সোমবার, ১৯ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

মনের পশুত্বকেও জবেহ করতে হবে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

মনের পশুত্বকেও জবেহ করতে হবে

আর কদিন পরই বিশ্ব মুসলমান একযোগে মেতে ওঠবে ত্যাগের উৎসবে। কোরবানির আনন্দে। অবশ্য এখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে গরু কেনা, হাট-বাজারে দৌড়ঝাঁপসহ নানান প্রস্তুতি। আমরা যে কোরবানি করছি, পশুর গলায় ছুড়ি বসিয়ে রক্ত ঝরাচ্ছি, কেন করছি বলুন তো? অনেকেই বলবেন, আল্লাহর হুকুম পালন করে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য। কিন্তু আল্লাহতায়ালা কি আমাদের এ কোরবানি দেখে খুশি হচ্ছেন? পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলছেন, ‘লান ইয়ানালাল্লাহা লুহুমুহা ওয়ালা দিমাউহা ওয়ালাকিয়্যানা লুহুত্তাকওয়া মিনকুম। আমার আদরের বান্দারা শোন! তোমরা যে এত দৌড়ঝাঁপ করে পশুর রক্ত ঝরাচ্ছ আমার কাছে কিন্তু এ রক্ত-মাংস কিছুই পৌঁছে না। পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া’ (সুরা হাজ : ৩৭)।

কোরবানি এমন একটি ইবাদত, যেখানে খুব সহজেই রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছার সুযোগ আছে। মানুষকে দেখিয়ে গরু কিনতে হয়। পশুর গলায় ছুড়ি চালানোর সময়ও মানুষ থেকে আড়াল হওয়ার সুযোগ নেই। আবার সেই পশুর গোস্ত দান করার সময় সবাইকে দেখিয়ে দান করতে হয়। এই যে, সবাইকে দেখানোর এত আয়োজন, এর মধ্যেই আসল পরীক্ষা। আমি যখন মানুষকে দেখিয়ে কোরবানি করছি, গোস্ত বণ্টন করছি, তখন কিন্তু আল্লাহতায়ালা আমার অন্তরের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করছেন, বান্দার মন কোনদিকে ঘুরছে? বান্দা কি মানুষকে দেখানোর জন্য কোরবানি করছে নাকি তার মন আমার দিকে স্থির রেখেছে? দয়াময় প্রভু আমাদের কাজ কিংবা বাহ্যিক কিছু দেখেন না। তিনি তাকিয়ে থাকেন আমাদের অন্তরের দিকে। আমরা যখন কোনো কাজ করি তখন তা কার উদ্দেশ্যে, কী নিয়তে করছি, তিনি তা পর্যবেক্ষণ করেন।’

খুব দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়, কোরবানি এলে আমাদের সমাজে এক ধরনের ঘৃণ্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। কে কত বড় পশুর রক্ত ঝরাতে পারবে, কার গরুতে কত বেশি গোস্ত হয়েছে, গরু কিনে ঠগ হলো না জিত হলো- এসব আমাদের নিত্যচর্চার বিষয় হয়ে ওঠে। আমার প্রতিবেশী থেকে কম দামের গরু কোরবানি দিলে আমরা নিজেদের জন্য অপমান মনে করি। আবার পরিচিত কারও থেকে বেশি দামের পশু কিনতে পারলে গর্ববোধ করি। এক কথায় বলতে গেলে, আমাদের কোরবানিতে তাকওয়ার চেয়ে লোক দেখানোর প্রবণতাই থাকে বেশি। সুরা মাউনে আমাদের সম্পর্কেই আল্লাহ বলেছেন, ‘ফাওয়াইলুল্লিল মুসাল্লিন। আল্লাজিনাহুম আনসালাতিহিম সাহুন।’ ধ্বংস ওইসব লোক দেখানো ইবাদতগোজার মানুষগুলোর জন্য। যারা ইবাদত করে অন্য মানুষকে দেখিয়ে দেখিয়ে।’

রসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহতায়ালা বান্দার কোরবানি কবুল করে নেন। আর কিয়ামতের দিন এই পশুর পিঠে চড়েই বান্দা পুলসিরাত পার হবে।’

প্রিয় পাঠক! কোরবানি শুধু পশুর গলায় ছুরি চালানোই নয়, নফসের ঘাড়েও ছুরি চালাতে হবে। মহান আল্লাহর হুকুমের কাছে বিনা প্রশ্নে নিজ গর্দান নিচু করে দেওয়ার নামই কোরবানি। নিজের নফসকে যদি আল্লাহর ইচ্ছার সামনে কোরবানি করতে না পারি তবে শত পশুর গলায় ছুড়ি চালালেও কোনো লাভ হবে না। আমাদের অবশ্যই কোরবানির মূল শিক্ষা ও উদ্দেশ্যকে সামনে রাখতে হবে। তবেই আমাদের কোরবানি প্রকৃত কোরবানি হবে। যে কোরবানি করেছিলেন সাইয়্যেদেনা ইবরাহিম (আ.)। তিনি বলেছিলেন, ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহয়ায়া ও মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। অর্থ- আমার সব ভালো কাজ এবং ভালোর পথে চলতে গিয়ে যত ত্যাগ তিতিক্ষা অত্যাচার নির্যাতন সব আমার আল্লাহর জন্য। আমার পুরো জীবনই আল্লাহর জন্য এবং মৃত্যুও তাঁর জন্যই। যার ওপর জাকাত ফরজ তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব, তবে জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য ব্যক্তির কাছে সম্পদ এক বছর অতিবাহিত হতে হবে। কিন্তু কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য সম্পদ এক বছর অতিবাহিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কোরবানি করবে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে’ (মুসনাদে আহমদ)। উট, গরু, মহিষ, দুম্বা, ভেড়া, ছাগল এ ছয় প্রকার পশু দ্বারা কোরবানি করতে হবে। এর বাইরে অন্য কোনো হালাল পশু দ্বারা কোরবানি করলেও তা আদায় হবে না। (হেদায়া ৪/৩৮১)। খোঁড়া-যার খোঁড়ামি স্পষ্ট, কানা-যার অন্ধত্ব স্পষ্ট, রোগা-যার রোগ স্পষ্ট এবং দুর্বল-যার হাড়ে মজ্জানেই এসব পশু কোরবানি করা জায়েজ নয়। (তিরমিজি, আবু দাউদ)। উট পাঁচ বছর, গরু ও মহিষ দুই বছর, ভেড়া, দুম্বা ও ছাগলের বয়স এক বছর হতে হবে। তবে ছয় মাসের ভেড়া ও দুম্বা যদি এক বছর বয়সীর মতো দেখতে মোটাতাজা হয় তা দিয়ে কোরবানি করা যাবে। কিন্তু ছাগল যতই মোটাতাজা হোক না কেন তার বয়স এক বছর পূর্ণ হওয়া জরুরি। আল্লাহ আমাদের তার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোরবানি করার তাওফিক দান করুন। আমিন

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাস্সির সোসাইটি।

সর্বশেষ খবর