রবিবার, ৯ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

গোরস্থানে বিপ্লব

লাকী আক্তার

গোরস্থানে বিপ্লব

ইদানীং কী যে হয়েছে! ঘুম আসে না। ঘুমোতে চাই, কিন্তু ঘুমোতে পারি না। প্রতিটি রাতই যেন অমাবস্যা।

চাঁদের দিকে তাকিয়ে টের পেলাম আজ ভরা পূর্ণিমা। আজ রাতেও আমি নির্ঘুম। রাত বাড়তে থাকলে আমার শিকারে যেতে মন চায়। শুনেছি আমাদের হাজার বছরের আগের পূর্বপুরুষরা প্রতি পূর্ণিমা রাতে শিকারে যেতেন।

বোধহয় জিনগত প্রভাব মাথায় ভন ভন করে। মন উন্মত্ত হয়। রাত হলে আমি কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে যাই। আজ বড্ড শীত শীত, শরীর হিম হিম। প্রকৃতি দেখতে বের হলাম। একটু হাঁটতেই দূরে প্রমত্তা নদীর ঢেউয়ের গর্জন শুনতে পাচ্ছি। নদীর ঢেউ আছড়ে পড়ছে একেবারে নদীর পাড়ে। একদম কিনারে। শুনতে পাচ্ছি ঝপঝপ শব্দের মূর্ছনা। পূর্ণিমার আলো আজ নদীর জলকে করে তুলেছে আরও চকচকে। আরও মনোরম।

এ নদীর পাড়ে হাওয়া আর বাতাসের লুটোপুটি চলে। ঝিঁঝিপোকা গায় হাজার বছরের পুঁথির সুর। মনের বেদনাগুলোও আছড়ে পড়তে চায় ওই নদীর ঢেউয়ের মতো। নদীর পাড়েই হাঁটতে গিয়ে দেখলাম, উইঢিবিগুলো কেমন করে নিরলসভাবে বানিয়ে চলেছে তাদের আবাস। শহরের কোলঘেঁষে নদী। আর নদীর পাশেই একটা ছোট্ট গোরস্থান। বেশ সুনসান। দূর থেকে এ পূর্ণিমা রাতে দেখা যাচ্ছে সেখানে জড়ো হয়েছে গোরস্থানের একঝাঁক মৃত বাসিন্দা। শুনেছি এদের বৈঠক নিয়মিতই হয়। খোশগল্প করতে করতে তাদের রাত সাবাড় হয়ে যায়। দিনের আলোয় তাদের দেখা মেলে না।

আমি শব্দহীন হয়ে খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে এগোলাম গোরস্থানের কাছে। তখনো কানে শুনতে পাচ্ছি নদীর ধারের ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর স্বর। থেকে থেকে নদীর কিনারে লেজ দিয়ে ঝাপটা দিচ্ছে কয়েকটি বড় সরপুঁটি। আমি গিয়ে দাঁড়ালাম দূরে একটা হিজল গাছের নিচে। বাঁশির সুরে মোহিত হয়ে যাচ্ছে চারপাশ। বয়সী বটগাছটির নিচে আনমনে বাঁশি বাজাচ্ছে এক যুবক। মনে হলো নাম তার সলু মিয়া। আরে এ লোকটাই না গত বছর বেতনের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে মরে গেছিল? মনে পড়ে গেল সেদিনের কথা। টিভিতে দেখেছিলাম। মাথায় একটা লাল কাপড় বাঁধা ছিল। রাজপথ লাল হয়ে গেছিল তার রক্তে। আজ কী দারুণ বাঁশি বাজাচ্ছে সে। আহা কী দারুণ সুর। সলুর সঙ্গে সুর মেলায় গোরস্থানের কোলাব্যাঙ। একটি হুতোম পেঁচা গভীর মনোযোগ দিয়ে বাঁশির সুর শোনে!

একটু দূরে একটি ছাতিমের গাছ। এখানে প্রায় প্রতি রাতেই ভিড় করে মৃতেরা। গল্পসল্প করে কাটিয়ে দেয়। বাতাস খায়। আজ এ ছাতিম গাছটার নিচে বেশ হইহই রইরই।

ভাবলাম এগিয়ে যাই। কিন্তু যেতে ইচ্ছা করছে না। বুঝলাম বেশ বাগ্বিতন্ডা চলছে। চুপচাপ তাদের ঝগড়ার বিষয়বস্তু বোঝার চেষ্টা করি। তখনো সলু মিয়া বাঁশি বাজাচ্ছে। এরই মধ্যে ব্যাপক হট্টগোল। অগত্যা সলুর বাঁশি থামে। বিরক্তমুখে ছাতিম গাছের দিকে এগোতে থাকে সে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে এখানে বেশ উত্তপ্ত পরিস্থিতি। একজন আরেকজনকে বেশ দোষারোপ করছে। সলুকে দেখে কয়েকজন এগিয়ে এসে বলে-

কই আছিলা মিয়া এতক্ষণ? আইজ একটা হেস্তনেস্ত করাই লাগব!

সলু বলে, আপনেগো কী হইছে আবার? এর মধ্যে তাসলিমা নামে মধ্যবয়সী এক নারী ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসে। বলে যায়, আমাগো খাওন-দাওনের কোনো ঠিকঠিকানা নাই। যহন জ্যাতা আছিলাম তহনও আমি খিদায় মরছি, কিন্তু আইজ এত দিন গেল আমাগো লাইগা কোনো বন্দোবস্ত নাই। আমরা মরছি দেইখা কি রেশনও পামু না? আমাগো খিদা তো অহনও মরে নাই।

সলু বলল, কন কী? আপনেগো অহনও খিদা লাগে?

ভিড়ের মধ্য থেকে সালমা খাতুন উচ্চকণ্ঠে বলে, ভাবছি এইহানে কুনো সমস্যা নাই। মাগার এইহানেও দেহি কোনো বন্দোবস্ত রাহে নাই আমাগো লাইগা!

জমিল শেখ বলেন, মিয়া! কাইল রাইতে খুব তেষ্টা পাইছিল। গোরস্থানের ডাব গাছ থাইকা একটা ডাব পাড়তে গেছিলাম। ওই বড়লোকের বেটা খোদার খাসি সমির আলী কইছে গোরস্থানের সব ডাব নাকি হের। জ্যান্তাকালেও হালা সব খাইত! মইরা গিয়াও সব অগো! এইডা কুন নিয়ম?

ফাতেমা বলে ওঠে, মিয়া! তুমি নাহি একটা কামিল বেডা আছিলা? যহন জ্যাতা আছিলা তহন নাহি মিছিল টিছিল করতা? তা এহন খালি বাঁশিত ফুঁ দিলেই অইব! এইহানের বেইনসাফির বিরুদ্ধে একটা কিছু কর!

সলু বলল, আহারে বইন! এই খাওনের দাবিতে মিছিল করতে করতেই তো আমি রাস্তায় ছটফটাইয়া মইরা গেছিলাম। ইস, ইট্টু পানিও পাই নাই! আহা কপাল বরাবর গুলিডা লাগছিল! পুরান কতা মনে করাইয়া দিলেন আফা!

অহন আপনেরা মিছিল করবেন। কার কাছে দাবি কইবেন?

সমস্বরে গোরস্থানের সব মৃত বলে ওঠে, কারও কাছে কুনো দাবি নাই, ওরে খেদামু!

ফাতেমা বেগম বলে, ‘আইজ ওই বেডা সমির আলীরে গোরস্থানছাড়া করতেই অইব! জ্যাতা থাকতে মালিক আছিল, সব মাইনষের টেহা ব্যাংকে ঢুকাইত! অহন গোরস্থানের বেবাকের খাওন বেডা একলাই খায়। আবার বেডার নজর মইরাও ভালা অয় নাই! এইহানে শান্তিমতোন একটু বইতেও পারি না! বাতাস খাইতেও পারি না! বেডা কুনজর দেয়।

তারপর কবরের পাশের ছোট্ট পথ ধরে এই গহিন রাতে মিছিল শুরু হয়! সলু মিয়া স্বভাবসুলভ নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রকম্পিত হতে থাকে গোরস্থান। কেউ কেউ সেøাগান ধরে, ‘দুনিয়ার মৃত মানুষ, এক হও লড়াই কর!’ হুতুম পেঁচারা এদিক-সেদিক উদ্ভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করে। কয়েকটি পেঁচা জোরে জোরে ডাকতে থাকে। নদীর ধারের ব্যাঙেরা ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডেকে সংহতি জানায়।

হিজল গাছের নিচ থেকে ধীরে ধীরে আমিও এগিয়ে যাই। অদ্ভুত আঁধারের সেই মিছিলে আমিও মিশে যাই। হাঁটতে থাকি। আমি এখন আর আমার ছায়াও দেখতে পাচ্ছি না। দূরে শহরটাকে দেখা যায়। সেখান থেকে কয়েকটি কুকুর আর বিড়াল হাঁক ডেকে ডেকে আমাদের সংহতি জানায়। শহরের ঘুমন্ত মানুষ কুকুরের ডাক শুনে আবারও পাশ ফিরে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়! অথচ কেউ জানলই না এ গোরস্থানে আজ একটা বিপ্লবই ঘটে গেছে। আজ এ পূর্ণিমা রাতে গোরস্থানের মৃত বাসিন্দারা বিদ্রোহ করে খোদার খাসি সমির আলীকে গোরস্থান থেকে লাথি মারতে মারতে বের করে দিয়েছে!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর