মঙ্গলবার, ৩১ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

আগস্ট ট্র্যাজেডি : প্রতিহিংসার পরম্পরা

ওয়াহিদা আক্তার

আগস্ট ট্র্যাজেডি : প্রতিহিংসার পরম্পরা

১৮ জানুয়ারি ১৯৭৪ অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিপক্ষীয় কাউন্সিল অধিবেশনে প্রদত্ত উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন : ‘ভুলে যেয়ো না, স্বাধীনতা পেয়েছ এক রকমের শত্রুর সাথে ফাইট করে। তখন আমরা জানতাম, আমাদের এক নম্বর শত্রু পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও শোষক গোষ্ঠী। কিন্তু এখন শত্রুকে চেনা বড় কষ্টকর। আমি একদিন গল্প করতে গিয়ে বলেছিলাম, জীবনে আমি তিনটা জিনিসকে ভয় পাই। আর কাউকে আমি ভয় পাই না। একটা হলো কুমির। নদীতে থাকে। পানির মধ্যে গোসল করতে গেলে পা ধরে টান দিয়ে নিয়ে যায়। তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারি না। দ্বিতীয়টা সাপ। ফুঁস করে মেরে দিলে যুদ্ধ করতে পারি না। আর তৃতীয়টা মোনাফেক। তার সঙ্গেও সামনাসামনি যুদ্ধ করা যায় না। কুমির, সাপ আর মোনাফেক! তোমরা আগে যুদ্ধ করেছ, কিন্তু এখন বাংলার মাটিতে এদের সঙ্গে সামনাসামনি যুদ্ধ করার উপায় নাই। তোমাদের সাথে যুদ্ধ করছে মোনাফেক, তোমাদের সাথে যুদ্ধ করছে কেউটে সাপ আর পানির তলে কুমির। এরা রাতের অন্ধকারে গুলি করে মারে আর বলে রাজনীতি করে।’

এ দেশে একসময় সাধারণ মানুষের রাজনীতি করার অধিকার ছিল না। তারা সংগঠিত ছিল না। কী তাদের অধিকার তা-ই জানত না। এ দেশে কৃষক, শ্রমিক, হকার, দিনমজুরকে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে ক্ষমতায়িত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বিশ্বব্যাপী বিবিসির নিয়মতান্ত্রিক জরিপে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃতি এজন্যই যে একজন মানুষ তার স্বল্প জীবনকালে তার পৈতৃক সম্পত্তি রক্ষা করে একজন মাত্র মানুষের মনে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা করে জীবন পার করে। সেখানে বঙ্গবন্ধু একটি জাতিকে বাঙালি হিসেবে তার স্বকীয়তা, সংস্কৃতি, ভাষাকে ভালোবাসার সঙ্গে বিশ্বে উপস্থাপন করেছেন। পাঁচ আঙুল দিয়ে ভাত মেখে খাওয়া তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার বাঙালিকে যুদ্ধে বিজয়ী জাতি হিসেবে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। একটি দেশ, একটি পতাকা নিয়ে পৃথিবীতে ছোট্ট একটি দেশের নিজস্ব সত্তায় উপস্থিতি দিয়ে জানান দেওয়া যে আমরা মানবতার কল্যাণে বিশ্বের সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই কারও সঙ্গেই শত্রুতা নয়। আমার দেশের মাটি আছে, মানুষ আছে। বাংলার মানুষকে জীবন দিয়ে ভালোবেসে বুক পেতে গুলি খেয়েছে। কিন্তু বাঙালিকে অবিশ্বাস করে তার ভালোবাসাকে অসম্মান করেননি, অপমান করেননি। আফসোস! এখনো বাঙালি নামের কুলাঙ্গার কিছু লোক দিনরাত মিথ্যাচার করে খাটো করে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে।

মনস্তাত্তি¡করা বলেন, আত্মহত্যার প্রবণতাসম্পন্ন কোনো রোগী যখন তার গাড়িচালককে অনুরোধ করে তাকে আত্মহত্যার উপকরণ জোগাড় করে দিলে সে যখন মারা যাবে গাড়িটির মালিক চালক নিজে হতে পারবে। সুতরাং সে যেন বিষয়টি গোপন রাখে এবং তাকে আত্মহত্যার উপকরণ জোগাড় করে দেয়। মনস্তাত্তি¡করা বলেন, এর মাধ্যমে আত্মহত্যার প্রবণতাসম্পন্ন রোগী নাকি বাঁচতে চায় এবং অবচেতনে চায় গাড়ির ড্রাইভার বাসায় সবাইকে বলে দিক এবং তাকে এ কাজ থেকে নিবৃত্ত করা হোক। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাড়ির ড্রাইভার/ গৃহপরিচারক সামান্য লোভের কারণে তাকে না বাঁচিয়ে আত্মহত্যায় সহযোগিতা করে। আমি জানি না এভাবে কেউ গাড়ির মালিক হতে পেরেছে কি না। তবে এ সর্বনাশ থেকে গাড়িচালক/গৃহপরিচারক তার মনিবকে বাঁচাতে পারত। শুনেছি ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ড পরিকল্পনার কথা বিপথগামী সেনা কর্মকর্তারা তাদের ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা জিয়াকে অবহিত করে। সে তাদের নিবৃত্ত না করে বরং উৎসাহিত করে। সেদিন প্রকৃত পেশাদারি সেনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করলে ১৫ আগস্টের নৃশংসতম ঘটনা ঘটত না। এর দায় তিনি এড়াতে পারেন কি না মহাকালই সে হিসাব নেবে।

দেশের শান্তি রক্ষার প্রয়োজনে, অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে, ভাষা সংস্কৃতির উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে, সর্বোপরি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দেশের স্থিতিশীলতার প্রয়োজনে ইতিহাসের খলনায়কদের চরিত্র ও তাদের বংশধরদের কর্মকান্ড নজরদারি ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। শত বছরের শোষণ-বঞ্চনার অবসানের জন্য প্রতিবাদ, সংগ্রাম, স্বাধীনতা অর্জনে স্বাধীনতার স্বপ্নপুরুষেরা জীবন-যৌবন পাত করে একটি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত মর্যাদাশীল দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন। আর অন্যদিকে একটি বিশ্বাসঘাতক দল যারা দেশের স্বাধীনতাই চায়নি তারা দেশকে পেছন থেকে ছুরি মেরে খুন, ষড়যন্ত্র, নাশকতা, জঙ্গিবাদ প্রতিষ্ঠা করে যেনতেন উপায়ে ক্ষমতার স্বাদ পেতে চাইবে এটা চলতে দেওয়া যায় না। এর শিকড় উৎপাটন প্রয়োজন।

বঙ্গবন্ধু বলেছেন, বাংলা আর বাঙালির ইতিহাস সিরাজউদ্দৌলা বনাম মীরজাফরের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস বাংলার আপামর মানুষ বনাম জনাব মোনেম খাঁদেরই ইতিহাস। এ ইতিহাস বড় করুণ, বড় মর্মন্তুদ। এ ইতিহাস আবার গৌরবদীপ্তও বটে। তিনি আরও বলেন, সুজলা-সুফলা, শস্য শ্যামলা এই সোনার বাংলাকে শোষণের চারণ ক্ষেত্রে পরিণত করার দুরভিসন্ধিতে মেতে নেপথ্যের একশ্রেণির কুচক্রী যে মতলব এঁটেছেন, এই বাংলার মীর জাফররাই বারবার সেই মতলবের বাস্তবায়নে প্রধান হাতিয়ার হয়ে কাজ করে এসেছে। (১৯৭০ সালের বেতার-টেলিভিশনে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে নেওয়া)।

স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এসব খুন, হত্যা, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা বংশপরম্পরায় করা হচ্ছে। পিতা যে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়েছে, পিতার মৃত্যুর পর পুত্রও একই প্রবণতা নিয়ে হীন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না, মীরজাফররা ক্ষমতার লোভে বিশ্বাসঘাতকতা করে কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ পায় না। ষড়যন্ত্রকারীরা, খুনিরা তিলে তিলে করুণভাবে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। কিন্তু তাদের সাধের ক্ষমতা অধরা থেকে যায়। খুনিরা এবং তার বংশধররা পৃথিবীতে খুনের নেশায় মাতে এবং যত দিন দুনিয়ায় বেঁচে থাকে ইতর প্রাণীর মতো অন্ধকারে লুকিয়ে থেকে জীবন্মৃত ও অভিশপ্ত জীবনযাপন করে। তাকে বাঁচা বলে না কিন্তু তারা বেঁচে থাকে, তারা সেটা জীবদ্দশায় বুঝতে পারে না। দেশের প্রয়োজনে, কল্যাণে, মানুষের অধিকার আদায়ে একটি পশমও তারা উপড়ে আনতে পারে না। শুধু পারে দেশের মানুষের দুর্ভাগ্যের কারণ হতে।

বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে ছোট একটি দেশ। ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যে এখানকার মানুষ কাদা মাটির মতোই নরম প্রকৃতির। এ নরম প্রকৃতির বাঙালির ভিতর মর্যাদাবোধের আগুন জ্বেলে দিতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু তাঁর ভালোবাসায়, অনলবর্ষী বক্তৃতায়। মানুষ অধিকারসচেতন হয়। তারা স্বাধীনতার জন্য রক্ত দেওয়ার পণ করে।

পৃথিবীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নানা আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। এত সুশৃঙ্খল, সংগঠিত, পরিকল্পিত, সীমিত সম্পদ ব্যবহারে মাত্র নয় মাস যে জনযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল তা বিস্ময় সৃষ্টি করে। মানুষ স্বাধীনতাকামী হয়ে হাসিমুখে জীবন উৎসর্গ করেছে। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সম্ভাব্য যুদ্ধ পরিচালনার সব কৌশল বজ্রকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার ভুখা-নাঙ্গা মানুষ সময়ের চেয়ে ছিল বেশি এগিয়ে। সেক্টরওয়ারি যুদ্ধ পরিচালনা, দায়বদ্ধতা নির্ধারণ ও জবাবদিহি ছিল অনন্যসাধরণ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের মহিমায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের ত্যাগের নিদর্শন মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছিল।

১৭ এপ্রিল মুজিবনগর অস্থায়ী সরকার গঠন না হলে পৃথিবীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে পরিগণিত হতো। বিশ্বে কোনো দেশের স্বাধীনতার ঘোষণার অধিকার থাকে একমাত্র রাজনৈতিক সরকারের। ১৯৭০-এর নির্বাচন, জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা না দিয়ে টালবাহানা করে নিরীহ জনগণের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা সবকিছুই ছিল আন্তর্জাতিক সব রীতিনীতির সীমা লঙ্ঘন। এত রক্ত এত জীবন পৃথিবীর কোনো দেশকে দিতে হয়নি। বেশি দূর পেছনে যেতে হবে না। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমাদের দেশের গ্রামের অধিকাংশ মানুষের চেহারা ছিল অস্থিচর্মসার, পেটে ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই, স্বপ্ন নেই, শিক্ষা নেই, ভুখা-নাঙ্গা মানুষের মূর্ত প্রতীক ছিল বাংলাদেশের মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থী মানুষের ঢলের যে চিত্র আর্কাইভে আছে তা দেখলে মনের অজান্তে স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসে।

মহান আল্লাহকে শুকরিয়া জানাই, ভাগ্যিস দেশটা স্বাধীন হয়েছিল! কী গজবটাই না হতো এ দেশের মানুষের। আজ বাংলাদেশের কোনো অঞ্চল থেকে এ রকম একজন অস্থিচর্মসার ক্ষুধার্ত মানুষকে খুঁজে আনা সম্ভব হবে না।

আমি নিশ্চিতই বলতে পারি এটা আমাদের স্বাধীনতার সুফল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিচ্ছেন এভাবে যে তাঁর বাবার অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণে বাংলার দুঃখী মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যুর হার কমানো, একটি সুখী-সমৃদ্ধ জীবনযাপনের ব্যবস্থা করা, যা ছিল তাঁর পিতার স্বপ্ন। লাখ লাখ গৃহহীন মানুষকে উন্নতমানের একটি বাড়ি উপহার দিয়ে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরা তাঁকে ভোট দেবে কি না সে হিসাব করে তো তিনি কাজ করছেন না। এরা বাংলাদেশের মানুষ এটাই তাদের বড় পরিচয়।

অন্যদিকে কেউ কেউ পিতার অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণে ১৫ আগস্টের অসমাপ্ত কাজের সমাপ্তির জন্য ২১ আগস্ট পরিকল্পনা করেন। সারা দেশে একযোগে ৫০০ স্থানে বোমা হামলা দিয়ে জঙ্গিদের শক্তি প্রদর্শন ও অস্তিত্ব জানান দেওয়া, বাংলাদেশের মাটিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অস্থিতিশীলতায় ব্যবহার হতে দেওয়া থেকে শুরু করে দেশের সংস্কৃতির ওপর হামলা, উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ছায়ানটের বর্ষবরণে বোমা হামলা, সিনেমা হলে বোমা হামলা ছিল নিত্যদিনের খবর। দীর্ঘদিনের শোষণে নিষ্পেষিত বাঙালি জাতি ক্ষুধায় কষ্ট পেয়েছে কিন্তু সংস্কৃতির অন্নজলে কখনো আনন্দ বিনোদনের অভাব হয়নি। অথচ বোমা সংস্কৃতির দুঃশাসনে তাদের অজানা আতঙ্কে ঘরে উঠিয়ে দিয়ে দেশকে অন্ধকারে ঢেকে দিতে চেয়েছে একসময়। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সারা দেশে প্রতিহিংসার দাবানল জ্বালিয়ে মানবতাকে পুড়ে মরতে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের ভিতর আরেক রাষ্ট্র বাংলা ভাইয়ের শাসনে উত্তরাঞ্চলের রক্তাক্ত জনপদ যেন ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত আগুনে পড়ে, বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি বলে দৃষ্টি ঘোরানো। ভিকটিমকে ভিকটিমাইজ করাই ছিল তখনকার নীতি। কেউ যেন স্বজন হারানোর বেদনায় কাঁদতে না পারে তাকে উল্টো জেরা করা হতো সে সন্দেহের তালিকায় যেন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।

সর্বহারা অধ্যুষিত এলাকা নওগাঁয় আমার পোস্টিং হয় ২০০৩ সালে। সর্বহারা ধ্বংসের নামে রাজশাহীতে বাগমারা ও নওগাঁ অঞ্চলে বাংলা ভাইয়ের আবির্ভাব হয়। রাষ্ট্র থেকে তাকে যা ইচ্ছা তা-ই করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। কিছুদিন মানুষের মনে সর্বহারাদের দমনের নামে বাংলা ভাইয়ের কর্মকান্ড মুখে মুখে আলোচনায় ছিল। কিছুদিন যেতেই শোনা যায় যে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল দমনের নির্মম হাতিয়ার বাংলা ভাই। রাষ্ট্রীয় মদদে সর্বহারাদের অঞ্চলগুলোর জনগণ আবারও নতুন মাত্রায় অত্যাচারের শিকার হতে থাকে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি বাংলা ভাই নিজস্ব শাসনব্যবস্থা চালু করে বিচার বসায়। সারা রাত মারধর করার পর সকালে কোর্টে চালান দেওয়া হতো। আমি ছিলাম প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট। আমার কাজ ছিল সারা দিন ধরে ওই আসামিদের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা। এক দিন সাহস করে বাংলা ভাইয়ের বিতর্কিত কিছু কাজের কথা জানালে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাকে জনকণ্ঠ পড়া ম্যাজিস্ট্রেট বলে তিরস্কার করেন। সারা দেশে জঙ্গি হামলার টার্গেট করা হয়। জনসমাগম বেশি হয় সেখানে যেমন অফিস-আদালতের চত্বর বেছে নেওয়া হয় আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য। ঝালকাঠিতে আদালতে যাওয়ার পথে সোহেল আহমদ ও জগন্নাথ পাঁড়ে নামে দুজন বিচারককে বোমা হামলায় হত্যা করা হয়, হতাহত হয় বহু মানুষ। দাড়ি, টুপি-পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত কাউকে অহেতুক সন্দেহ করে নাস্তানাবুদ করা হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এ হামলা হয়। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের সব নেতা-কর্মীকে একসঙ্গে শেষ করে দেওয়া ছিল উদ্দেশ্য। নওগাঁয় কর্মরত অবস্থায় দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাছে প্রথম জানতে পারি যে আওয়ামী লীগ এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার নির্মম শিকার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে তখন ক্ষমতাসীন দল গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনার জন্য দায়ী করে বলল যে, দেশের অগ্রযাত্রাকে অস্থিতিশীল করার জন্য বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা ও তাঁর দল সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এখানেও সেই একই ফরর্মলা- ভিকটিমকে ভিকটিমাইজ করা। এখনো তারা প্রতিষ্ঠিত করতে চায় শেখ হাসিনা নিজের সব নেতৃবৃন্দ নিয়ে নিজেদের কর্মী সমাবেশে ১৩টি গ্রেনেড ছুড়ে নিজের কানের তালা ফাটিয়েছেন। কি অদ্ভুত যুক্তি! উক্ত গ্রেনেড হামলায় নারী নেত্রী বেগম আইভি রহমানসহ নিবেদিত ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন এবং ৩ শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হন। হাসপাতালে তাদের যেন কোনো চিকিৎসা না হয় সে বিষয়ে নির্মম আচরণ করা হয় প্রশাসন থেকে। একটা স্প্রিন্টারও কেন শেখ হাসিনার গায়ে লাগল না সেই এক বড় আফসোসের কথা! এখন এ বিষয় নিয়ে আলোচনারও শেষ নেই!

এ নিয়ে সংসদে নির্লজ্জ মিথ্যাচারে, উপহাসে, দাম্ভিক অসংসদীয় আচরণে শেখ হাসিনা বেঁচে গেল কেন সেই জবাবদিহি এখনো করতে হয়। একই জঙ্গিগোষ্ঠী বোমা বিস্ফোরক জঙ্গি মুফতি হান্নানকে বারবার ব্যবহার করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে প্রাণে শেষ করে দেওয়ার জন্য। বারবার ঘুঘুকে ধান খেতে দেয় না যে সে তো ওপরে বসে সবকিছু দেখছেন, শুনছেন, সেখানে হাত দেওয়ার ক্ষমতা তো মানুষের নেই। আমি একটা অনুষ্ঠানে বক্তব্য শুনেছিলাম তৎকালীন মহানগরী আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়ার স্মৃতিচারণায় মুক্তাঙ্গনে সভা করার অনুমতি না হওয়ার অনিশ্চয়তায় পার্টি অফিসের সামনে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সভার স্থান নির্ধারণ হয়। শেখ হাসিনা বলেন, তোরা পিছনে ধাক্কাধাক্কি করিস আমি অনেক সময় অসুবিধায় পড়ি, একটা ছোট টেবিল রাখিস আর পুরাতন জরাজীর্ণ ট্রাক কোথায় পাস! একটা ভালো ট্রাক নিস। ট্রাকটি ওই দিন প্লেস করতে করতে গাড়িচালক নির্ধারিত জায়গা থেকে এগিয়ে ময়লার স্তুপের কাছে গিয়ে থামে, এতে অনেকে রাগ করে। কিন্তু এতেই গ্রেনেডগুলো সরাসরি ট্রাকে এসে পড়েনি, শেখ হাসিনাকে আঘাত করতে পারেনি।

বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষা যা কিছু আবর্তিত হয় সব শেখ হাসিনাকে ঘিরে। তিনি ব্যক্তিজীবনে ধর্মপ্রাণ, দানশীল, দয়ালু এবং আবহমান বাংলার সংস্কৃতিকে লালন করেন। তাঁকে হত্যা করতে পারলে বাংলাদেশকে মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করা যাবে বলে খুনিরা মনে করে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের এত নেতৃবৃন্দ কবে মারা যাবে সেই ধৈর্য ধরার সময় নেই। ক্ষমতা একচ্ছত্র করতে আওয়ামী লীগের সব নেতৃবৃন্দ একসঙ্গে মেরে ফেলা দরকার ছিল বলেই এ পরিকল্পনা! এখন তো দেশবাসী সবাই ঘটনা জানে।

পরিশেষে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত উল্লেখ করে আজকের লেখা শেষ করছি। সুরা কাসাস: ২৮:৫ নম্বর আয়াতে মহান রব্বুল আলামিন বলছেন, ‘ওয়া নুরীদু আন্ নামুন্না আলাল লাযীনাস তুদ্ব ইফু ফিল আরদ্বী ওয়া নাজ আলাহুস আইম্মাতাও ওয়া নাজ আলাহুমুল ওয়ারিছিন’। অর্থ- ‘আমি ইচ্ছা করলাম সে দেশে যাদের হীনবল করে রাখা হয়েছিল আমি তাদের প্রতি অনুগ্রহ করব, তাদের নেতৃত্ব দান করব এবং তাদেরই উত্তরাধিকারী বানাব।’ এ আয়াতের শানে নুজুল হলো ফেরাউন তার প্রধানমন্ত্রী হামান এবং তাদের সৈন্যবাহিনী আল্লাহর জমিনে অবস্থান করে পৃথিবীর মানুষের প্রভুত্ব করতে চেয়েছিল। আর কোনো শক্তি তাদের ওপর যাতে বিজয়ী না হতে পারে সুপরিকল্পিতভাবে নীলনকশা অনুযায়ী একটি জাতিকে হীনবল করার হীন ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছিল। মহান আল্লাহ তাদের সমূলে ধ্বংস করে বিশ্ববাসীকেও জানিয়ে দিয়েছেন, পৃথিবীতে কোনো শক্তি চিরস্থায়ী হয় না। আরও জানিয়ে দেন মানুষের ইচ্ছাই ইচ্ছা নয় বরং আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা-ই কার্যকর হয়।

লেখক : অতিরিক্ত সচিব।

সর্বশেষ খবর