রবিবার, ১৩ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

শিক্ষার্থী ঝরে পড়া : সংকটে গরিব মেয়েরা

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার

শিক্ষার্থী ঝরে পড়া : সংকটে গরিব মেয়েরা

করোনাভাইরাসের কারণে থমকে আছে পুরো পৃথিবী। থমকে গেছে জীবন-জীবিকা, শিক্ষাঙ্গনও। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে পড়ার বদলে  অনলাইন পড়াশোনায় অংশ নিচ্ছে বিশ্বের লাখো শিক্ষার্থী। শ্রেণিকক্ষের বৈচিত্র্যময় পরিবেশ ও উদ্ভাবনী উদ্যোগ, শিক্ষার্থীর মুক্তচিন্তা, সুকুমারবৃত্তির চর্চা, মেধা, মনন এবং সৃজনশীলতার চেয়ে বেশি দামি ও অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। শত বছর ধরে চলে আসা ক্লাসে বসে পড়ার প্রাচীন ব্যবস্থায় এসেছে পরিবর্তন। বড় ব্ল্যাক বোর্ড, হোয়াইট বোর্ড, চক, ডাস্টার ও মার্কারের পরিবর্তে এসেছে মিনি স্ক্রিনের ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, ইলেকট্রনিক পেন ইত্যাদি। স্কুল মানেই এখন ‘গুগল ক্লাসরুম’, ‘জুম-ইন অ্যান্ড জুম-আউট’, ‘ক্লিক অর ক্লিক’। আমাদের দেশেও বেতার, টেলিভিশন, অনলাইন ও মুঠোফোনের মাধ্যমে সরকার পড়াশোনা চালু রাখতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় প্ল্যাটফরমের অভাবে ৬৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে তা পৌঁছেনি। তবু অনলাইন ক্লাসের বিকল্প কিছু নেই এ মুহূর্তে। গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেটরি রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স (বিআইজিডি)-এর যৌথ গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে যথাক্রমে ১৯ ও ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে করোনার কারণে। অথচ মহামারীর আগে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৪ ও ২১ শতাংশ। বিভিন্ন সমীক্ষামতে ২০১৯ সালে ঝরে পড়ার গড়হার ১৭.৯ শতাংশ, ২০২০ সালে ৩৬ থেকে ৪৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ৭৬ শতাংশ। শহর ও গ্রামের হতদরিদ্র, মাঝারি দরিদ্র, ঝুঁকিপূর্ণ দরিদ্র এবং দরিদ্র নয় এমন পরিবারের মধ্যে ‘কভিড ইমপ্যাক্ট অন এডুকেশন লাইফ অব চিলড্রেন’ শিরোনামে পিপিআরসি ও বিআইজিডি ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশজুড়ে তিন ধাপে তিনটি বিষয় যথাক্রমে স্কুলের ধরন, স্থান ও লিঙ্গের ওপর একটি টেলিফোন জরিপ করে। দেখা যাচ্ছে শিক্ষণ ঘাটতির এ হার মেয়েদের ২৬ ও ছেলেদের ৩০ শতাংশ। মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরবর্তী শিক্ষার সুবিধা নিতে পেরেছে, ৩৩ শতাংশ দরিদ্র শিক্ষার্থী স্কুল ছেড়ে দেওয়ার আশঙ্কায় আছে, ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ব্যাপক মানসিক চাপে আছে। সামগ্রিকভাবে দেশের ৫৯ লাখ ২০ হাজার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থী ন্যূনতম শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ঝরে পড়ার এ চিত্র গ্রামের চেয়ে শহরের বস্তিতে বেশি।

২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত শিক্ষা খরচ বেড়েছে ১২ গুণ, বকেয়া আছে টিউশন ফি এবং নতুন শ্রেণিতে ভর্তি ফি। এ ছাড়া স্কুল খোলা নিয়ে অনিশ্চয়তায়ও ভর্তিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না অভিভাবকরা। অভিভাবকের ৪৬ শতাংশ শিক্ষার ব্যয়ভার, ৪৮ শতাংশ শিক্ষার ঘাটতি এবং ৫৯ শতাংশ শিশুদের পড়াশোনার অনুৎসাহ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও শঙ্কিত। কিন্ডারগার্টেনের চিত্র আরও ভয়াবহ। করোনার কারণে অনেক অভিভাবক চাকরি হারিয়েছেন, পুঁজি হারিয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী অভিভাবক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি থাকলেও অনেকের বেতন কমেছে, গ্রামে ফিরে গেছেন অনেকে। এ অবস্থায় অভিভাবকরা আর্থিক কষ্টে আছেন এবং সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারছেন না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই স্কুলগামী ছেলেশিশুর ৮ ও মেয়েশিশুর ৩ শতাংশ কোনো না কোনো উপার্জন প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়েছে। এ-সত্ত্বেও ৯৫ শতাংশ অভিভাবক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পক্ষে। একই সঙ্গে কোচিংয়ে বা প্রাইভেট টিউশনে যাওয়ার প্রবণতা মাধ্যমিক শিক্ষার্থীর মাঝে ৬১ শতাংশ, যারা দরিদ্র নয় তাদের হার ৭৪ শতাংশ। বিশ্বজুড়ে একই অবস্থা। সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছে, কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে এপ্রিল থেকে বন্ধ থাকায় বিশ্বের প্রায় ১৬০ কোটি গরিব শিক্ষার্থী আর স্কুলে ফিরে যেতে পারবে না, যা বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৯০ শতাংশ। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আবার চালু হলেও অন্তত ৯৭ লাখ শিশুর বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

সেভ আওয়ার এডুকেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারীর কারণে যে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে তাতে আরও ৯ থেকে ১০ কোটি ৭০ লাখ শিশুর শিক্ষায় প্রভাব ফেলবে দরিদ্রতা।

বিশেষজ্ঞদের মতে গত ৫০ বছরেও শিক্ষায় এত বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি বিশ্ব। এসডিজি-ফোর লক্ষ্যমাত্রা (মানসম্পন্ন শিক্ষা) অর্জনের অগ্রগতি নিম্নমুখী হওয়ার উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে এমন ১২ দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে সেভ দ্য চিলড্রেন। সেগুলো হলো আফ্রিকার নাইজার, মালি, শাদ, লাইবেরিয়া, গিনি, মৌরিতানিয়া, নাইজেরিয়া, সেনেগাল ও আইভরি কোস্ট এবং এশিয়ার ইয়েমেন, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। শিক্ষাঙ্গন থেকে ঝরে পড়তে পারে এমন শিশু সবচেয়ে বেশি রয়েছে আফ্রিকা মহাদেশে। এসডিজি-ফোরের লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিটি শিশুর মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা। সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অনেক দেশ যে অগ্রগতি করেছিল, করোনা মহামারী তাকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।

সমস্যা উত্তরণে করোনা সময়ের জন্য প্রতিটি দেশের সরকার ও ঋণদাতাদের শিক্ষাসহায়ক বিশেষ বিনিয়োগ করতে হবে যাতে যত দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুলছে তত দিন অনলাইনে ক্লাস করতে পারে এবং সব শিক্ষার্থী আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরতে সহায়ক হয়। স্কুল হচ্ছে লাখ লাখ শিশু ও তরুণ-তরুণীর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদনের সেরা মাধ্যম, আত্মরক্ষার ঢালও বটে। সহিংসতা, নিপীড়ন ও অন্যান্য কঠিন পরিস্থিতি থেকে শিশুদের রক্ষা করে শ্রেণিকক্ষ। তাই সার্বিক শিক্ষা পুনরুদ্ধারে সুচিন্তিত পরিকল্পনা, বিভিন্ন দেশের দৃষ্টান্ত এবং অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে যথাযথ পরিকল্পনা নিতে হবে। শিশুরা যাতে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যেতে পারে সে সুযোগ নিজ নিজ সরকারগুলোকেই তৈরি করতে হবে।  শুধু করোনা থেকে বেঁচে থাকা নয়, শিশুর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে  বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনতে হবে।

লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ

অধ্যাপক ও পরিচালক, আইআইটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর