শিরোনাম
শনিবার, ১৯ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

নায়ক ফারুক : আমাদের প্রিয় মিয়াভাই

ফরিদুর রেজা সাগর

নায়ক ফারুক : আমাদের প্রিয় মিয়াভাই

আমাদের প্রিয় অভিনেতা ফারুক। সবার প্রিয় মিয়াভাই। একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের তুখোড় অভিনেতা। ফারুক ভাই অসুস্থ হয়ে এখন সিঙ্গাপুরের এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি কিডনি জটিলতায় ভুগছেন। তাঁর শরীরে কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে। ফারুক ভাই খুবই আন্তরিক, উদার ও দিলখোলা মানুষ। সহজেই সবাইকে আপন করে নেন। খোলামেলা কথা বলতে পছন্দ করেন। চলচ্চিত্রে তাঁর অনেক স্মরণীয় মুহুর্ত মনে পড়ে। সুজন সখীর সেই গান- ‘সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা, তোমার বেলা নেব সখী তোমার কানের সোনা।’ বাংলার ঘরে ঘরে এক সময় এই গান গাওয়া হতো। মনে আছে আমার ছোটভাই প্রবাল নামকরা বিতার্কিক ও উপস্থিত বক্তা। প্রবাল এক সময় তার টেলিভিশন বিতর্ক শুরু করত এই গানটি দিয়ে।

সারেং বৌ চলচ্চিত্রটি স্মরণীয় ফারুকের অভিনয়ে। আমরা ভুলে যাই এই ছবির কাহিনি শহীদুল্লাহ কায়সারের। নির্মাতা আবদুল্লাহ আল মামুন। ‘ও রে নীল দরিয়া...’ গানটিতে তাঁর অভিনয় চিরস্থায়ী আসন নিয়েছে। ‘লাঠিয়াল’-এ ফারুকের অভিনয় কেউ কি ভুলতে পারবে?

চ্যানেল আই শুরু হওয়ার পর আমরা ইমপ্রেসের পক্ষ থেকে ফিল্ম বানানো শুরু করলাম। চলচ্চিত্র পাড়ার সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। তখন ফারুক ভাই ফিল্মের বাইরে ব্যবসা নিয়ে খুব ব্যস্ত। এক দিন পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে ফারুক ভাইয়ের কিছু বক্তব্য পড়ে চমকে উঠলাম। তিনি বলেছেন, ইমপ্রেসের কোনো ছবিতে ডাক পাই না। আমাদেরও তো কোনো ছবি বানানোর দায়িত্ব দিতে পারে ইমপ্রেস। ১ কোটি টাকা দিয়ে বলতে পারে, বানাও নিজের মতো করে একটা ভালো ছবি।

তখন আবদুর রহমানকে বললাম, ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ কর। তাঁকে নিয়ে আমরা কাজ করতে চাই। তখন জানলাম ফারুক ভাই ইমপ্রেসের সব খোঁজখবর রাখেন। ইমপ্রেসের ছবি তিনি নিয়মিত দেখেন। তারপর ফারুক ভাই চ্যানেল আইয়ের কার্যক্রমে সাড়া দিয়েছেন। মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ডে অংশ নিয়েছেন। তিনি বিখ্যাত গানে লিপসিং করেছেন। তারকাকথন, সাময়িকী প্রভৃতি অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন।

আমার সঙ্গে ফারুক ভাইয়ের যখনই দেখা হতো আন্তরিকভাবে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হলো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। সেবার ববিতা আর ফারুক ভাই আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন। পুরস্কারের স্মারক হাতে দুজনই পেছনে এসে বসেছেন। আমি তাঁদের পাশে বসে আছি। কোনো কারণে অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ কোনো কাজ আছে। কিন্তু ববিতা ছটফট করতে লাগলেন। তিনি মাইক্রোফোনে কিছু বলতে চান। তাঁর কিছু কথা আছে।

আমি বললাম, ববিতা আপা, আপনি যান না মঞ্চে। আপনাকে কেউ কিছু বলবে না। ববিতা ঠিকই উঠে গিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বললেন, তিনি কিছু বলতে চান। শিল্পীবান্ধব আমাদের প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে ববিতাকে কিছু বলার অনুমতি দিলেন। ববিতার পর নায়ক ফারুকও কিছু বলতে চাইলেন। তাঁকেও সুযোগ দেওয়া হলো। ফারুক ভাই সেই বক্তৃতায় বলেছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক। তাঁর হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু। তিনি সুযোগ পেলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথে রাজনীতি করতে চান।

উপস্থিত দর্শকরা বিপুল করতালি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানালেন। আমার ধারণা বাংলাদেশের মূল স্রোতের রাজনীতি করার ইচ্ছা সেই প্রথম জনসম্মুখে প্রকাশ করলেন। পরের ঘটনা আমরা সবাই জানি। তিনি ঢাকা- ১৭ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন। আমার সঙ্গে অদ্ভুত রকমভাবে ফারুক ভাইয়ের যোগাযোগ হয়ে যায়। বেশ কয়েক বছর আগে আমি সিঙ্গাপুর গেছি কিডনির চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। ডাক্তার খুবই নামকরা। আমাকে দেখে বললেন, তোমাদের দেশের এক বিখ্যাত নায়ক আমার রোগী। খুব ভালো মানুষ সে। আমি যা বলি তা সব সে মেনে চলে।

আর তুমি?

ডাক্তার বললেন, তুমি আমার কোনো কিছু মেনে চল না। কথা শোনো না।

সেই চিকিৎসক ফারুক ভাইকেও একই কথা বলেছিলেন। আরেকটি স্মৃতিমাখা ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালন কমিটিতে ফারুক ভাই আছেন। কাউকে পরোয়া করে তিনি কথা বলতেন না। বলতেন, যাদের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু আছে তাদের বঙ্গবন্ধুর ওপর ভালো ফিল্ম বানাতে হবে। হৃদয় দিয়ে বানাতে হবে। আমাদের হৃদয় আছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভালো কিছু আমরাই করব।

ফারুক ভাই খুব হৃদয়বান মানুষ। ফিল্মপাড়ায় সবাই তাঁকে মিয়াভাই বলে ডাকে। বড় ভাইয়ের মতো আন্তরিক ব্যবহার তাঁর। আলমগীর, ফেরদৌস, রিয়াজ- সবার সঙ্গেই তিনি খোলামেলা। সহজে মেলামেশা করেন। চ্যানেল আইতে এসে আমাদের ক্যান্টিনেও তিনি সবার সঙ্গে বসে দুপুরে খাবার খেয়েছেন। যারা ছবি তুলতে চেয়েছে তাদের সঙ্গে হাসিমুখে ছবি তুলেছেন।

দেখা হলেই বলতেন, সাগর, আমার ডাক্তার তোমার কথা বলেছে, চলো তোমাকে সঙ্গে নিয়ে সিঙ্গাপুর যাই। তোমার কিডনির যত্ন নেওয়া দরকার। আমি তো কিডনি প্রতিস্থাপন করেছি। তুমিও করবা। কোনো অসুবিধা হবে না। বড়ভাই তিনি আমাদের। এক মিটিংয়ে আমরা একসঙ্গে। আমি একটা কমলালেবু খাওয়া শুরু করেছি। ফারুক ভাই নিষেধ করলেন, এই সাগর কিডনি রোগীদের কমলালেবু খেতে নেই। ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে একবার হজে গিয়েছিলাম। সে কী আন্তরিক। বাঙালিদের কাছে এখনো অসম্ভব জনপ্রিয় তিনি। হজে গিয়ে একটা বিপদে পড়েছিলেন। সব বাঙালি তাঁর সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেই ফারুক ভাই এখন সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন। সুস্থ হয়ে তিনি ফিরে আসবেন। ফারুক ভাই ইমপ্রেসের সঙ্গে ছবি তৈরি করতে চেয়েছেন। এবার নিশ্চয়ই ছবি তৈরির কাজ শুরু হবে।

ফারুক ভাই-আপনার কোনো তুলনা নাই।  আপনি এক ও অদ্বিতীয়।

লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চ্যানেল আই।

সর্বশেষ খবর