শুক্রবার, ২ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

সবার জন্য এসডিজি

মো. আবুল কালাম আজাদ

সবার জন্য এসডিজি

বাংলাদেশ মোবাইল ব্যাংকিং এবং বিশেষ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রত্যন্ত, পল্লী, এমনকি দুর্গম এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাংকিং কার্যক্রম সহজলভ্য করে আর্থিক পরিষেবা সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। কৃষক, হতদরিদ্র, মুক্তিযোদ্ধা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীসহ দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বাইরের লোকজন এখন মাত্র ১০ টাকা জমা দিয়ে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। এরই মধ্যে সারা দেশে এরূপ প্রায় ১০ লাখ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চালু হয়েছে এবং পরিচালিত হচ্ছে। দেশের অন্তত ৫০ ভাগ লোকের এখন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে যার মাধ্যমে তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক ব্যবস্থাপনার আওতায় এসেছে।

জনসেবা বিকেন্দ্রীকরণ এবং লাখ লাখ নিম্ন আয়ের নাগরিকের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরকার অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন (a2i) কার্যক্রমের মাধ্যমে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (UDCs) নামে পরিচিত ৫ হাজার ২৮৬ ওয়ানস্টপ সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা স্থানীয় উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করেছেন। ইউডিসিগুলোয় সব নিম্নবিত্তসহ সর্বস্তরের মানুষ তাদের তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান নির্বিশেষে প্রয়োজনীয় তথ্য এবং ১১২ ধরনের সরকারি ও বেসরকারি পরিষেবা পাচ্ছে আরও প্রয়োজনীয় পরিষেবা যুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে তারা কাজ করছে। এ ছাড়া ৮ হাজার ৫০০ পোস্ট অফিসকে সামাজিক সুরক্ষা ভাতা বিতরণের পাশাপাশি ওপরে বর্ণিত সমস্ত ডিজিটাল সেবা প্রদান করতে একটি ই-পোস্ট-সেন্টারে রূপান্তর করা হয়েছে। উন্নয়ন ধারণা অন্তর্ভুক্তিমূলক ‘কাউকে পেছনে না ফেলে’ নিশ্চিত করার জন্য এসব গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকার দারিদ্র্য, বৈষম্য, ঝুঁকি এবং সব ধরনের দুর্বলতা মোকাবিলার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশল (SSNP) অনুমোদন করেছে। অবহেলিত মানুষ বিশেষ করে মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের SSNP-এর অধীনে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এবং প্রবল ঝুঁকিসমূহ ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে; জীবনব্যাপী ঝুঁকি নিরসনের লক্ষ্যে আরও ভালো সমন্বয় এবং ভালো ফল পেতে সব প্রোগ্রাম সুসংহত করা হচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষার অধীনে উল্লিখিত কর্মসূচির পাশাপাশি শিক্ষাবৃত্তি, বয়স্কভাতা, মাতৃভাতা, বিধবা, দুস্থ ও নিঃস্ব মহিলাদের জন্য ভাতা, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প, আশ্রয়ণ প্রকল্প, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি, বেদে সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি এবং সুবিধাবঞ্চিত হিজড়াদের জন্য জীবনব্যাপী উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে হতদরিদ্র পরিবারের উন্নয়ন, চরাঞ্চলের মানুষের জীবিকা উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে।

বর্তমানে ২৮.৭ শতাংশ পরিবার সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সুবিধা ভোগ করছে; সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে এ কর্মসূচি ৪০ শতাংশ দরিদ্র পরিবারের মাঝে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সরকার বর্তমানে সামাজিক সুরক্ষা কর্মকান্ডে বার্ষিক বাজেটের ১৫ শতাংশ ব্যয় করে যা ২০৩০ সাল পর্যন্ত অক্ষুণœ রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এসব সুবিধা গ্রহণ ছাড়াও লোকজন কর্মমুখী শিক্ষা অর্জন করে এবং বিভিন্ন আয়বর্ধক উৎপাদনমূলক কাজে নিযুক্ত হচ্ছে। সরকার বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সুবিধাভোগীদের আরও স্বচ্ছতার সঙ্গে নির্বাচনের জন্য জাতীয় গৃহস্থালি তথ্য চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। জাতীয় উন্নয়ন কৌশলসমূহ সপ্তম ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসহ ২০৩০ সালের এজেন্ডার লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সুসংহত হয়েছে। সব প্রাসঙ্গিক অংশীদারকে জড়িত করার লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট সম্পর্কিত কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত ও বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত প্ল্যাটফরম তৈরি করা হয়েছে।

নারীর ক্ষমতায়নের জন্য বাংলাদেশ সারা বিশে^ ‘রোল মডেল’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২০২০ সালের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপের প্রতিবেদন অনুসারে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১৫৩ দেশের মধ্যে ৫০তম স্থান অর্জন করেছে। লিঙ্গবৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে বাজেটে সরকার গত আট বছরে গড়ে মোট জিডিপির ৫% এবং জাতীয় বাজেটের ২৭% বরাদ্দ দিয়ে আসছে। হিজড়া, চা শ্রমিক, বেদে ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী, ভিক্ষুক, পথশিশু, বিশেষ অঞ্চলের মানুষ, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, চর এলাকার মানুষ, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ইত্যাদি বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। কাউকে পেছনে না ফেলে অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই উন্নয়নব্যবস্থা যেমন অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো এবং সমস্ত স্তরের ব্যবসায়িক মডেলের রূপান্তর প্রয়োজন। বিভিন্ন অংশীদারের মতামত শোনা এবং পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে তাদের অংশগ্রহণ কার্যকর প্রয়োজন। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও কভিড-১৯ মহামারীর মুখোমুখি হয়েছে যা বিপুলসংখ্যক প্রান্তিক মানুষকে হতদারিদ্র্যের মধ্যে নিমজ্জিত করেছে।

বিভিন্ন সেক্টরে গতিশীলতা আনয়ন সামগ্রিক উন্নয়ন ও অর্থনীতির চাকা সচল রাখার লক্ষ্যে সরকার বেসরকারি খাতে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি পরিমাণ অর্থসহ বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, এতে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি বিনিয়োগ টিকিয়ে রাখা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করে জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে অব্যাহত রেখেছে যা অনেক উন্নত এবং উদীয়মান দেশকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশের ইতিবাচক অবস্থান নিশ্চিত করেছে। গত বছর বন্যা ও নদীভাঙনের পাশাপাশি আম্ফান ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আঘাত করায় তারা আরও চরম দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার মধ্যে পৌঁছেছে। এ অস্বাভাবিক কভিড-১৯, আম্ফান এবং বন্যার মুখোমুখি হওয়ার পর উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে অত্যন্ত নগণ্য অতিরিক্ত সহায়তা পাওয়া ছাড়া বাংলাদেশ নিজস্ব সম্পদ  এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি ও নেতৃত্বের সঙ্গে সমস্ত ইতিবাচক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে একটি অনুকরণীয় স্থিতিস্থাপকতা দেখিয়েছে, যা বাংলাদেশকে ‘জলবায়ু দুর্বলতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শিক্ষক’ করে তুলেছে বলে জাতিসংঘের অষ্টম সেক্রেটারি জেনারেল বান কি-মুন অবহিত করেছেন। জাতিসংঘের বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল অ্যান্তোনিও গুতেরেস তাঁর সাম্প্রতিক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা এ সংকট চলাকালে ও তার পরে (কভিড-১৯) যা কিছু করব তা অবশ্যই অধিকতর সমতা, অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে এবং টেকসই অর্থনীতি ও সমাজ গঠনে বেশি মনোযোগী হবো যা ভবিষ্যতে মহামারী, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করবে।’ আমরা সবাই জানি ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও ভেদাভেদ কাম্য নয়; বরং এর ফলস্বরূপ সেগুলো দশকের পর দশক নীতি ও গতিশীলতার সমতা বিনষ্ট করেছে এবং সবার উন্নত জীবন গড়ার প্রয়াস ব্যাহত করে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার সমাজের প্রান্তিক সুবিধা বঞ্চনাসহ সার্বিক বঞ্চনা, সুবিধাবঞ্চিত লোককে পিছে ফেলে না যাওয়া এবং অন্য মানবাধিকারসমূহ রক্ষাসহ এসডিজি বাস্তবায়নে রাজনৈতিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

লেখক : সাবেক মুখ্যসচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর