বৃহস্পতিবার, ১২ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

ছোট ছোট দুঃখকথা

তসলিমা নাসরিন

ছোট ছোট দুঃখকথা

জাপানের ট্রেনে উঠে ছুরি হাতে নিয়ে এক জাপানি লোক গতকাল কোপাতে শুরু করেছে মেয়েদের। দশজন আহত। কেন এই কাজ করেছে সে? লোকটি বলেছে সে সুখী মেয়েদের মেরে ফেলতে চাইছে। মেয়েদের হাসি খুশি সুখী মুখ তার কাছে অসহ্য। লোকটি কি মানসিকভাবে অসুস্থ? না, লোকটি স্রেফ নারীবিদ্বেষী।

মানসিক অসুস্থতা থাকলে কেউ এভাবে বেছে বেছে মেয়েদের খুন করতে নামে না। বাই দ্য ওয়ে, মানসিকভাবে যারা সুস্থ, তারা মানসিকভাবে যারা অসুস্থ, তাদের চেয়ে বেশি খুন করে, খুন করে প্ল্যান করে, ঠান্ডা মাথায়।

নারীবিদ্বেষী লোকদের এভাবে মেয়েদের খুন করা নতুন কিছু নয়। মন্ট্রিয়ালের পলিটেকনিক ইস্কুলে ঢুকে, ১৯৮৯ সালের ৬ ডিসেম্বরে, ১৪টি ছাত্রীকে গুলি করে মেরে ফেলেছিল এক লোক, মেরে নিজেও মরেছিল। সুইসাইড নোটে লিখেছিল- মেয়ে জাতটাকে সে ভীষণ ঘৃণা করে।

প্রায়ই এরকম কিছু লোক বন্দুক হাতে পিস্তল হাতে ছুরি হাতে বেরিয়ে পড়ে। মেয়েদের খুন করবে। রাস্তা ঘাটে অফিস আদালতে যে মেয়েকেই দেখবে খুন করবে। এলিওট রজার নামের এক লোক মেয়েরা তাকে পছন্দ করে না বলে দুনিয়ার তাবৎ মেয়েকে খুন করার জন্য প্ল্যান করে বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে গুলি ছুড়েছিল মেয়েদের দিকে! যতগুলো সম্ভব খুন করেছিল। অ্যালেক মিনাসিয়ান নামের লোকও তাই করেছে। এগুলো মাস কিলিং। বাদই যদি দিই এসব, অহরহই যেটা হচ্ছে, সেটা হলো মেয়েদের ধর্ষণ করছে পুরুষেরা, করে মেরে ফেলছে। হয় বাস থেকে ফেলে দিচ্ছে, ট্রেন থেকে ফেলে দিচ্ছে। নয় মেরে টুকরো টুকরো করে কেটে নর্দমায় ছুড়ে দিচ্ছে। পাহাড় থেকে খাদে ছুড়ে দিচ্ছে। পেছনে একটিই কারণ, নারীবিদ্বেষ। সুপ্ত নারীবিদ্বেষ যাদের, যাদের আমরা ভদ্রলোক বলি, তাদের দ্বারা তো বেষ্টিতই থাকি আমরা।

এরা কেউই, অন্তত আমি মনে করি না, মানসিক রোগী। এরা জাস্ট মিসোজেনিস্ট। মেয়েদের ঘৃণা করে। কেউ ঘৃণাটা প্রকাশ করে তীব্রভাবে, কেউ নরমভাবে, কেউ ভিতরে রেখে দেয়, প্রকাশ করে না। তবে সময় সুযোগ পেলেই করে।

বোল্ড শব্দটা এ দেশে দেখলাম উলঙ্গ বা অর্ধ উলঙ্গ মেয়ে বা অনেকটা স্তন দেখা যাওয়া মেয়েদের বেলায় ব্যবহার করা হয়। অবশ্য সেই মেয়েদের সিনেমা থিয়েটার মিউজিক ইত্যাদির অর্থাৎ শোবিজের মেয়ে হতে হবে, অথবা ফ্যাশন-সচেতন উচ্চবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির মেয়ে হতে হবে। হ্যাঁ মেয়ে হতে হবে, ছেলে হলে হবে না। শার্ট খুলে সিক্স প্যাক দেখালেও হবে না। অবশ্য সব মেয়ের শরীর দেখা গেলেই বোল্ড বলা হয় না। রাস্তার দরিদ্র ভিখিরি মেয়েদের হাড্ডিসার শরীর উন্মুক্ত হয়ে থাকলে কেউ তাকে বোল্ড বলবে না।

বোল্ড শব্দটার মিসইউজ দেখলে খারাপ লাগে। স্তন দেখাতে সাহস লাগে নাকি? যত তার স্তন দেখা যাবে, তত তার শোবিজের বাজার রমরমা হবে। এতে সাহসের চেয়ে বেশি আছে বাণিজ্য-কৌশল।

বোল্ড তো আসলে তাদের কাজ যারা সত্যিকার সাহসী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা এমন কাজ করে, যে কাজ করলে মুন্ডুটা কাটা পড়বে, অথবা জীবনযাপনে বিস্তর সমস্যা হবে। আমি কাদের কাজকে বোল্ড বলি, তার দু’একটা উদাহরণ দিচ্ছি। যারা ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন বর্ণের, ভিন্ন জাতের কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করে এবং সমাজের বাধা সত্ত্বেও নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে; যে সমকামীরা, রূপান্তরকামীরা ঘোষণা দিয়ে ক্লোজেট থেকে বেরিয়ে আসে; যে মেয়েরা স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে একা থাকে; যারা ধর্মান্ধ কট্টরপন্থি আর উগ্রবাদী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একা যুদ্ধ করে; স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়; ...।

দুঃখ এই, তাঁদের কাজকে আমাদের আঁতেল এবং মিডিয়া গোষ্ঠী বোল্ড বলার বদলে বলে ‘বিতর্কিত’।

বেশ্যা শব্দটির মানে কী?

দরিদ্র নিপীড়িত মেয়ে, পুরুষ দ্বারা প্রতারিত হয়ে সমাজ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে, নানা জাতের নানা বয়সের নানা মেজাজের অচেনা অজানা পুরুষদের কাছে দেহ বিক্রি করে দু’পয়সা রোজগার করতে যারা বাধ্য হয়, তাদেরই বেশ্যা বলা হয়।

কোনও মেয়ে বেশ্যা হয় না, পুরুষেরা তাদের বেশ্যা বানায়। তাই সভ্য মানুষেরা এই মেয়েদের ‘প্রস্টিটিউট’ বলে না, বলে ‘প্রস্টিটিউটেড উইমেন’।

এই সংজ্ঞাটি শোনার পর এক পাল নারীপুরুষ খেঁকিয়ে উঠে বলবে কলেজ ছাত্রীরা বাড়তি টাকার জন্য দেহ বিক্রি করে। আমি জানি সে কথা, কিন্তু সংজ্ঞাটি লক্ষ কোটি মেয়ের কথা ভেবে তৈরি করা, তুলনায় অতি সামান্য সংখ্যক মেয়ের কথা ভেবে নয়।

বাংলাদেশের পুরুষেরা, আশির দশক থেকে লক্ষ্য করেছি, এই সংজ্ঞার বাইরে গিয়ে মেয়েদের বেশ্যা বলে। আমি যখন পুরুষতন্ত্রের সমালোচনা করে লেখা শুরু করেছি, আমাকে পাল পাল পুরুষেরা ‘বেশ্যা’ বলে গালি দিয়েছে। শুধু ধর্মান্ধ অশিক্ষিত মৌলবাদীরা নয়, শিক্ষিত শ্রেণি যাদের বলি, তারাও। এখন প্রশ্ন হলো, আমি কি দেহ ব্যবসা করে টাকা উপার্জন করতাম? না, আমি ছিলাম ঢাকা শহরের স্বনামধন্য দুটো মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল- মিটফোর্ড এবং ঢাকা মেডিকেলের সম্মানিত ডাক্তার। আমি ছিলাম জনপ্রিয় সাহিত্যিক। আমার কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস ছিল বেস্ট সেলার লিস্টে। প্রকাশকেরা আমাকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা অগ্রিম রয়্যালটি দিত। আমি যদি মেয়ে না হয়ে পুরুষ হতাম, তাহলে বেশ্যা বলে গালি দেওয়া পুরুষেরা আমাকে নমো নমো করতো। তসবিহ হাতে নিয়ে জপতো আমার নাম।

বেশ্যার সংজ্ঞায় না পড়লেও আমাকে বেশ্যা বলে কেন ডাকা হয়েছে এবং আজও কেন হয়? আমি যে পুরুষদের সঙ্গে শুয়েছি, তাদের কাছ থেকে কি কানাকড়ি নিয়েছি? না, বরং তাদের পেছনে আমার যথেষ্ট টাকা খরচ হয়েছে। তাহলে ওই পুরুষদের বেশ্যা বলে না ডেকে আমাকে কেন ডাকা হয়? ডাকা হয় কারণ আমি আমার বইগুলোতে সত্য কথা বলেছি, কাউকে তোয়াক্কা না করে বলেছি, কারণ আমি সত্যবাদী এবং সাহসী। আমার এই সততা, সাহস এবং আত্মসম্মানবোধ বিবেকবুদ্ধিহীন বর্জ্যদের সহ্য হয় না বলে বেশ্যা বলে গালি দেয়।

বাংলাদেশে বেশ্যা বলে যে মেয়েদের ডাকা হয়, তাদের সম্পর্কে আমার উচ্চ ধারণা। বেশ্যা বলা হলে আমি বুঝে যাই এই মেয়েগুলো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা মেয়ে, নষ্ট পচা সমাজে সাহসী, স্বনির্ভর, মাথা উঁচু করে চলা মেয়ে। যাদের ভালো মেয়ে বলে ডাকা হয়, তাদের সম্পর্কে আমার ধারণা, এরা পচা পুরুষতন্ত্রের ধারক এবং বাহক, এরাও প্রগতির বিরুদ্ধে, এদের মস্তিষ্কে কিছু নেই, এদের চরিত্র বলেও কিছু নেই।

আমি কাঁদলে লোকে বলে, কাঁদা নাকি আমাকে মানায় না। কেন মানায় না? আমি স্ট্রং, তাই। স্ট্রং হলে দুঃখে কষ্টে কাঁদতে নেই, এই ধারণা থেকেই মানুষ পুরুষলোক কাঁদছে এই দৃশ্য দেখতে চায় না। ছিঃ ছিঃ, পুরুষ হয়ে মেয়েদের মতো কাঁদছে কেন! স্ট্রং মেয়েরা, জীবনে যা কিছুই ঘটুক, কাঁদবে না। কাঁদলে তাকে আর স্ট্রং মনে হয় না। আর পুরুষ মাত্রই, যেহেতু বিশ্বাস করা হয়, সবাই স্ট্রং, তাই কোনও পুরুষ কাঁদলে তাকে আর ‘পুরুষ’ বলে মনে হয় না। কাঁদাটা কাদের জন্য? নরম কোমল সেন্সিটিভ মেয়েদের জন্য। দুঃখে কষ্টে যন্ত্রণায় বেদনায় কোমল এবং কঠিন মানুষ কাঁদে, লিঙ্গ নির্বিশেষে কাঁদে, কাঁদাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের সমাজে ছোটবেলা থেকেই ছেলেরা না কাঁদতে শেখে। বাবা-মারা শেখায়। ছেলে হয়ে জন্ম নিলে নাকি কাঁদতে হয় না।

যারা কাঁদে না, তাদের আমার খুব ভয়ংকর মানুষ বলে মনে হয়। আবেগ কি পুরুষের নেই? নিশ্চয়ই আছে। যে আবেগ থেকে রাগ ঘৃণা প্রতিশোধস্পৃহা, হাসি খুশি আনন্দ ইত্যাদি উৎকটভাবে প্রকাশিত হয়, সে আবেগ থেকেই তো মানবিক ক্রন্দন উঠে আসার কথা।

অন্যের জন্য কাঁদার মতো সুন্দর কী আছে জগতে! আমার মা যখন মারা গেল, লক্ষ্য করলাম, যারা মাকে হারিয়ে চিৎকার করে কাঁদছিল, তাদের থামিয়ে দিল কিছু সাচ্চা মুসলমান। তাদের ভাষ্য, ‘আল্লাহর বান্দাকে আল্লাহ দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন, আল্লাহ এখন নিয়ে যাচ্ছেন। শব্দ করে কাঁদলে আল্লাহ নারাজ হবেন, যদি নিতান্তই কাঁদতে হয়, নীরবে কিছুটা চোখের জল ফেলো, ব্যস’।

পুরুষতন্ত্রের নামে, মানুষের ভালোবাসা আর আবেগের মতো গুণগুলোকে বিদেয় করার চেষ্টা চলছে, মানুষকে পাথর বানাবার চেষ্টা চলছে। যে যত পাথর সে তত পুরুষ সে তত স্ট্রং! যুক্তিবাদীদের কাঁদতে নেই কে বললো! আবেগে কাঁদার পর মানুষের ব্যথা বেদনা কম হয়, টেনশন কমে, মন ভালো হয়, চোখের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। যুক্তিবাদীরা এই বেনিফিটটা বোকার মতো হারাবে কেন?

আমি যখন মাকে নিয়ে আমার ‘নেই কিছু নেই’ বইটি লিখছিলাম, লেখার সময় আমি প্রতিদিন মা’র জন্য কাঁদতাম, মা’র না থাকার কষ্টে কাঁদতাম। বইটি লেখার পর আমার কী যে ভালো লেগেছে তা বোঝাতে পারবো না। কান্না আমাকে সেই ভালো লাগা, সেই প্রশান্তি দিয়েছে।

লজ্জা লিখেছিলাম ২৯ বছর আগে। বর্ণনা করেছিলাম হিন্দুদের দোকানপাট, বাড়িঘর, মন্দির কী করে ভাঙ্গে, জ্বালিয়ে দেয়, পুড়িয়ে ছাই করে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। বর্ণনা করেছি অতি দেশপ্রেমিক, এমনকি ধর্ম-না-মানা হিন্দুদেরও কীভাবে বাধ্য হয়ে পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি ত্যাগ করতে হয়, জীবন এবং অবশিষ্ট সম্মানটুকু বাঁচানোর তাগিদে ছাড়তে হয় প্রিয় দেশ।

বই লিখে কী হয়? কিচ্ছু হয় না। আজও একই রকম চলছে হিন্দুর ওপর অত্যাচার। আজও কোনও সরকারই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা করেনি। আজও হিন্দুরা জীবন এবং সম্মান বাঁচাতে দেশ ত্যাগ করছে। দু’দিন আগে খুলনায় মুসলমান মৌলবাদীরা ফের গুঁড়িয়ে দিল হিন্দুদের মন্দির, বাড়িঘর, দোকানপাট। ওদিকে ঝুলন দাস এখনও বিনা অপরাধে জেল খাটছেন। কারও কি কিছু যায় আসে? আমরা সকলেই এর উত্তর জানি, কারও কিছু যায় আসে না।

সেদিন পাকিস্তানের পাঞ্জাব জেলার রহিম ইয়ার খান এলাকায় মুসলমান মৌলবাদীরা এক হিন্দু মন্দির ভেঙ্গেচুরে দিয়েছিল। তারপর কিন্তু রাস্তায় নেমে হিন্দুরা এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের অসাম্প্রদায়িক মানুষেরা প্রতিবাদ করেছে। পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী দেশেও সংখ্যালঘুর ওপর জুলুম হলে প্রতিবাদ হয়, বাংলাদেশে হয় না। পাকিস্তানের সরকার মন্দির সারিয়ে  দিয়েছে, এবং মন্দির ভাঙ্গার জন্য এক শ জনকে জেলে ভরেছে। তাইতো বলি, পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে।

আমার বাংলাদেশি শুভাকাক্সক্ষীরা বলেন, ‘বাংলাদেশে গোলাম আযম থাকতে পারে, নানারকম চোর ডাকাত বদমাশ, রেপিস্ট, সিরিয়াল কিলার থাকতে পারে, তসলিমা কেন থাকতে পারবে না?’ আমি বুঝি না খারাপ লোকের কাতারে আমাকে কেন ফেলেন আমার শুভাকাক্সক্ষীরা। কেন তাঁরা বলেন না, ‘যদি দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকতে পারেন, দীপুমনি থাকতে পারেন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হাসান আজিজুল হক থাকতে পারেন, তাহলে তসলিমা কেন থাকতে পারবেন না?’

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর