শনিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

হেরে যাবে বাংলাদেশ?

সৈয়দ বোরহান কবীর

হেরে যাবে বাংলাদেশ?

টি-২০ বিশ্বকাপ চলছে। এ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কেন গ্রুপ পর্বে খেলবে এ নিয়ে আমাদের প্রচন্ড অভিমান। উদ্বোধনী খেলা দেখতে বসলাম আয়োজন করে। বাংলাদেশের জার্সি গায়ে চড়ালাম। স্কটল্যান্ডকে কত সহজে হারাবে, সেটাই যেন খেলা দেখার মূল উপলক্ষ। কিন্তু কী আশ্চর্য। বাংলাদেশ হেরে গেল। মন খারাপ করেই পরের ম্যাচ দেখতে বসলাম। এবার প্রতিপক্ষ ওমান। সে খেলায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ জিতল। খেলা এমনই। কখনো কোনো দল জিতবে, কখনো হারবে। একটি রাষ্ট্রেরও উত্থান-পতন হয়। সুসময়-দুঃসময় আসে। কিন্তু একটি রাষ্ট্র যখন তার লক্ষ্যচ্যুত হয়, যখন আদর্শচ্যুত হয় তখন সেই রাষ্ট্র চিরস্থায়ীভাবে হেরে যায়। ‘বাংলাদেশ’ নামের রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে মৌলিক লক্ষ্য এবং আদর্শ নিয়ে তার অন্যতম হলো ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। কিন্তু গত কয়েক দিনে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তাতে অনেকের প্রশ্ন, বাংলাদেশ কি তার লক্ষ্যে আছে? নাকি আদর্শচ্যুত বাংলাদেশ হেরে যাচ্ছে? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এ জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা, প্রতিষ্ঠাতা। সারা জীবন তিনি ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। বঙ্গবন্ধু কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন তা তাঁর লেখা এবং বক্তব্যেই পাওয়া যায়।

‘এ দেশে ইসলাম, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবই থাকবে এবং বাংলাদেশও থাকবে। হিন্দু ও বৌদ্ধদের ওপর গত এক দশক যে অত্যাচার হয়েছে তারও অবসান হবে।’ (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭০। সূত্র : শেখ মুজিব বাংলাদেশের আরেক নাম, আতিউর রহমান। পৃষ্ঠা : ২১৯)

‘জনগণকে ইসলাম ও মুসলমানের নামে স্লোগান দিয়ে ধোঁকা দেওয়া যায় না। ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালোবাসে, কিন্তু ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি তারা করতে দিবে না...’ (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ২৫৮)।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতার এ দুটি উক্তিই আমাদের রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষাপট বলে দেয়। এক অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের স্বপ্ন বুকে ধারণ করেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান। আমরা সবাই বাঙালি।’ এ অমর স্লোগান বুকে ধারণ করেই ৩০ লাখ বাঙালি জীবন দিয়েছিল। ৩ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এ প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের দাঁড়াতেই হয়- সেই বাংলাদেশ কি আমরা পেয়েছি? এ রাষ্ট্র কি সবার? বাংলাদেশ কি পথভ্রষ্ট? আমরা কি হেরে যাচ্ছি? ১৩ অক্টোবর থেকে কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালীতে যা ঘটল, তা কি আমাদের বাংলাদেশ? মুহুর্তে কিছু মানুষের সব লুট হলো, পুড়ে ছাই হয়ে গেল ভালোবাসার ঠিকানা। সন্ত্রাসের তান্ডবে পালিয়ে গেল মানবতা। কিছু মানুষ অনুভব করল এ রাষ্ট্রে তারা অনাহুত, নিরাপত্তাহীন। তাদের পাশে কেউ নেই। এ রকম একটি ঘটনা যতটা না দুঃখজনক তার চেয়েও দুর্ভাগ্যজনক হলো ঘটনা-পরবর্তী রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া। বিশ্বে সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আমরা দেখি নানা ইস্যুতে রাজনৈতিক দলের মতপার্থক্য থাকে। কিন্তু সংকটে এবং মৌলিক প্রশ্নে, দেশের স্বার্থে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়। ভারতে তীব্র বিভাজনের রাজনীতিতেও বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রশ্নে সব দল একাট্রা। নিউজিল্যান্ডে উগ্রবাদী সন্ত্রাসবাদ, সেখানকার রাজনৈতিক বিভেদকে উপড়ে ফেলে। ব্রিটেনে এমপির মৃত্যু সব মত ও পক্ষের পার্থক্য মুছে ফেলে। কিন্তু সংকটে বাংলাদেশ এক হতে পারে না। জাতীয় স্বার্থে সব রাজনৈতিক দল একই সুরে কথা বলতে পারে না। হোক না তা রোহিঙ্গা ইস্যু, করোনা মোকাবিলা কিংবা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস। দেশে কোনো অস্থিতিশীল, জনগণের স্বার্থহানিকর উত্তেজনা সৃষ্টি হলে রাজনৈতিক বিভক্তির কদর্য, কুৎসিত রূপ যেন আরও বীভৎস রূপ ধারণ করে। বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বিভাজন দেখা যায় সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে। যে ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পকে উপড়ে দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি তাকে আবার নতুন করে লালন করার এক অদ্ভুত প্রবণতা আমাদের রাজনীতিতে দৃশ্যমান। তার চেয়েও ভয়ংকর হলো সাম্প্রদায়িকতা যেন রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ ঘায়েলের এক অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। এবার শারদীয় দুর্গোৎসবের সময় থেকে সাম্প্রদায়িকতার যে তান্ডব বাংলাদেশ দেখল, সেখানে রাজনীতিবিদদের সহানুভূতির চেয়ে প্রতিপক্ষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর এক বিদঘুটে প্রবণতা দগদগে ঘায়ের মতো দৃশ্যমান। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ব্লেইম গেইমে যেন ধর্মান্ধ দুর্বৃত্তরা আড়ালে থেকে যাচ্ছে।

ঘটনার পর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক থেকে শুরু করে মন্ত্রী-উপমন্ত্রী, নেতা-পাতিনেতা সবাই হইহই করে উঠলেন। সবার আঙুল বিএনপির দিকে। বলা হলো, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য বিএনপি-জামায়াতের মদদে এসব ঘটানো হয়েছে। যে বিএনপি নিজেদের নেতাকে মুক্ত করার জন্য একটি আন্দোলন করতে পারে না সেই বিএনপি এমন সুচারুভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করতে সক্ষম? আমরা যদি তর্কের খাতিরেও ধরে নিই এটা ‘বিএনপির ষড়যন্ত্র’, তা হলে প্রশ্ন আসে সরকার কী করল? সরকার নিয়ন্ত্রিত গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কী করল? ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে, মাইকিং করে, সমাবেশের মাধ্যমে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পর্যাপ্ত সময় পেয়েছে। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখল কেন? একটি রাষ্ট্রে সব নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। বিএনপির ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায় এড়ানো কি যাবে? যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গিদের গোপন পরিকল্পনার খবর পেয়ে মুহুর্তেই আস্তানা ঘিরে ফেলে, ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ‘অপরাধী’কে অসম্ভব দক্ষতায় গ্রেফতার করে  সেই চৌকস, দক্ষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিছুই জানল না, কিছুই বুঝল না। কী করে সম্ভব? বাংলাদেশে সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হওয়ার আগেই বিভিন্ন মহল থেকে নিরাপত্তা রক্ষার কথা বলা হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল দুর্গাপূজায় নাশকতার কোনো শঙ্কা নেই। তাহলে এটি কি গোয়েন্দা ব্যর্থতা? কুমিল্লার ঘটনার পর অনেকেই আশঙ্কা করেছিল এর জেরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হতে পারে। শেষ পর্যন্ত সে শঙ্কাই সত্য পরিণত হলো। প্রশ্ন উঠতেই পারে এ রকম পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী প্রস্তুতি নিয়েছিল? প্রশাসনিক ব্যর্থতার কথা বাদই দিলাম, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগ কী দায়িত্ব পালন করছে? দেশে এখন আওয়ামী লীগের অভাব নেই। ইউনিয়ন নির্বাচন থেকে সংসদ উপনির্বাচন সর্বত্র প্রার্থীর ছড়াছড়ি। কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, রংপুরে এত আওয়ামী লীগ কোথায় গেল? কোথাও তো রাজনৈতিক প্রতিরোধ দেখলাম না। রাজনৈতিক প্রতিরোধ পরের কথা, ঘটনার পর দুর্গত এলাকায় ছুটে যাওয়ার ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগের আড়ষ্টতা! কেন? ১৩ বছর আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায়। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়ামী লীগ হেফাজতের সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলে। আওয়ামী লীগে জামায়াত-যুদ্ধাপরাধীরা বাসা বাঁধে। এবার দেখলাম নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জড়িত দুজন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পর্যন্ত পেয়েছেন। তবে আশার কথা হলো, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মনোনয়ন বাতিল করেছেন। শুধু নাসিরনগর কেন, দেশের বহু স্থানে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারের পুনরুত্থান ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তাঁর উদ্যোগে এ-সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণের ব্যবস্থা করেছেন। সেখানে হাজার হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে। আওয়ামী লীগ নেতারাই বলেছেন, তৃণমূল থেকে অর্থের বিনিময়ে এসব নাম পাঠানো হয়েছে। আওয়ামী লীগের ভিতরই এখন সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ, মৌলবাদের ভূত ঢুকে গেছে। যে শর্ষে দিয়ে ভূত তাড়াবে সেই শর্ষের মধ্যেই ভূত। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর নামে স্লোগান দিয়ে চাটুকাররা গলা ফাটিয়ে ফেলে। কিন্তু তাঁর নির্দেশগুলো আওয়ামী লীগের কজন জানে?

শেখ হাসিনা বারবার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নির্দেশ দিচ্ছেন। আর এ নির্দেশ শুনে কিছু কিছু আওয়ামী লীগ নেতা দ্বিগুণ উৎসাহে জামায়াত-যুদ্ধাপরাধীদের আওয়ামী লীগে ঢোকাচ্ছেন। তাদের পদ দিচ্ছেন, মনোনয়ন দিচ্ছেন। ফলে জাতির পিতা সারা জীবন যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগের জন্য লড়াই করলেন সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনাই আজ আওয়ামী লীগে বিলীনপ্রায়। আওয়ামী লীগ নেতারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা মুখে বলেন কিন্তু বাস্তবে কজন তা মানেন। এ রকম সাম্প্রদায়িক উসকানি ও সহিংসতায় বঙ্গবন্ধু নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে আর্তমানবতার সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এর কিছু নিদর্শন আমরা পাই। ভারত বিভক্তির পর কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল। সে দাঙ্গায় বঙ্গবন্ধু কী করেছিলেন একটু দেখে নেওয়া যাক-

‘কলকাতা শহরে শুধু মরা মানুষের লাশ বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। মহল্লার পর মহল্লা আগুনে পুড়ে গিয়েছে। এক ভয়াবহ দৃশ্য। মানুষ মানুষকে এভাবে হত্যা করতে পারে, চিন্তা করতেও ভয় হয়।... লেডি ব্রাবোর্ন কলেজে রিফিউজিদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দোতলায় মেয়েরা, আর নিচে পুরুষ। কর্মীদের ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আমাকেও মাঝে মাঝে ডিউটি করতে হয়। মুসলমানদের উদ্ধার করার কাজও করতে হচ্ছে। দু-এক জায়গায় উদ্ধার করতে গিয়ে আক্রান্তও হয়েছিলাম। আমরা হিন্দুদের উদ্ধার করে হিন্দু মহল্লায় পাঠাতে সাহায্য করেছি।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ৬৬)। জাতির পিতা শিখিয়েছেন রাজনীতি মানে শুধু প্রতিপক্ষকে পরাজিত করা নয়। রাজনীতি মানে মানুষের সেবা। দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো। বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন এ কাজটি করেছেন। কিন্তু আজ আওয়ামী লীগের কজন সে পথে হাঁটেন? একটা করে ঘটনা ঘটছে। আওয়ামী লীগের নেতাদের কথার খই ফুটছে। দুর্গত মানুষের পাশে ছুটে যাওয়ার আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ মনে করেন এ ঘটনার দায় কোনোভাবে বিএনপির ঘাড়ে চাপাতে পারলেই হলো, ব্যস। বিএনপিকে আরও সহজেই ঘায়েল করা যাবে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর আওয়ামী লীগের কিছু নেতার এ প্রবণতা অগ্রহণযোগ্য এবং দায় এড়ানোর কৌশল। এসব ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের কেউ জড়িত থাকতেই পারে। সেটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচারব্যবস্থা দেখবে। কিন্তু সরকার হিসেবে অবশ্যই আওয়ামী লীগকেই এর দায় নিতে হবে। জনগণের জানমালের হেফাজতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এটা ষড়যন্ত্র বলে পার পাওয়া যাবে না। যারা ষড়যন্ত্র করেছে তাদের আইনের আওতায় আনা সরকারের কাজ। প্রশ্ন উঠতেই পারে- ১৩ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, তার পরও কেন সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত সাপ ছোবল মারল। আওয়ামী লীগ কি তাহলে জাতির পিতার আদর্শের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে পারেনি? আওয়ামী লীগ কি তাহলে ক্ষমতায় থাকার জন্য দুধকলা দিয়ে ধর্মান্ধ মৌলবাদের সাপ পুষছে?

কুমিল্লার ঘটনার পর থেকেই বিএনপি নেতারা উল্লসিত। তাদের উল্লাস এখন আর চাপা থাকছে না। বিএনপি নেতাদের কথাবার্তা আজকাল অসংলগ্ন, দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং অমার্জিত। তাদের কথা শুনে মনে পড়ে সেই অক্ষম, অযোগ্য ব্যক্তিদের যারা কিছু করতে না পেরে খিস্তি করেন। বিএনপি নেতাদের কথা শুনলে মনে হয় সাম্প্রদায়িকতার কার্ড নিয়ে তারা আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে ফেলেছেন। বিএনপি নেতাদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ নেই, সহানুভূতি নেই। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে দোষ চাপাতে বিএনপির সর্বাত্মক চেষ্টা। বিএনপির একজন নেতাও দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াননি। অবশ্য এ ব্যাপারে বিএনপি খুব স্পষ্ট এবং রাখঢাকহীন। কারণ সাম্প্রদায়িকতা জিইয়ে রাখার মাধ্যমেই বিএনপি বিকশিত হয়েছে। জিয়া ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ উপড়ে ফেলেছিলেন। যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ফ্যাসিস্ট শক্তি জামায়াতকে রাজনীতিতে পুনরুত্থিত করেছিলেন। রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। রাজাকার, যুদ্ধাপরাধীদের জেল থেকে বের করে নতুন জীবন দিয়েছিলেন। জিয়ার সময় এ রাষ্ট্রে দুই শ্রেণির নাগরিক ব্যবস্থা তৈরি হয়। মুসলমানরা প্রথম শ্রেণির নাগরিক, অন্যরা দ্বিতীয় শ্রেণির। জিয়া সর্বত্র সমঅধিকারের বদলে সংখ্যালঘুদের জন্য সীমিত কোটার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। আজ বাংলাদেশে যে ধর্মান্ধ মৌলবাদের দাপট তার স্রষ্টা জিয়াউর রহমান। বিএনপি একে লালন করেছে, পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। এখনো বিএনপি ও জামায়াতের লিভ-টুগেদার অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রধান বিষফোঁড়া। বিএনপির মতো মূলধারার জনপ্রিয় দল মৌলবাদ, উগ্র সাম্প্রদায়িকতাকে সমর্থন করার কারণেই এখনো সাম্প্রদায়িকতা ফণা তুলে আছে। বিএনপি যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই সাম্প্রদায়িক, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে লালন করেছে। বিএনপিই যুদ্ধাপরাধী নরঘাতক মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদকে শহীদের রক্তে ভেজা জাতীয় পতাকা উপহার দিয়েছে। বিএনপি বাংলা ভাই, জেএমবি সৃষ্টি করেছে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতাকে বিএনপি সব সময় স্বাগত জানায়। প্রকাশ্যে অথবা গোপনে। বিএনপি নেতাদের সাম্প্রতিক আহ্লাদে সেই ধারণাটি আরও প্রতিষ্ঠিত হয়। বিএনপি মনে করে সাম্প্রদায়িক বিভাজনই তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি। মানুষ যত উগ্র মৌলবাদকে আলিঙ্গন করবে, বিএনপি তত হৃষ্টপুষ্ট হবে- এটা বিএনপির অনেকের বিশ্বাস। তাই কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী ও রংপুরের ঘটনায় বিএনপি নেতারা যেন ‘হারানো যৌবন’ ফিরে পাচ্ছেন। এ ঘটনায় তারা আওয়ামী লীগকে নকআউট করেছেন! জয়ের আনন্দে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্যের মতো প্রলাপ বকছেন। অথচ এইট দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হলে বিএনপি এসব ঘটনার নির্মোহ, নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করতে পারত। ঘটনাস্থলে মানবিক সহায়তার হাত বাড়াতে পারত। কিন্তু এসব না করে বিএনপি নেতারা আওয়ামী লীগের ওপর দোষ চাপাতে ব্যস্ত। এর ফলে প্রকৃত অপরাধীরা আড়ালে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দোষারোপের রাজনীতি চলছে। কথার তুফান মেইলে জাতি দিশাহারা। এর মধ্যে খবর পাওয়া গেল কুমিল্লার পূজামন্ডপে কোরআন শরিফ রাখা ব্যক্তি ইকবাল হোসেন (৩৫)। একজন মুসলমান। তার মানে কী? কোনো হিন্দু ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করেনি। একজন মুসলমান এ অপকর্ম করেছে। তার লক্ষ্য ছিল অশান্তি সৃষ্টি। ইকবালের রাজনৈতিক পরিচয় কী তা আমরা এখনো জানি না। আমি জানতে আগ্রহী নই। তিনি একজন অমানুষ। মানুষরূপী পশু। দানব। এসব সহিংসতার কারণ এই জানোয়াররা। সাম্প্রদায়িক এ বীভৎস খেলায় এরাই আসল খেলোয়াড়। এরা কার পক্ষে? আওয়ামী লীগ না বিএনপি- সে প্রশ্নের উত্তর সময়ই বলে দেবে। তবে নিশ্চিতভাবে এরা বাংলাদেশের বিপক্ষে।

টি-২০ বিশ্বকাপ দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম। খেলায় হারলে ঘুরে দাঁড়ানো যায় সহজে। বাংলাদেশ তা বারবার প্রমাণ করেছে। রাষ্ট্রের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, উন্নয়ন সংকটও কাটিয়ে ওঠা যায়। কিন্তু আদর্শ হারালে ঘুরে দাঁড়ানো যায় না। বাংলাদেশ যদি আদর্শচ্যুত হয় তাহলে আমাদের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায়। আমরা হেরে যাই। সাম্প্রদায়িকতার এই তীব্র লেলিহান শিখায় আমরাও কি পুড়ে যাচ্ছি? বাংলাদেশ কি হেরে যাচ্ছে?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

Email : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর