকের প্রেরিত খুনিদের দ্বারা কারাগারের ভিতরে নিহত হন।  

নাসিম ভাই পাশের মহিমচন্দ্র জুবিলী হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন ’৬৫ সালে। আমি একই মহল্লায় বাস করলেও স্কুল ছিল ভিন্ন, এসএসসি পাস করি এক বছর পর অর্থাৎ ’৬৬ সালে। ক্রিকেট খেলোয়াড় হিসেবে আমাদের উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি ’৬৬ সালের শেষ ভাগে এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হই। মোহাম্মদ নাসিম তখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বলা বাহুল্য, আমি কলেজে ভর্তির সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগের কর্মী হলেও মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া গ্রুপ) সঙ্গে স্বল্পকালীন সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন পাবনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে বশির কটেজের বাসাতেই। ’৬৭ সালে আমি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে মোহাম্মদ নাসিম ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থী হয়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক পদে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। ওই বছর ছাত্র সংসদের সব পদে ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) গ্রুপ বিজয়ী হয়। ছাত্রলীগের একমাত্র প্রার্থী মোহাম্মদ নাসিম বিজয়ী হয়ে ছাত্র নেতৃত্বে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।

পাকিস্তানি শাসনামলে রেশনব্যবস্থায় জনগণকে ভুট্টা খাওয়ানো হতো। ’৬৭ সালে রেশনে প্রাপ্ত ভুট্টার বিষক্রিয়ায় পাবনায় দুজন ছিন্নমূল পরিবারের সদস্য মৃত্যুবরণ করেন। মুহূর্তেই সমগ্র পাবনার মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে পাবনায় সে সময় বসবাসরত পূর্ব পাকিস্তান পার্লামেন্টারি বোর্ডের খাদ্যবিষয়ক সদস্য ক্যাপ্টেন আজগর হোসেন জায়েদীর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। একসময় মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করলে একজন ভিক্ষুকের ছেলে ঘটনাস্থলে মারা যায়। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ আজগর হোসেন জায়েদীর বাড়ি ঘেরাও করলে মিছিলের একাংশে কতিপয় ব্যক্তি আগুন ধরিয়ে দেয়। সমগ্র পাবনা জেলা পুলিশ ও বিক্ষুব্ধ জনতার সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, তখন অস্ত্রের দোকান পর্যন্ত লুট করে অস্ত্র দ্বারা আত্মরক্ষা করা হয়েছিল। এটি ‘ভুট্টা আন্দোলন’ হিসেবে পরিচিত। সে রাতেই পাবনার নেতৃবৃন্দের ওপর গ্রেফতারি হুলিয়া জারি হলে আমরা কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে যাই। তবে মোহাম্মদ নাসিমসহ ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা এবং আওয়ামী লাগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টির সব নেতাই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেফতার হন। এম মনসুর আলী ও ছেলে মোহাম্মদ নাসিম পাবনা কারাগারে আবদ্ধ ছিলেন। পরে জেলা জজ কোর্টে মামলার শুনানি হলে সাক্ষ্যের অভাবে সবাই খালাস পান। উল্লেখ্য, পাবনায় ছাত্রলীগের সঙ্গে সব সময়ই প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সংঘর্ষ লেগে থাকত।

পাবনা আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা আহমেদ রফিক ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের কাছে খুবই প্রিয় মানুষ ছিলেন। তিনিসহ অন্য নেতৃবৃন্দকে হত্যা করার জন্য ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের (পরে নকশালবাড়ী সমর্থক) নেতৃত্বে একটি টিম সব সময় সক্রিয় ছিল। আহমেদ রফিক বারবার তাদের হামলার শিকার হন। এরূপ অবস্থা চলাকালে পাবনার তৎকালীন টাউন হল ময়দানে ছাত্রলীগের এক জনসভায় ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সদস্যরা হামলা চালালে আহমেদ রফিকসহ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা ছুরিকাঘাতে আহত হন। এ সংঘর্ষের ব্যাপকতা প্রচ- আকার ধারণ করলে ছাত্রলীগের সহযোগী শ্রমিক লীগের লুরে নামক একজন কর্মী ছুরিকাঘাত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এ সংঘর্ষের মধ্যে মোহাম্মদ নাসিম আমার ছোট ভাই ছাত্রলীগ কর্মী টুন্নুকে সঙ্গে নিয়ে রিকশাযোগে হাসপাতালে দেখতে গেলে ছাত্র ইউনিয়নের (নকশাল পার্টির অনুসারী) সন্ত্রাসীরা নাসিমকে ধাওয়া করে হাসপাতালের বারান্দায় জাপটে ধরে। তাঁকে মাটিতে ফেলে পিঠে ধারালো ছড়ার ছয়-সাতটি কোপ দিয়ে রক্তাক্ত জখম করে। মুমূর্ষু মোহাম্মদ নাসিমকে প্রথমে রাজশাহী ও পরে ঢাকায় চিকিৎসা করালে তিনি সুস্থ হন। মোহাম্মদ নাসিম পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে স্নাতক পাস করেন। আমিসহ মোহাম্মদ নাসিম, রফিকুল ইসলাম বকুল, বেবি ইসলাম, ফজলুল হক মন্টু, পাকন, লাল ও বিজয় আহমেদ রফিকের প্রিয়ভাজন ছিলাম। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আহমেদ রফিকের কিছুটা ¯œায়ুযুদ্ধ থাকলেও তিনি এম মনসুর আলীর সমর্থনপুষ্ট ছিলেন। আহমেদ রফিকের জনপ্রিয়তাও ছিল তুঙ্গে। ’৭০ সালের নির্বাচনে আহমেদ রফিক প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে তরুণ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার কিছুদিন পরই সেই নকশালপন্থি ছাত্র ইউনিয়নের সন্ত্রাসীরা তাঁকে বাসার সামনে ছুরিকাঘাত করলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমরা হারিয়েছিলাম একজন দেশপ্রেমিককে।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছিলাম পাবনা জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমরা পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পাবনাকে হানাদারমুক্ত রাখতে পেরেছিলাম ৯ এপ্রিল পর্যন্ত। পরে প্রতিরোধযুদ্ধে সামলাতে না পারলে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যাই। মোহাম্মদ নাসিমও ঢাকা থেকে তাঁর বাবা ও পরিবারের সদস্যসহ ভারতে গিয়ে কলকাতায় অবস্থান নেন। কলকাতার এন্টালি এলাকার সুন্দরীমোহন অ্যাভিনিউর আশুতোষ ঘোষের বাড়িতে মোহাম্মদ নাসিম তাঁর মা-বাবা-ভাই-বোনের সঙ্গে আশ্রয় নেন। উল্লেখ্য, আশুতোষ ঘোষের এ বাড়িতে মুজিবনগর সরকারের অন্য মন্ত্রীরাও থাকতেন। মোহাম্মদ নাসিমকে সীমান্তবর্তী কতিপয় যুব ক্যাম্প ও শরণার্থী শিবির পরিচালানার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিল। আমি সেখানেও তাঁর সর্বকালীন সাথী ছিলাম। তবে মাঝে আমি প্রশিক্ষণ নিয়ে সাথী বীর মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল ও বকুলদের সঙ্গে পাবনার আশপাশে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।

কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায় তৎকালীন পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিস ছিল। ওই হাইকমিশনে পাবনার কৃতী সন্তান হোসেন আলী কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে বাঙালি কর্মকর্তারাও ছিলেন। অবাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তখন হাইকমিশন অফিস ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। পুরো হাইকমিশনটি তখন মুজিবনগর সরকারের অধীন ছিল এবং ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে অবস্থিত মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী কার্যালয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করত। এ অফিস থেকে পাবনা-কুষ্টিয়া-রাজশাহী অংশের শরণার্থী ক্যাম্পসমূহ এবং কেচোয়াডাঙ্গা ও জলঙ্গী যুব ক্যাম্পগুলো পরিচালিত হতো। নাসিম ভাইয়ের দেশপ্রেম এত বেশি প্রখর ছিল যে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ও দায়িত্ব পালনে তিনি কখনো ক্লান্তিবোধ করতেন না। দেশ স্বাধীন হলে পুনরায় আমরা নিজ অবস্থানে ফিরে এলে মোহাম্মদ নাসিমও পাবনায় চলে আসেন এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়েন। পাবনায় মোহাম্মদ নাসিম কালক্রমে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। ’৭৪ সালে কৃত্রিম খাদ্য সংকটকালে পাবনায় পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য নির্বিঘ্নে সরবরাহ করার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর বাবা এম মনসুর আলী সাহেবের সহযোগিতায় অনন্য ভূমিকা পালন করেন।

তিনি যে কতটা কর্মিবান্ধব ও কর্মিদরদি নেতা ছিলেন তার একটি উদাহরণ তুলে ধরতে চাই। ’৭৪ সালের প্রথম দিকে আমি পাবনা জেলা যুবলীগ সভাপতি এবং মোহাম্মদ নাসিম যুবলীগের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। তখন জাসদ গণবাহিনী ও মুজিববাদী ছাত্রলীগের মাঝেমধ্যেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হতো। সে সময় আমি ও মোহাম্মদ নাসিম উভয়েই এলএলবি ফাইনাল পরীক্ষার্থী ছিলাম।

ফাইনাল পরীক্ষার প্রথম দিন পরীক্ষা কেন্দ্রে আগেই নাসিম ভাই আমাকে একসঙ্গে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন। আমি যথারীতি সকাল ৯টায় তাঁর রাঘবপুরের বাসায় হাজির হই। এ সময় তাঁকে গোসলরত অবস্থায় দেখি। আমি ডাকাডাকি করলে তিনি দরজা খুলে আমাকে পরীক্ষা না দিয়ে ঈশ্বরদী যাওয়ার প্রস্তাব করেন। জিজ্ঞেস করলাম কেন? তিনি বললেন, আজ সকালে খবর পেলাম ঈশ্বরদীতে আমাদের এক ছাত্রলীগ কর্মীকে গণবাহিনীর সদস্যরা গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে। আমাকে সেখানে যেতে হবে। আমি দুপুর ১টায় পরীক্ষার পর যাওয়ার প্রস্তাব করলে তিনি অখুশি হন এবং বলতে গেলে আমাকে কিছুটা তিরস্কারও করেন। আমি তাঁর কথা না শুনে পরীক্ষার হলে উপস্থিত হই। পরীক্ষা শেষে হোন্ডা-মোটরসাইকেলে ঈশ্বরদী গিয়ে দেখতে পাই মোহাম্মদ নাসিম কর্মীসহ নিহত ছাত্রলীগ কর্মীর বাসায় আছেন এবং জানাজার দেখভাল করছেন। আমি নিজেও জানাজায় অংশগ্রহণ করি এবং একত্রে পাবনায় চলে আসি। পরে আমি সব পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি এবং কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করি। পক্ষান্তরে মোহাম্মদ নাসিম শুধু কর্মীদের প্রতি তাঁর দরদের কারণে আর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। ’৭৫ সালের জানুয়ারিতে জাতির বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠায় এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু পাবনায় মোহাম্মদ নাসিমকে জেলা কমিটির মহাসচিব ও আমাকে যুগ্মমহাসচিব হিসেবে মনোনীত করেছিলেন।

’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করার সময় মোহাম্মদ নাসিম ঢাকায় তাঁর বাবা অর্থাৎ সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলীর ৩০ নম্বর হেয়ার রোডের বাসায় অবস্থান করছিলেন। ভোরে তাঁর ফোনেই আমি এ হত্যাকান্ডের বিষয়টি জানতে পারি। তিনিই আমাকে কান্নারত অবস্থায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে সময় আমি বারান্দায় গর্জনরত এম মনসুর আলীর কণ্ঠ শুনেছি। তিনি খুনি মোশতাককে উদ্দেশ করে ইংরেজি ভাষায় ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। তাঁর কণ্ঠে সর্বশেষ যা শুনলাম তা হলো- ‘দিস উইল নট গো আনপানিশড’। যা হোক, পরে যা না হওয়ার তাই হয়েছে। সবাই তা প্রত্যক্ষ করেছে। মোহাম্মদ নাসিম সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে গেলেন। প্রতিরোধযুদ্ধ সংগঠনের আশায় সেখান থেকে একটি চিরকুট পাঠিয়ে বুলগানী নামীয় এক ছাত্রলীগ কর্মীর হাতে দিয়ে কলকাতায় তার কাছে সঙ্গীদের নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। আমি একেবারেই কপর্দকহীন হওয়ায় আশু সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। তবে কিছু টাকা জোগাড় করার পরপরই ভারতে যেতে উদ্যত হলে ২৫ আগস্ট পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হাতে আটক হই। জেলখানায় আটকরত অবস্থায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং শারীরিকভাবে চরম নির্যাতনের শিকার হই। এ অবস্থায়ই জাতীয় চার নেতা হত্যাকান্ডের শিকার হন। আমি তিন বছর কারারুদ্ধ থাকার পর ’৭৮ সালে একটি হ্যাবিয়াস কর্পাস রিটের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তি পাই। মুক্তি পাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ভিসা সংগ্রহ করে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটযোগে কলকাতায় চলে যাই। সেখানেই নাসিম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি এবং একসঙ্গে কয়েক দিন অবস্থান করি। নাসিম ভাই সপরিবার সেখানে অবস্থান করছিলেন। ভারতে কংগ্রেস সরকারের পরিবর্তন হওয়ায় পরবর্তী সরকার সীমান্তে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য করে যাঁরা ভারতে গিয়েছিলেন তাঁদের আর রাখতে চাচ্ছিল না। আমি দেশে চলে আসতে উদ্যত হলে নাসিম ভাই তাঁর স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের আমার সঙ্গে দেশে পাঠাতে চান। ওই সময় নাসিম ভাইয়ের দ্বিতীয় সন্তান কলকাতায় ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। ওই কোলের সন্তান সঙ্গে নিয়ে আমি, বড় ছেলে জয় (বর্তমান সংসদ সদস্য), বীথি ভাবি এবং আমার স্ত্রী সীমান্ত পার হয়ে যশোর হয়ে ঢাকায় আসি। নাসিম ভাই কলকাতায় থেকে যান এ কারণে যে, তাঁর অবর্তমানে পাবনায় সামরিক আদালত তাঁকে একটি মিথ্যা মামলায় পাঁচ বছরের কারাদন্ড দিয়েছিল। কাজেই সে সময় তাঁর আসা হয়নি। ছয় মাস পর তিনি দেশে আসেন এবং গ্রেফতারি পরোয়ানার কারণে আত্মসমর্পণ করে কারারুদ্ধ হন। পরে তিনি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্তি লাভ করেন। পরে নাসিম ভাই কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়েন। কালক্রমে তিনি কার্যকরী পরিষদের সদস্য, প্রচার সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও প্রেসিডিয়াম সদস্য পদ লাভ করেন। তিনি যুব জননেতা যথাক্রমে শ্রদ্ধেয় শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ এবং আমির হোসেন আমুর আস্থাভাজন ছিলেন। পাবনার রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় একই দলের দুই ধারা সৃষ্টি হয়। নাসিম-বকুল এ দুই ধারায় সংঘাতের কারণে অনেক নেতা-কর্মীকে অত্যাচার, জুলুম ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি আস্থাশীল বকুল পাবনার রাজনীতিতে দলীয় কোন্দলের কারণে হতাশ হয়ে অন্য দলে যোগ দিলেও তিনি সব সময় স্বাধীনতার চেতনা অন্তরে লালন করতেন ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন বলেই আমি জানি। নাসিম ও বকুল উভয়েই সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী ছিলেন।

নাসিমের অকালমৃত্যুতে আওয়ামী লীগ এমন এক দক্ষ নেতাকে হারাল যার ভার নেতা-কর্মীদের সহনীয় নয়।

বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি তাঁর ছিল গভীর আন্তরিকতা, বিশ্বাস ও মমত্ববোধ। তিনি কখনো হতাশাগ্রস্ত হননি। তিনি ছিলেন অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী। এরশাদ ও খালেদা জিয়াবিরোধী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। চরম নির্যাতনে পুলিশি বর্বরতার শিকারও হয়েছিলেন তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে খুলনার সন্ত্রাসী এরশাদ সিকদার ও যশোর-খুলনা অঞ্চলে কথিত সর্বহারা দুর্বৃত্ত দমনে তিনি সফল হন। জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে মূল্যায়ন করতে এক পা পিছপা হননি। তিনি নেত্রীর কাছে যথাযথ মর্যাদা পেয়েছেন।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

সর্বশেষ খবর