বুধবার, ৭ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

বীরনিবাস নিয়ে ভয়

আবীর আহাদ

বীরনিবাস নিয়ে ভয়

মুজিববর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের সদ্যনির্মিত বাড়ি বসবাস করার আগেই ভেঙে পড়ছে! এ অবস্থায় গৃহহীনরা এখন ইটের দালানে বসবাসের স্বপ্ন ত্যাগ করে আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ছেন! যেসব আমলা, প্রকৌশলী, ঠিকাদার ও স্থানীয় দলীয় নেতা এ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত তারা ঠিকই তাদের কমিশন ও মুনাফা ষোল আনা বগলদাবা করেছেন, কিন্তু বাড়ি পেয়েও গৃহহীনরা সে বাড়ি ব্যবহার করতে রীতিমতো ভয় পাচ্ছেন- কখন জানি সাধের দালান মাথায় ভেঙে পড়ে অক্কা পেতে হয়। আর ওদিকে সরকারের একটি মানবিক উদ্যোগ তামাশায় পরিণত হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে ভয়ের সঞ্চার করছে: বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারি তত্ত্বাবধানে ‘বীরনিবাস’ তৈরির যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তার ভাগ্যও কি বসবাস করার আগেই ভেঙে পড়ার? গত আর্থিক বছরের গোড়ার দিকে সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্য বিনামূল্যে যে ‘বীরনিবাস’ প্রকল্প অনুমোদন করেছিল, মাঝখানে একটি বছর অতিবাহিত হলেও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অদূরদর্শিতা, অযোগ্যতা ও হীনমন্যতার কারণে কোনো কার্যকারিতা আজ পর্যন্ত আলোর মুখ না দেখায় তা ভেস্তে গেছে। তাই এখন কথা উঠেছে, বিনামূল্যের করুণানির্ভর এবং আমলা, ঠিকাদার ও প্রকৌশলীদের জোড়াতালির বীরনিবাস নয়, প্রত্যেক গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের ভাতা থেকে মাসিক ৫ হাজার টাকা কেটে নেওয়ার শর্তে বিনাসুদে ২৫ লাখ টাকার গৃহঋণ প্রদান করুন। মুক্তিযোদ্ধারা সরকারের বীরনিবাস প্রকল্পের নকশা অনুসরণ করে নিজেরাই বাড়ি নির্মাণ করে নেবেন। এতে যেমন ঘরগুলো টেকসই হবে,  দুর্নীতিও বন্ধ হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা ঋণখেলাপি হবেন না; সরকারি ঋণের অর্থ পর্যায়ক্রমে উঠে আসবে।

না বললেই নয় যে গত বছর ১৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে বাড়ি করে দেওয়া হবে বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীবাহাদুর ঘোষণা দেওয়ার পর উপজেলায় উপজেলায় যে বাণিজ্যিক ধান্দা শুরু হয়েছিল, তা-ও ছিল মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কর্মকান্ডের মতোই মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নির্মম এক তামাশা! দেশের সিংহভাগ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বলা চলে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ অবস্থায় ১৪-১৫ হাজার তথাকথিত বীরনিবাস কারা কীভাবে কখন পাবেন তা আমাদের কাছে একেবারেই বোধগম্য নয়। তা ছাড়া এ বিরাটসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে পর্যায়ক্রমে বাড়ি করে দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হলে সেজন্য কতটি বছর অতিবাহিত হবে এবং তত দিন মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে থাকবেন কি না তা কি কেউ বলতে পারবেন? এ ছাড়া প্রতি উপজেলায় প্রকৃতই গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি খরচে নির্মিত বাড়ি পাবেন তারও কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, উপজেলা পর্যায়ে একশ্রেণির প্রতারক স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশে পর্দার আড়ালে সর্বোচ্চ ঘুষদাতা মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অগ্রিমও গ্রহণ করেছে! এ প্রক্রিয়ায় আর্থিক প্রতিযোগিতায় কোনো প্রকৃতই গৃহহীন দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা নয়, বাড়িগুলো পাবে টাকাওয়ালা ও রাজনৈতিক যোগাযোগের অবস্থাসম্পন্ন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা। ইতিমধ্যে বিভিন্ন উপজেলা থেকে তথাকথিত সরকারি বীরনিবাস প্রাপকের যে তালিকা সুপারিশ আকারে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল তার মধ্যে উপরোক্ত আশঙ্কার সত্যতা পাওয়া গেছে। তাই সরকারের কাছে নিবেদন- বিনামূল্যের বীরনিবাস প্রকল্প বাদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গৃহঋণের অর্থ বরাদ্দ করুন।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী মহোদয় এ পর্যন্ত যতসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার কী পরিমাণ বাস্তবায়ন ঘটেছে তা তিনি না জানলেও আমরা জানি। খুবই বেদনাদায়ক যে প্রতিটি বক্তব্য ফাঁপা বুলিতে পরিণত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ত্যাগ ও বীরত্বে দেশটি স্বাধীন হয়েছে বলেই যিনি জীবনে যা কল্পনাও করেননি তিনি তা-ই হয়েছেন, হচ্ছেন এবং হতেই থাকবেন। অতএব জাতীয় দায়িত্ববোধ থেকেই সরকারকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে ভুয়াদের উচ্ছেদ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে; সামাজিক নিরাপত্তাসহ ন্যূনতম আর্থসামাজিক উন্নত জীবনব্যবস্থা নিশ্চিত করে তাদের জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে। এ ছাড়া দ্রুততম সময়ের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের বেকার সন্তানদের বিশেষ নিয়োগের মাধ্যমে সরকারি চাকরি প্রদানসহ বাজারমূল্যের সঙ্গে সংগতি রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী বর্তমানের বাজার পরিস্থিতির আলোকে বৃদ্ধিসহ প্রত্যেক গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের ভাতা থেকে মাসিক ৫ হাজার টাকা কেটে নেওয়ার শর্তে এককালীন সুদবিহীন ২৫ লাখ টাকার গৃহঋণ প্রদান করুন। যা করার তা মুক্তিযোদ্ধাদের জীবদ্দশাতেই করতে হবে। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা পৃথিবীতে আর কদিনই বা বাঁচবেন!

আরেকটা কথা। ১৪-১৫ হাজার বাড়ি বরাদ্দকে কেন্দ্র করে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে টানাপোড়েনের মাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গে রেষারেষির সৃষ্টি হয়েছে। কারণ সব মুক্তিযোদ্ধাই তো এ সুযোগ পাওয়ার সমান অধিকারী। সবাই মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিতে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছোট বা বড় মুক্তিযোদ্ধা বলতে কিছু নেই। সবাই মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি দিতে হলে সবাইকে একযোগে একসময়েই দেওয়া অবশ্যক। অন্যথায় সবাইকে গৃহঋণের আওতায় ছেড়ে দিন। যার প্রয়োজন তিনি ঋণ নেবেন, যার প্রয়োজন নেই তিনি নেবেন না। এতে সবারই সান্ত¡না মিলবে। অন্যদিকে এ ঋণের বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ঋণখেলাপিও হবেন না। কারণ তারা ঋণ নেবেন তাদের ভাতার বিপরীতে, যে ভাতাটি সরকারেরই হাতের মুঠোয়, ভাতাটিই তাদের ঋণের নিরাপত্তা, কো-লেটারাল সিকিউরিটি হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং সরকারের কাছে আমার আবেদন- মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি না করে, তাদের মনে ব্যথা না দিয়ে অবিলম্বে বিনামূল্যের বীরনিবাস প্রকল্প বাদ দিয়ে বীরনিবাস নির্মাণের নকশা অনুসরণ সাপেক্ষে সবার জন্য গৃহঋণের সুব্যবস্থা গ্রহণ করুন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় বীরনিবাস প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সম্প্রতি নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের মতো দশা হবে। কারণ যে যে কর্তৃপক্ষ গৃহহীন আশ্রয়ণ প্রকল্পের জরাজীর্ণ বাড়ি নির্মাণ করেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরনিবাস তাদের হাত দিয়েই নির্মিত হবে। আশা করি সরকার বাস্তবতার আলোকে সরকারি তত্ত্বাবধানে বীরনিবাস প্রকল্প বাদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের তত্ত্বাবধানে বাড়ি নির্মাণের দায়িত্ব তাদের ওপর ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। সে ক্ষেত্রে তাদের নকশা অনুসরণ করে বীরনিবাস নির্মিত হচ্ছে কি না সে ব্যাপারে অবশ্যই সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদারক ও দেখভাল করবেন তাতে কোনো মুক্তিযোদ্ধারই আপত্তি থাকবে না।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর