শনিবার, ৩১ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

ড্রাগন চাষে প্রযুক্তিচর্চা

শাইখ সিরাজ

ড্রাগন চাষে প্রযুক্তিচর্চা

২১ ফেব্রুয়ারির কথা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে নাটোর ফেরার পথে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সড়কের পাশে বিশাল এক ড্রাগন বাগান চোখে পড়ল। জায়গাটি গোদাগাড়ী উপজেলার বসন্তপুর। তখন বিকালের সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় চকচক করছিল ড্রাগন বাগানের একটি অংশে লাগানো এলইডি বাতি। মনে পড়ে গেল ২০১৮ সালের চীনের শিনশিং কাউন্টির লির বাগানের কথা। তখন অক্টোবরের শেষ দিক। আমরা গিয়েছিলাম এক চীনা দম্পতির আরএএস পদ্ধতিতে মাছ চাষের খামার দেখতে। তখনো খামার চালু হয়নি। ঠিক কোন জায়গাটিতে খামার হবে তা-ই দেখতে যাওয়া। এর আগে হন্যে হয়ে চীনের প্রত্যন্ত গ্রাম খুঁজেছি। পুরো চীনই যেন শহর হয়ে গেছে। আধুনিক যন্ত্র দিয়ে চাষাবাদ। শহরের সব সুযোগ-সুবিধা এখন গ্রামে আছে। ফলে গ্রামকে আর গ্রাম মনে হয় না। শিনশিং কাউন্টিতে গিয়ে মনে হলো একটু গ্রামের আবেশ আছে। চীনের তরুণরা আর সনাতন কৃষিতে নেই। বৃদ্ধ কয়েকজন যাদের রক্তে সনাতন কৃষির চর্চা রয়ে গেছে তারা কেউ কেউ অভ্যাসের বশেই যেন শাকসবজি চাষ করছেন, এমন কয়েকজন কৃষকের দেখা পেয়েছিলাম। একজনকে দেখলাম সেই পুরনো দিনের মতো পালংশাকের খেতের পাশে রেডিও রেখে গান শুনতে শুনতে কাজ করছেন। বয়স সত্তর-পঁচাত্তর হবে। দোভাষীর সাহায্যে কথা বলে যা বুঝেছিলাম সময় কাটানোর জন্য এবং কর্মক্ষম থাকার চেষ্টা থেকেই তিনি কৃষিচর্চা করছেন। তখন ফেরার পালা। গাড়িতে চড়ে ফিরছিলাম সূর্য তখন বেশ খানিকটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে। আমরা একটা মাটির পথ ধরে এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল দূরে একটা খেতে শয়ে শয়ে সাদা সাদা কী যেন ঝুলছে। এগোলেই বুঝতে পারলাম ড্রাগন ফলের বাগান। সঙ্গে ছিল আমার দুই সহকর্মী আদিত্য শাহীন ও তানভীর আশিক। আমি ওদের প্রশ্ন করলাম, দেখে কী মনে হয়? ড্রাগনের বাগানে সাদা সাদা কী ঝুলছে? ওরা অনুমাননির্ভর উত্তর দিল, বোধহয় নতুন কোনো প্রযুক্তি। নতুন প্রযুক্তি তো বটেই। কিন্তু প্রযুক্তিটা কী? দেখার ও জানার ইচ্ছা দমন করতে পারলাম না। গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়লাম ড্রাগন বাগানে। দেখতে পেলাম সাদা সাদা ঝুলন্ত এলইডি বাতি। আর জানতে পারলাম এ এলইডি বাতির মাধ্যমে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে দিয়ে অমৌসুমেও ড্রাগন ফল ফলানো সম্ভব হচ্ছে।

গোদাগাড়ীর বসন্তপুরের ড্রাগন বাগানটিতে গিয়ে আমার সেদিনের স্মৃতি মনে পড়ছিল। টেলিভিশনে চীনের ওই প্রতিবেদনটি প্রচারের পর অনেক ড্রাগন বাগান উদ্যোক্তাই এলইডি বাতি ব্যবহার করে অমৌসুমে ড্রাগন চাষের চেষ্টা করেছেন। তাদের অনেকেই সফল হয়েছেন। চট্টগ্রামের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম হারুনর রশীদ আমাকে গত বছর জানিয়েছিলেন তিনি এলইডি বাতি ব্যবহার করে অমৌসুমে ড্রাগন ফল ফলাতে সচেষ্ট হয়েছেন। পাঠক, আপনাদের হয়তো মনে আছে সাভারের এক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে এলইডি লাইট ব্যবহার করে ড্রাগন ফল চাষের প্রতিবেদন তুলে ধরেছিলাম। আবার কিছুদিন আগেই নাটোরের এক উদ্যোক্তা রবিউল করিম দাবি করেছেন এলইডি বাতির ব্যবহার ছাড়াই সুষ্ঠু বাগান ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই সারা বছর ড্রাগন ফল ফলানো সম্ভব। তার দাবিটি সত্যি কি না দেখার অপেক্ষায় আছি।

দেশে এখন বছরব্যাপী রকমারি ফলফসলের উৎপাদন বাড়ছে। গত এক দশকে আম ও পেয়ারার উৎপাদন দ্বিগুণ, পেঁপে আড়াই গুণ এবং লিচু উৎপাদন ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর গত চার-পাঁচ বছরের মধ্যে নতুন যেসব ফলের উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়ছে তার অন্যতম হলো ড্রাগন। চাষের জমির দিক থেকে সবচেয়ে বেশি জমিতে কলা চাষ বাড়লেও দ্রুত হারে পুষ্টিকর ফলের হিসাবে ড্রাগনই এগিয়ে। গোটা দেশই কৃষক এখন প্রচলিত কৃষি থেকে অনেকটাই সরে আসছে। অপ্রচলিত ও উচ্চমূল্যের ফলফসল উৎপাদনে ঝুঁকছে কৃষক। এ জাগরণে ড্রাগনই উদ্যোক্তাদের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবমতে ২০১৪-১৫ সালে দেশে ড্রাগন চাষ হয়েছিল মাত্র ৫ হেক্টর জমিতে। ২০১৯-২০ সালে ছিল ৩৪১ হেক্টর। চলতি মৌসুম অর্থাৎ ২০২০-২১ বছরে এসে যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০০ হেক্টরে। যা হোক, নানান উদ্যোক্তা নানাভাবেই ড্রাগন ফল চাষ নিয়ে নানামুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন যাতে কীভাবে কম খরচে অধিক উৎপাদন করা যায়। তারই প্রমাণ পেলাম বসন্তপুরের ড্রাগন বাগানটিতে। বাগানের উদ্যোক্তা হেলাল হেদায়েতুল ইসলাম নিজেকে একজন নিবেদিতপ্রাণ কৃষক দাবি করে জানিয়েছেন জীবনের প্রয়োজনে নানা ক্ষেত্রে চাকরি করলেও শেষমেশ মাটির কাছাকাছি থাকার তাগিদে আর নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের ইচ্ছায় কৃষির এ বাণিজ্যিক উৎকর্ষে যুক্ত হয়েছেন। গড়েছেন ৫০ বিঘার সুবিশাল কৃষি খামার। এর মধ্যে ড্রাগন চাষ হচ্ছে ১৫ বিঘায়। ইট-সিমেন্টের খুঁটি, বাঁশের খুঁটি দিয়ে লম্বাকার অর্থাৎ আড়াআড়ি সারি, আবার আলদা খুঁটি স্থাপনসহ বিভিন্ন উপায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে ড্রাগন চাষের। উদ্দেশ্য, কম খরচে অধিক উৎপাদন।

হেলালের পুরো ড্রাগন বাগানটিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগে চাষ হচ্ছে খুঁটিতে টায়ার বেঁধে। খুঁটি ঘিরে চারটি করে ড্রাগন ফলের গাছ। আর এক ভাগে যেমনটি আমরা দেখিয়েছিলাম চীনের শিনশিং কাউন্টির লির বাগানের প্রতিবেদনটিতে দুই প্রান্তে খুঁটি দিয়ে জিআই তারের লম্বা ফ্রেম তৈরি করে, ফ্রেমের ওপর সারি বেঁধে ড্রাগন ফলের গাছ তুলে দিয়েছিল। হেলালও তার বাগানের একটি অংশে এভাবে গাছ লাগিয়েছেন। আর একটি অংশে এলইডি বাতি দিয়ে অমৌসুমে ড্রাগন ফল চাষের প্রচেষ্টা।

কথা বলে বোঝা গেল হেলাল বেশ জেনে-বুঝেই ড্রাগন ফলের চাষ শুরু করেছেন। ড্রাগন ফলের চাষ সম্পর্কে জানতে ঘুরে এসেছেন চীনও। তাই প্রযুক্তির ব্যবহারেও তিনি বেশ কৌশলী। বলছিলেন, ‘এ অঞ্চলের পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে দিন দিন। ১ বিঘা জমিতে ধান চাষ করতে ২২ থেকে ২৫ লাখ লিটার পানির প্রয়োজন। তাই আমি পানি বাঁচাতে এবং আমদানি কমাতে ড্রাগন ফল চাষকে প্রাধান্য দিচ্ছি।’ দেখলাম ড্রাগন গাছের গোড়ায় সঠিক পরিমাণে পানি পৌঁছাতে ব্যবহার করেছেন ডিপ ওয়াটার পদ্ধতি। আবার আগাছা দমনে ব্যবহার করছেন উইড ম্যাট বা উইড ব্যারিয়ার। তিনি বলছেন, উইড ম্যাট ব্যবহার করে তিনি চারটি উপকার পাচ্ছেন। ১. আগাছা দমনে খরচ কমেছে। ২. জৈবসারের অপচয় রোধ হচ্ছে। ৩. মাটির আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে। ৪. সেচ কম লাগছে। তিনি স্বচ্ছ উইড ম্যাটের সন্ধান করছেন। স্থানীয় উৎপাদকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এটি হলে ড্রাগন গাছের জন্য বেশ উপকার হবে বলে জানিয়েছেন হেলাল। এতে আলোর প্রতিফলনে গাছের নিচের অংশও আলো পাবে।

গত ফেব্রুয়ারিতে হেলালের বাগানটির বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর। সে সময়টা ড্রাগন ফলের মৌসুম নয়। তার আগের মৌসুমে মাত্র ৪ বিঘা জমিতে ড্রাগনের ফলন হয়েছিল। সে মৌসুমে ড্রাগনের উৎপাদন ছিল ১৪ টনের মতো। হেলাল এতেই দারুণ আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সঠিক পদ্ধতির মাধ্যমে ৫০ বিঘায় ড্রাগন আবাদ করে নিঃসন্দেহে ভালো ফলের আশা করছেন তিনি। বলছেন, মৌসুমে প্রতি একরে ৯ টন ড্রাগন ফলানো খুব কঠিন কিছু নয়। কিন্তু তার চেষ্টা অমৌসুমে ড্রাগন ফলানো। কারণ অমৌসুমের ফলনে লাভ বেশি। আর তাই এলইডি বাতি জ্বালিয়ে দিনের পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। কিছুটা সফলও হয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে সাধারণত ড্রাগন ফলের গাছে কুঁড়ি থাকার কথা নয়। কিন্তু তিনি এলইডি বাতি জ্বালিয়ে ঠিকই গাছে কুঁড়ি ধরিয়েছেন।

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ফল উৎপাদন কৌশল রপ্ত করে তাকে দেশি ব্যবস্থায় রূপান্তর এবং দেশের মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী করে অধিক ফলন নিশ্চিত করার ব্যাপারে আগ্রহী হেলাল। ড্রাগনের উৎপাদনেও নানা কৌশলের অনুশীলন করছেন তিনি। বলছেন, ট্রায়াল অ্যান্ড এরর মেথডে তিনি প্রতিনিয়ত শিখছেন।

হেলাল হেদায়েতুল ইসলাম কৃষি নিয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। স্বপ্নও দেখছেন বহু দূরের। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। ড্রাগন খেতের ১৩টি সারির ওপর এলইডি লাইট জ্বলে উঠল। যেন চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল নতুন দিনের আলো।

আমাদের কৃষি উৎপাদন দারুণ গতিশীল হয়ে উঠছে দেশের তরুণ প্রগতিশীল উদ্যমী কৃষকের হাত দিয়ে। হেলাল তাদেরই একজন। যারা কৃষি নিয়ে যে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে যথেষ্ট সাহস সংরক্ষণ করেন। অল্প জমিতে বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করতে কখনো তারা জাত নিয়ে পরীক্ষা করছেন, কখনো প্রযুক্তি নিয়ে, কখনোবা পরিচর্যা নিয়ে। কৃষিতে নিবেদিতপ্রাণ এ উদ্যোক্তারাই আমাদের সামনে আত্মবিশ্বাস ও স্বপ্ন রচনা করছেন।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর