শনিবার, ২৯ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

জিয়ার রাজনীতির পাপ ও পরিণতি

সৈয়দ বোরহান কবীর

জিয়ার রাজনীতির পাপ ও পরিণতি

জিয়ার মৃত্যুর চার দশক হচ্ছে আগামীকাল ৩০ মে। ১৯৮১ সালের ওই দিনে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একদল সেনা সদস্যের হাতে জিয়া নিহত হন। জিয়ার মৃত্যুর চার দশকেও বিএনপি টিকে আছে এবং দুই দফা ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জিয়ার অবস্থান আজ কোথায় এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করার যে নীতি ও কৌশল, সে কৌশলে জিয়াউর রহমানের রাজনীতিই এখন সংকটাপন্ন। জাতীয় রাজনীতিতে জিয়া এখন খলনায়ক। বিএনপির রাজনীতিতে জিয়া এখন পার্শ্বচরিত্র। ইতিহাসে জিয়া এখন এক পরিত্যক্ত অধ্যায়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়ার উত্থান ষড়যন্ত্র এবং অবৈধ পন্থায়। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। এ হত্যাকান্ডে নিষ্ক্রিয়, নির্মোহ থাকা ছিল রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের প্রথম পা। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জিয়া খুনিদের ষড়যন্ত্রের কথা জানতেন। একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তার দায়িত্ব ছিল সেনাপ্রধান এবং রাষ্ট্রপতি অথবা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি জানানো। এটা জানালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু জিয়া সব জেনে, তাদের সম্মতি দিয়ে কার্যত ’৭৫-এর ক্যু-এ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কেন এটা জিয়া করেছিলেন এর উত্তর খুঁজতে আমাদের ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যেতে হয়।

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার ভূমিকা ছিল রহস্যময়। এ সময় তাকে লেখা পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার চিঠি থেকেও বোঝা যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করলেও জিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গোপন যোগাযোগ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জার্মানরা বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীতে তাদের ‘এজেন্ট’ রাখত। যারা প্রয়োজনে এমন কান্ড ঘটাত যাতে লাভ হতো নাৎসিদের। জিয়াউর রহমান কি সে রকম কোনো এজেন্ট ছিলেন? এ নিয়ে এখন বেশ কথাবার্তা চলছে। আমি মনে করি, ’৭১-এ জিয়াউর রহমানসহ পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া সেনা সদস্যদের ব্যাপারে গবেষণা হওয়া দরকার। এদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধে কেন এসেছিলেন সে প্রশ্ন এখন উঠতেই পারে। বিশেষ করে ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর এ প্রশ্নের সঠিক এবং গবেষণানির্ভর উত্তর অত্যন্ত জরুরি। ’৭৫-এর খুনিদের বেশ কয়েকজন ’৭১-এর তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে এরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, অনেকেই জীবন বাজি রেখে পালিয়ে এসে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু খুনি রশীদ, ফারুক, ডালিমরা কি তাই ছিল? নাকি তাদের পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাই পাঠিয়েছিল ভিতরে থেকে সর্বনাশ করতে। সামরিক বিজ্ঞানে বলে, একটি যুদ্ধজয়ই শেষ কথা নয়। যুদ্ধের পরও যুদ্ধ থাকে। পাকিস্তান সেই গোপন যুদ্ধ আজও চালিয়ে যাচ্ছে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র করা। পাকিস্তান একাত্তরে পরাজয়ের পর আশা করেছিল বাংলাদেশ টিকবে না। বাংলাদেশ আবার পাকিস্তান না হোক, কনফেডারেশন হবে। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে আইএসআই অনেক বেশি সক্রিয় ছিল, এখনো আছে। যারা সে সময় পালিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে এসেছিল, তাদের কেউ কেউ যে পাকিস্তানের এজেন্ট ছিল তা আজ প্রমাণিত। এরা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর এজেন্ডা বাস্তবায়নের কাজেই ব্যস্ত ছিল। পাকিস্তান জানত বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে বাংলাদেশকে আর পাকিস্তান বানানো সম্ভব নয়। এজন্যই ’৭৫-এর নৃশংসতম হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছিল। আর ওই হত্যাকান্ডের ঘাতকদের প্রায় সবাই পাকিস্তান প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধা। এদের সঙ্গে জিয়ার সম্পর্কের কথাও এখন উন্মোচিত। তাই জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর ৪০ বছর পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, জিয়া কি একজন মুক্তিযোদ্ধা না মুক্তিযোদ্ধারূপী পাকিস্তানি এজেন্ট?

এ প্রশ্ন প্রবল এবং তীব্র হয় ’৭৫-পরবর্তী জিয়াউর রহমানের কর্মকান্ডে। ৭ নভেম্বর ক্যু-পাল্টা ক্যুর রক্তাক্ত অধ্যায়ের মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রে আসেন জিয়া। জিয়াকে ক্ষমতার কেন্দ্রে আনতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন তাহের। কিন্তু জিয়া তার সঙ্গেও নিকৃষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা করেন। জিয়া যে তাহেরকে হত্যা করেছেন, তা আজ আদালতের রায়েই প্রমাণিত। এরপর জিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপ, সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগ ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের পক্ষে। জিয়া সংবিধান স্থগিত করেছিলেন। সামরিক ফরমানবলে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র উপড়ে ফেলেছিলেন। জিয়া ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জেলে ঢুকিয়ে রাজাকার, আলবদর ও যুদ্ধাপরাধীদের জেল থেকে বের করেছিলেন। গোলাম আযমের মতো ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধের শিরোমণিকে দেশে আসার অনুমতি দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান শাহ আজিজের মতো স্বাধীনতাবিরোধীকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। এ রকম ফিরিস্তি দিলে তা অনেক দীর্ঘ হবে। আমি শুধু জিয়ার রাজনৈতিক প্রবণতা উল্লেখ করলাম। তিনি সেনাপ্রধান হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর এজেন্ডা বাস্তবায়নের কাজে দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এমনকি ‘বাংলাদেশ বেতার’-কে রেডিও বাংলাদেশ বানানোর মতো ছোটখাটো বিষয়েও তার নজর এড়ায়নি। কিন্তু এসব করেও যেন জিয়ার এজেন্ডা বাস্তবায়ন পুরোপুরি হচ্ছিল না। জিয়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। কর্নেল তাহেরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। একই কায়দায় ১৯৭৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিচারপতি সায়েমের সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করেন। বঙ্গভবনে ডেকে অস্ত্রের মুখে বিচারপতি সায়েমকে হটিয়ে নিজেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। জিয়ার রাজনীতির মূল অনুষঙ্গ অবশ্য এই ‘বিশ্বাসঘাতকতা’। জনগণের সঙ্গেও জিয়া বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। ’৭৫-এর ১১ নভেম্বর জিয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি রাজনীতিবিদ নই। আমি একজন সৈনিক। ...রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই এবং আমার সরকার সম্পূর্ণ নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক।’ এ বক্তব্যও ছিল এক ধরনের প্রতারণা। এরপর জিয়া সামরিক পোশাকে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হন। জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন, ছাত্রসংগঠন তৈরির চেষ্টা, জাগদল গঠন প্রক্রিয়া শেষে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করেন। সেনাপ্রধান একজন সরকারি কর্মকর্তা। সরকারি চাকরি করে রাজনৈতিক দল গঠন, নির্বাচন শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই নজিরবিহীন।

’৭৫-এর ৭ নভেম্বর থেকে ’৮১-এর ৩০ মে পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে জিয়াই ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এ সময়ে তার কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জিয়া একদিকে পাকিস্তান বানানোর নীরব প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্যদিকে বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানোর আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন। একটি রাষ্ট্রের এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন। গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হলো অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন ঘটানো। বাংলাদেশে ভৌতিক ভোট সংস্কৃতির সূচনা করেছিলেন জিয়া। আগে ভোট নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হতো। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে কারচুপির অভিযোগ আনত। কিন্তু জিয়াউর রহমান গায়েবি ভোটের এক অভূতপূর্ব সংস্কৃতি চালু করেন। ১৯৭৭ সালের ৩০ মে জিয়া হ্যাঁ-না গণভোটের আয়োজন করেন। প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ জিয়ার রাজনৈতিক জীবন নিয়ে একটি ঢাউস সাইজের গ্রন্থ লিখেছেন। ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ; এ পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফি’ শিরোনামে ওই গ্রন্থের ৭১ পৃষ্ঠায় বিস্ময়কর এ ভোট বিপ্লব নিয়ে জিয়াও যে হতবাক হয়েছিলেন তা উল্লেখ করা হয়েছে। জিয়া তার সমর্থনে ওই গণভোটে ৯৮ দশমিক ৮০ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন! বিরোধী দলের ওপর দমন-নিপীড়ন। বিরুদ্ধমতকে হত্যা, ভয় এবং ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেই জিয়া ক্ষমতায় ছিলেন। বিদেশি ঋণনির্ভর অর্থনীতি, খাদ্য ঘাটতি রাখার কৌশল ছিল বাংলাদেশকে দীর্ঘ মেয়াদে পঙ্গু করার নীরব পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। প্রশ্ন উঠতেই পারে, জিয়া কেন এসব করেছিলেন? এটা কি অদক্ষতা না পরিকল্পিত? এ প্রশ্নের উত্তরে সাদামাটাভাবে বলা যায়, জিয়া আসলে ছিলেন পুতুল। পাকিস্তানি এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য যা যা দরকার তা-ই তিনি করেছেন। পাকিস্তান আমলে যেমন উগ্রবাদী এক সফল প্রচারণা চালানো হতো যে, ভারতবিরোধিতা মানেই দেশপ্রেম। জিয়াউর রহমান খুব দক্ষতার সঙ্গে সে চেতনা ফিরিয়ে আনেন। দেশে প্রচার-প্রচারণার ভারতবিরোধিতা করে দেশপ্রেমের আলখাল্লা পরেন জিয়াউর রহমান।

বাংলাদেশের রাজনীতিতেও পাকিস্তানি ধারা ও সংস্কৃতির সফল অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিলেন জিয়া। জিয়া নিজেই বলেছিলেন, ‘রাজনীতি ডিফিকাল্ট’ করবেন। রাজনীতি ডিফিকাল্ট করতে গিয়ে জিয়া সেনা গোয়েন্দা সংস্থাকে যথেচ্ছভাবে রাজনীতিতে ব্যবহার করেছেন। কালো টাকা, অস্ত্র, মাস্তান দিয়ে রাজনীতিবিদদের কোণঠাসা করেছেন। রাজনীতিতে সামরিক-বেসামরিক আমলাদের হিসসা দিয়েছেন। পাকিস্তানি দুর্নীতিগ্রস্ত খিচুড়ি রাজনীতির মডেল জিয়া সফলভাবেই বাংলাদেশে প্রতিস্থাপন করেছেন। সে সংস্কৃতি থেকে এখনো বাংলাদেশের রাজনীতি বেরোতে পারেনি।

একটি কথা প্রায়ই বলা হয়, বঙ্গবন্ধু আর দশটা বছর দেশ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিলে বাংলাদেশ উন্নত আধুনিক এক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াত। ঠিক একইভাবে বলা যায়, জিয়াউর রহমান আর দশ বছর ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশ অবিকল একটি ‘পাকিস্তান’ হতো। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য সস্তা রাজনৈতিক সমালোচনায় জিয়াকে মর্যাদাবান করা হয়েছে। বাংলাদেশে জিয়াকে নিয়ে একটি নির্মোহ গবেষণা হওয়া দরকার ছিল। আওয়ামী লীগ সে পথে না গিয়ে জিয়ার বিরুদ্ধে রাজনীতির সস্তা বক্তৃতায় ব্যস্ত থেকেছে। আওয়ামী লীগের সমালোচনার জবাব দিতে জিয়াবন্দনার মাত্রা বাড়িয়েছে বিএনপি। পাল্টাপাল্টি আক্রমণে সত্য তলানিতে পড়ে গেছে। এ সত্যটা বের করা অত্যন্ত জরুরি।

’৮১-এর ৩০ মে জিয়াউর রহমান মারা যান। তার মৃত্যুর পরও জিয়ার রাজনৈতিক ধারা বন্ধ হয়নি। বিএনপি তার অস্তিত্বের প্রয়োজনে জিয়াকে মহিমান্বিত করার এক অদ্ভুত রাজনীতি শুরু করে। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে আওয়ামীবিরোধী শক্তিকে একত্রিত করেছিলেন। উগ্র বাম ও উগ্র ডানকে তিনি ক্ষমতার ঘাটে জল খাইয়েছিলেন। ফলে তার একটা উগ্রবাদী সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। জিয়ার মৃত্যুর পর তার জানাজায় বিপুল মানুষের অংশগ্রহণ তারই প্রমাণ। যারা পাকিস্তানে বিশ্বাস করে, যারা মুসলিম লীগের জন্য হাহাকার করে, রক্তাক্ত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ব্যর্থতায় যারা হতাশ, যারা আওয়ামী লীগকে অপছন্দ করে তাদের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন জিয়া। এরাই জিয়াকে সৎ হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন।

জিয়ার মৃত্যুর পর বিএনপি নেতারা দুটি বিষয় আবিষ্কার করেন। প্রথমত, একটি রাজনৈতিক দলের যে আদর্শিক ভিত্তি তা বিএনপির নেই। দ্বিতীয়ত, বিএনপি ক্ষমতার গর্ভে গড়ে ওঠা বহুমতের একটি ক্লাব। তাই এ দলকে টিকিয়ে রাখতে বিএনপি জিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে বেগম খালেদা জিয়াকে সামনে আনে। আর তীব্র নাৎসি কায়দায় জিয়াবন্দনায় মনোযোগ দেয়। লক্ষ্য করুন, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হলো বিএনপির প্রতিষ্ঠাতার পুরো নাম। সহধর্মিণীরা সাধারণত স্বামীর নামের শেষ অংশ গ্রহণ করেন। তাহলে বেগম জিয়ার নাম হওয়া উচিত ছিল বেগম খালেদা রহমান। ‘জিয়া’নির্ভর রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতেই খালেদার নামের পাশে জিয়া জুড়ে দেওয়া হয়। জিয়া কোনো পদবি নয়। জিয়ার বংশপদবি হলো রহমান। বিএনপিকে বাঁচিয়ে রাখাটা ছিল পাকিস্তানি এজেন্ডা। কারণ বিএনপি না থাকলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তানের স্বার্থ দেখবে কে?

তাই জিয়ার মৃত্যুর পরও বাংলাদেশে জিয়াবন্দনা বন্ধ হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা প্রবল হয়। যেমন জিয়া নিজেকে কখনো স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। কিন্তু জিয়ার মৃত্যুর পর বিএনপি নেতারা ‘ঘোষকতত্ত্ব’ আবিষ্কার করেন। নব্য গড্ডলিকা গবেষক তো জিয়াকে প্রথম রাষ্ট্রপতিও বানিয়ে ফেলল। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জিয়ার মৃত্যুর পর বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থিরা অনুসন্ধানে নামেন জিয়াকে কীভাবে অমরত্ব দেওয়া যায়। কিন্তু দেখা যায়, জিয়ার পরিচয় একজন সেনা সদস্য, একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন হিংস্র প্রতিশোধপ্রবণ একনায়ক। এ পরিচয় দিয়ে তো আর জিয়াকে অমর জাতীয় নেতার মর্যাদা দেওয়া যায় না। কাজেই বিএনপিপন্থি পন্ডিতরা ইতিহাস বিকৃতির পথে পা বাড়ান। জিয়া যা নন, যা ছিলেন না তা বলার এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি জিয়ার নাম বসানোর ঔদ্ধত্য দেখায় অনেকে।

২০০১ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ জিয়ার মৃত্যুর দুই দশক পর্যন্ত জিয়া বন্দনাই ছিল বিএনপির রাজনীতির প্রধান উপজীব্য। এ মাতম তুলেই বিএনপি আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তিকে এক প্ল্যাটফরমে রাখে। দুবার ক্ষমতায় আসে। এর মধ্যে বিএনপিই প্রথম জিয়াকে অপ্রয়োজনীয় ভাবতে শুরু করে। বিএনপি প্রথম তাকে মূর্তি বানিয়ে সাজিয়ে রাখার নীতি গ্রহণ করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট জয়ী হওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারেক রহমানের উত্থান ঘটে। ওই নির্বাচনে বিপুল বিজয় বিএনপিকে বেসামাল করে। তারা মনে করে নতুন নেতা এসেছে, জিয়া এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। ২০০১ সালে শুরু হয় তারেকবন্দনা। তারেক যেন মিনি সাইজ জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানের মতো তারেক গ্রামগঞ্জে যাওয়া শুরু করেন। জিয়ার মতোই তারেক ভাঙা স্বরে, ধমক দিয়ে দিয়ে বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করেন। সানগ্লাস, কোমরে হাত, মাথায় ক্যাপ- তারেক নিজেই জিয়ার কার্বন কপি হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু নকল শাহরুখ খান কি আর আসল শাহরুখ হয়। নকল জিয়াও তাই কেবল জিয়াকে নির্বাসিত করে, জিয়া হতে পারে না। তারেক জিয়া এসে আদি জিয়াপন্থিদের নির্বাসনে পাঠাতে শুরু করেন। অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে গলা ধাক্কা দিয়ে বঙ্গভবন থেকে বের করে দেওয়া হয়। জিয়ার ঘনিষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) অলি আহমদকে বিদায় করা হয়। হাওয়া ভবন গড়ে বিকল্প নেতৃত্বের নামে বাবর-আমানদের দিয়ে তারেক নতুন বিএনপি বা সমান্তরাল বিএনপি গড়ে তোলেন। বিএনপি নেতা-কর্মীরাও বুঝতে পারেন, জিয়াবন্দনা করে কোনো লাভ নেই, তারেকবন্দনা না করলে হালুয়া-রুটি পাওয়া যাবে না। ব্যস, শুরু হয় জিয়াকে সরিয়ে ফেলার প্রতিযোগিতা। বিএনপির কর্মসূচিতে জিয়ার ছবি ছোট হতে থাকে। বড় হয়ে উদ্ভাসিত হয় তারেক রহমানের ছবি। ‘ভাইয়া’ সংস্কৃতিতে প্লাবিত হয় বিএনপি। জিয়া সম্পর্কে পাকিস্তান প্রেসক্রিপশনে কিছু ‘মিথ’ ছড়ানো হয়েছিল। পরবর্তীতে দেখা গেছে, এসবের অধিকাংশই মিথ্যা। এসব মিথের মধ্যে ছিল, জিয়া সৎ। জিয়া তার আত্মীয়স্বজনকে বাড়িতে ঢুকতে দেন না। কিছু কিছু মানুষের হৃদয়ের কোনায় ‘পাকিস্তান’ বসবাস করে, তারা এসব বেদবাক্যের মতো বিশ্বাস করতেন, আওড়াতেন। নতুন বিএনপিতে তারা দেখলেন উল্টো চিত্র। তারেকের হাওয়া ভবনকেন্দ্রিক দুর্নীতি-লুটপাট মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। বেগম জিয়া তার ভাইবোন চৌদ্দগুষ্ঠিকে ক্ষমতার তবারক বণ্টন করলেন। ওই সব অন্ধ সমর্থকের মোহভঙ্গ ঘটল। তারা দেখলেন, এই বিএনপি সেই বিএনপি নয়। তারেকের বিত্তবৈভবের বিপরীতে তারা ফজলে লোহানী আবিষ্কৃৃত ‘ভাঙা স্যুটকেস’ মেলাতে পারলেন না। আর এখান থেকেই নীরব সমর্থকরাও বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। স্বার্থের রাজনীতি বোধহয় এমনই। তারেক পিতার ছায়া থেকে বেরোতে পিতাকেই নির্বাসনে পাঠালেন। ২০০৭ সালে বিএনপি মহাসচিব প্রয়াত আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এক সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘জিয়াউর রহমানের আদর্শচ্যুত হয়েছে বিএনপি। জিয়াকে দ্বিতীয়বার হত্যা করা হয়েছে।’ ফলে জিয়াউর রহমান তার মৃত্যুর ৪০ বছর পর কোথাও নেই। সংসদ ভবনের উল্টোপাশে তার সমাধিস্থল ছাড়া কোথাও জিয়া নেই (সেখানেও কি তিনি আছেন?)। বিএনপির দিবসভিত্তিক রাজনীতিতে জিয়া আসেন নেতাদের মিনমিনে কণ্ঠে। আত্মঘাতী রাজনীতির পরিণতির প্রামাণ্য বিজ্ঞাপন জিয়াউর রহমান। মৃত্যুর চার দশক পর জিয়া নির্বাসিত তার দলে-দেশে। এটাই ইতিহাসের মাধুর্য। ইতিহাস কখনো কাউকে যোগ্য স্থান দিতে কার্পণ্য করে না। ইতিহাসের প্রতিশোধ কত নির্মম তার প্রমাণ জিয়াউর রহমান।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর